ভূমিকম্পের দুঃস্বপ্ন এখনো কাটেনি রাজধানীবাসীর। তার মধ্যেই ঢাকার সবচেয়ে বড় ঘনবসতিপূর্ণ কড়াইল বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। মহাখালী-গুলশানের আকাশচুম্বী ভবনের পাশের লেকের ওপারে সারি–সারি টিনের চালের খুপড়ি ঘর। দূরত্ব সামান্য হলেও জীবনমানের ব্যবধান যেন আসমান–জমিন। শহরের ক্ষমতার খেলা আর টিকে থাকার সংগ্রামে বস্তির মানুষদের আগুনে পুড়ে নিঃস্ব হওয়ার আখ্যান যেন বারবারই ফিরে আসে।
কড়াইল বস্তিতে আগুন এখন এক অপ্রত্যাশিত অথচ পরিচিত আতঙ্ক। বারবারের এই অগ্নিকাণ্ড নিম্ন–আয়ের মানুষের মন থেকে সরেনি ভয়। সচেতন মহলের মতে, যে শহরে একদিকে কাঁচের উঁচু ভবন আর অন্যদিকে টিন-পলিথিনের ঠাসাঠাসি বসতি, সেই শহরের আগুন শুধু ঘর নয়, জীবন–জীবিকার ন্যূনতম নিশ্চয়তাও পুড়িয়ে দেয়।
নগর পরিকল্পনায় যেখানে একজন মানুষের ন্যূনতম বাসযোগ্যতার মানদণ্ড সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে কড়াইল বস্তিতে ৪০–৫০ বর্গফুট জায়গায় একজন মানুষের বসবাস অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিকে আরও বাড়িয়ে তোলে। প্রায় ৯০ একর এলাকা জুড়ে গড়ে ওঠা এই বস্তিতে লাখের মতো মানুষের বসতি। কর্মজীবী নারী, দিনমজুর, রিকশাচালক, গার্মেন্টসকর্মী, হকার-সবাই মিলিয়ে প্রতিদিন বেঁচে থাকার লড়াই।
প্রায় প্রতিবছর, কখনো বছরে কয়েকবারও কড়াইল বস্তিতে বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটে। সর্বশেষ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে গত মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে। খবর পাওয়ার পর ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট টানা চার ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে রাত সাড়ে ১০টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে এবং পরদিন সকাল সাড়ে ৯টায় পুরোপুরি নির্বাপণ সম্ভব হয়।
বউবাজার এলাকার কুমিল্লা পট্টি, বরিশাল পট্টি ও ক-ব্লক থেকে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে জানা গেছে। ওই এলাকায় হাজারাধিক ঘর ছিল। অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ১২শ ঘর পুড়ে গেছে বলে ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন। বুধবার সকাল পর্যন্ত সরেজমিনে দেখা যায়, ঘরগুলোর বেশির ভাগই টিন, বাঁশ, কাঠ, কার্ডবোর্ড ও প্লাস্টিক দিয়ে বানানো। যা আগুন লাগলে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ার মতো অত্যন্ত দাহ্য উপকরণ।
যেখানে টিনশেড ঘরের ওপরই কোথাও তিনতলা পর্যন্ত বানানো হয়েছে, সেখানে এক–একটি রান্নাঘর ও বাথরুম ভাগ করে ব্যবহার করে কয়েকটি পরিবার। বস্তির সরু গলি, অগোছালো বিদ্যুৎ লাইন এবং নিরাপত্তাহীন রান্নার চুলা-সব মিলিয়ে আগুনের জন্য তৈরি থাকে অনুকূল পরিবেশ। এ কারণে গত বছর বস্তির সরকারি গ্যাসলাইন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের।
কেন এত ঘনঘন আগুন লাগে-এমন প্রশ্নে বাসিন্দাদের বক্তব্যে উঠে আসে একাধিক কারণ। অস্থায়ী ও দাহ্য গঠনের ঘনবসতিপূর্ণ অবকাঠামো, অনুমোদনহীন ও ঝুলন্ত বিদ্যুৎ সংযোগ, নিম্নমানের গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবহার, পানির অভাব, সরু রাস্তায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশে বাধা-সব মিলিয়ে আগুন যেন সহজেই বড় বিপর্যয়ে পরিণত হয়। বস্তি দখলদারি, রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও স্বার্থের দ্বন্দ্বকে নিয়েও সন্দেহ আছে ক্ষতিগ্রস্তদের। তাদের মতে, বারবার আগুনের ঘটনায় শুধু ঘরবাড়িই নয়, জীবন–জীবিকার স্বপ্নও পুড়ে যায়।
সরকারি তদারকি না থাকা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়িত না হওয়ায় পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি বলে মনে করেন স্থানীয়রা। বস্তিজুড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ড্রেনেজ, সাবস্টেশন বা ফায়ার হাইড্রেন্টের কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে বাসিন্দারা অসহায় হয়ে পড়েন।
আগুনে সব হারানো মানুষের বর্ণনায় উঠে আসে তাদের অভিন্ন দুর্দশা-হতাশা, বেদনা আর অনিশ্চয়তা। কারও ঘর তৃতীয়বার পুড়ে গেছে, কারও স্কুলের বই–খাতা নেই, কারও সামনে পরীক্ষার সময়। কেউ নদীর ভাঙন বা বন্যায় গ্রাম হারিয়ে ঢাকায় এসে নতুন করে আগুনের দুঃস্বপ্নে আটকে গেছে।
প্রাথমিক তদন্তে আগুনের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে শর্ট সার্কিট, সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ও অসাবধানতাজনিত আগুনকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। তবে তদন্তকারীদের মতে, এত ঘিঞ্জি বসতিতে আগুনের উৎপত্তিস্থল শনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে, কারণ ঘরগুলো মুহূর্তেই পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, সরু পথ ও পর্যাপ্ত পানির অভাব কড়াইল বস্তিতে আগুন নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা। অগ্নি-নিরাপত্তা বাড়াতে বস্তিজুড়ে প্রশস্ত রাস্তা, ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন এবং বস্তির জন্য আলাদা ইউনিট গড়ে তোলার মতো উদ্যোগ প্রয়োজন। সচেতনতামূলক কার্যক্রম চললেও বাস্তবে বড় কোনো পরিবর্তন আসছে না।
বারবার নিঃস্ব হওয়া মানুষগুলো জানে, আজ উত্তর পাশ পুড়লে কাল দক্ষিণ পাশ। শহরের হৃদয়ে থাকা এই বস্তির আগুন যেন সবসময়ই অপেক্ষায়-পরবর্তী ঝটকার সময়ের।
এসএইচ