গঙ্গা চুক্তি: ব্যারাজের সমীক্ষাতেই কেটে গেছে ২০ বছর

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৪, ২০১৬, ০২:৪১ পিএম

ঢাকা: শুষ্ক মৌসুমে (ডিসেম্বর-এপ্রিল) বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার নদীগুলোর পানির অন্যতম উত্স ভারত থেকে বয়ে আসা গঙ্গা নদী, বাংলাদেশে যা পদ্মা নামে প্রবাহিত। ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসে ভারত ফারাক্কা ব্যারাজ চালু করলে পানির ন্যায্য হিস্যার জন্য চুক্তির দাবি তোলে বাংলাদেশ। 

অনেক আলোচনার পর ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত হয় গঙ্গা চুক্তি। চুক্তি অনুযায়ী গঙ্গার পানি ব্যবহার করার কথা ছিল বাংলাদেশের। কিন্তু গত ২০ বছরেও গঙ্গার পানি ব্যবহারে ব্যারাজ নির্মাণ করতে পারেনি বাংলাদেশ। শুধু পদ্মা-গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা শেষ করা হয়েছে।

আগামী ১০ বছর পর শেষ হবে গঙ্গা চুক্তির মেয়াদ। বাংলাদেশ যদি এর মধ্যে পদ্মা-গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ করতে না পারে, তাহলে চুক্তি নবায়ন করা কঠিন হবে। চুক্তি নবায়নের আলোচনায় ভারত যুক্তি দিতে পারে যে, বাংলাদেশ পানি নিয়ে সেই পানি বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেয়। তাই বাংলাদেশের আর আগের মতো পানির দরকার নেই। তখন চুক্তিটি নবায়নে জটিলতা দেখা দিতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

পানি বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১৯৯৬ সালের চুক্তির পর বাংলাদেশ সরকার গঙ্গা নদীর পানি ব্যবহারে আগ্রহ দেখায়নি। বেশ কয়েকবার গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে এবং কয়েকবার সমীক্ষা শুরু হলেও সেই সমীক্ষা আলোর মুখ দেখেনি। 

২০০০ সালের পর শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গা নদীর পানির প্রাপ্যতা কমতে থাকে। দক্ষিণের ২১টি জেলার ১২৩টি নদীতে শুষ্ক মৌসমে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। দাবি ওঠে দ্রুত গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণের।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণের জন্য সমীক্ষা শুরু হয় এবং ২০১৪ সালে শেষ হয়। পদ্মা-গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণে ভারতের সঙ্গে আলোচনাও অনেকটা এগিয়েছে। দ্রুত নির্মাণ কাজ শুরু করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগগুলো এগিয়ে নিতে হবে। 

পানি সম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ জানান, পদ্মা-গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়ে ভারতের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই ভারতীয় কারিগরি প্রতিনিধি দল প্রকল্প এলাকা ঘুরে গেছেন। পদ্মা-গঙ্গা ব্যারাজ সংক্রান্ত বাংলাদেশ ও ভারত কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়েছে। দুই দেশের কারিগরি কমিটি শিগগিরই বৈঠকে বসবে। আশা করি, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে এ বিষয়ে একটি ঘোষণা আসবে।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, গঙ্গা নদী ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর ৮৫ কিলোমিটার পাংখা থেকে মাথাভাঙ্গা নদীর মুখ পর্যন্ত একদিকে বাংলাদেশ এবং অন্যদিকে ভারত। বাংলাদেশ-ভারতের কারিগরি কমিটি এই অংশের বিষয়ে জরিপ ও সমীক্ষা চালাবে। পদ্মা-গঙ্গা ব্যারাজে যে জলাধার নির্মাণ করা হবে, সেই জলাধারের পানি ভারতের অংশে কোনো ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে কি না সে বিষয়টি মূলত খতিয়ে দেখবে কারিগরি দল।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পদ্মা-গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পে ভারতের বিনিয়োগ ও সম্মতির বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে। ভারতও এ বিষয়ে কাজ করছে। দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যেই বৈঠক করেছে এবং শেখ হাসিনার সফরে এ বিষয়ে একটি ঘোষণা দেওয়া হতে পরে।

১৯৯৬ সালে গঙ্গা চুক্তির সময় বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি দলের সদস্য পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত গতকাল সকালের খবরকে বলেন, গঙ্গা চুক্তির ২০ বছর হয়ে গেছে। আর মাত্র ১০ বছর চুক্তির মেয়াদ আছে। তাই দ্রুত পদ্মা-গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পের কাজ শুরু করতে হবে। 

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, ভারত ক্রমান্বয়ে গঙ্গা নদীর পানির ব্যবহার বাড়াচ্ছে। বাংলাদেশে গঙ্গা নদীর পানির প্রাপ্যতা কমে যাচ্ছে। বিগত ৬৭ বছরের মধ্যে ফারাক্কা পয়েন্টে এ বছর শুষ্ক মৌসুমে সর্বনিম্ন ১৫ হাজার কিউসেক পানি পেয়েছে বাংলাদেশ।

দেশের নদীগুলোর ৪০ ভাগ পানি আসে এই নদী দিয়ে। এতে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার ১২৩টি নদী শুকিয়ে যায় এবং জলজ, প্রাণিজ ও বনজ সম্পদ হুমকির মুখে পড়ে। এছাড়া লবণাক্ততা থেকে প্রায় ছয় কোটি মানুষের জন্য গঙ্গা (পদ্মা) নদীতে ব্যারাজ নির্মাণ করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণের জন্য ১৯৬০ সাল থেকে এর আগে পাঁচবার সমীক্ষা করা হয়েছে। এবার রাজবাড়ী জেলার পাংশা এবং পাবনা জেলার সুজানগরের মাঝখান দিয়ে পদ্মা নামে বয়ে যাওয়া গঙ্গা নদীতে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ২ দশমিক ১ কিলোমিটার ব্যারাজ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। ব্যারাজের ওপর ব্রিজ করা হবে। এতে দুটি অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থারও উন্নয়ন ঘটবে।

গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ সমীক্ষায় বলা হয়েছে-গঙ্গা ব্যারাজের মাধ্যমে ১১ মিটার উচ্চতার ২৯০০ মিলিয়ন ঘনমিটার পানি ধারণযোগ্য জলাধার সৃষ্টি করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে সেচ ও ইলিশসহ মত্স্যসম্পদ উন্নয়ন, জলবিদ্যুত্ উত্পাদন, নৌপরিবহন, লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণ, জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসন এবং সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ও বনজ সম্পদ রক্ষায় ব্যবহার করা হবে। আর এর ফলে সাত বছরের মধ্যেই ব্যয়ের টাকা উঠে আসবে।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি