ঢাকা: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে প্রশাসনে বড় ধরনের রদবদল চলছে। ৫০টিরও বেশি জেলায় জেলা প্রশাসক পদে পরিবর্তন এনেছে সরকার। বদলি না হলে এসব ডিসিরই রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালনের কথা থাকায় নিয়োগকে ঘিরে প্রশাসনের ভেতরে দুই রাজনৈতিক বলয়ের প্রতিযোগিতা তীব্র আকার ধারণ করেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আগে থেকেই জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কার তিন নির্বাচনে যেসব কর্মকর্তা যুক্ত ছিলেন, তাঁদের আগামী নির্বাচনের দায়িত্বে রাখা হবে না। জনপ্রশাসন ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পদস্থ কর্মকর্তাদের ধারণা, ডিসি নিয়োগে প্রধানত এই নীতিকেই অনুসরণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সঙ্গে কারও সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে।
মাঠ প্রশাসনে কাজের অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও বিলুপ্ত অর্থনীতি ক্যাডার থেকে প্রশাসন ক্যাডারে যুক্ত হওয়া অনেক কর্মকর্তা ডিসি নিয়োগ পাচ্ছেন। তাঁদের কেউ কেউ কখনো নির্বাচনি কাজেও যুক্ত ছিলেন না-এ নিয়ে ভিতরে সমালোচনা তৈরি হয়েছে।
সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া মনে করেন, মাঠ প্রশাসন ও নির্বাচনে অভিজ্ঞতা ছাড়া কাউকে ডিসি করলে ভালো নির্বাচন সহায়ক হয় না। তিনি বলেন, সরকার যে ধরনের নির্বাচন চায়, ডিসি-ইউএনও যিনিই হোন, সেই ফলই আনবেন। তাই ঢালাওভাবে সবাইকে বাদ না দিয়ে দক্ষ ও কৌশলী কর্মকর্তাদের পোস্টিং দেওয়াই জরুরি।
৯ নভেম্বর গভীর রাতে ১৪ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি হলে সামাজিক মাধ্যমে ‘রাতের ডিসি’ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এর আগে আরও ১৫ জেলায় এবং সর্বশেষ পৃথক দুটি প্রজ্ঞাপনে আরও ২৩ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কয়েকটি জেলায় আগের ডিসিদের সরানো হলেও বাকিগুলোতে নতুন কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
প্রজ্ঞাপন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নতুন নিয়োগ পাওয়া অনেকেই মাঠ প্রশাসনে দুই বছরের অভিজ্ঞতাও পূর্ণ করেননি, যা ডিসি হওয়ার নীতিমালার অন্যতম শর্ত।
জেলা প্রশাসনে কাজ করা কর্মকর্তারা বলেন, ভূমি ব্যবস্থাপনা ও রাজস্ব আদায়ের বড় দায়িত্বই ডিসির কাঁধে থাকে। এসি ল্যান্ড, ম্যাজিস্ট্রেট, ইউএনও ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা ছাড়া ভূমির দায়িত্ব ও নির্বাচনি ব্যবস্থাপনার দক্ষতা তৈরি হয় না।
ফিরোজ মিয়া বলেন, নির্বাচনে নানা ধরনের ‘খেলোয়াড়’ থাকে। মাঠ প্রশাসন ও আগের কাজের অভিজ্ঞতা না থাকলে এসব পরিস্থিতি সামলানো কঠিন।
২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার থাকা ডিসিদের কেউই আর সেই পদে নেই। অনেককে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে, অনেককে করা হয়েছে ওএসডি। শুধু ২০১৮ সালের নির্বাচনে দায়িত্বে থাকা ৪৫ কর্মকর্তা এ বছর শুরুর দিকে ওএসডি হন।
ইউএনওরা পদাধিকার বলে সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে কাজ করলেও তাঁরা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের অবস্থানে থাকেন না-এমন মন্তব্যও করেছেন ফিরোজ মিয়া।
২৫, ২৭, ২৮ ও ২৯তম বিসিএসের কর্মকর্তারাই এবার বেশি গুরুত্ব পাচ্ছেন। এসব ব্যাচের নিয়োগ বিএনপি আমল, কেয়ারটেকার সরকার ও আওয়ামী লীগ আমলের মিশ্র ইতিহাস বহন করে। ফলে কোন ব্যাচের কর্মকর্তা দায়িত্ব পাবেন, সেটিকে ঘিরে প্রশাসনের ভেতরে দুই রাজনৈতিক বলয়ের চাপা লড়াই চলছে বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।
সরকারের উপদেষ্টাদের একান্ত সচিবকে ডিসি করা নিয়ে যেমন আলোচনা চলছে, তেমনি কিছু জেলায় ডিসি সরানো নিয়েও রাজনৈতিক স্বার্থের অভিযোগ উঠেছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এক জেলার ডিসিকে সরানো নিয়ে বিশেষ সমালোচনা রয়েছে-তিনি ছাত্রজীবনে ছাত্রদলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে পরিচিত।
গত মাসে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গত তিন নির্বাচনে ডিসি, এডিসি, ইউএনওসহ যাঁরা কোনো ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁদের কারওই পদায়ন হবে না।
পদায়নের মানদণ্ডে গুরুত্ব পাচ্ছে শারীরিক সক্ষমতা, বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন (এসিআর), রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা, পূর্বের পোস্টিং ও সংবাদমাধ্যমে তাঁর বিষয়ে কোনো নেতিবাচক খবর এসেছে কি না।
এ ছাড়া কোনো কর্মকর্তার পরিবারের সদস্য নির্বাচন করলে তাকেও নির্বাচনি দায়িত্বের বাইরে রাখা হবে।
সরকারের ঘোষণামতে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হবে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন। আওয়ামী লীগ ছাড়া বাকি দলগুলোকে নিয়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
ডিসিদের ব্যাপক পরিবর্তন, রাজনৈতিক বলয়গুলোর প্রতিযোগিতা, মাঠ প্রশাসনের অভিজ্ঞতা নিয়ে বিতর্ক-সব মিলিয়েই জাতীয় নির্বাচন ঘিরে প্রশাসনে উত্তাপ বাড়ছে। তথ্য সূত্র: বিবিসি বাংলা।
এসএইচ