উপকূলের লবণাক্ততা প্রসঙ্গে

  • জান্নাতুল মাওয়া নাজ | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মে ১৭, ২০২১, ১২:০১ পিএম

ঢাকা : বিশ্বের অন্যতম সুপেয় পানির আধার বাংলাদেশে এখন লবণাক্ততা বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততার সমস্যাটি দীর্ঘদিনের। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই সমস্যা আরো প্রকট হয়েছে। ফলে ওই অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে, জমির উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে এবং অনেকের জীবিকা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মোট আয়তন ২ লাখ ৪৭ হাজার ৬৭৭ বর্গকিলোমিটার প্রায়। উপকূলীয় অঞ্চল প্রায় ২০ শতাংশ জুড়ে রয়েছে। লবণাক্ততার কারণে দেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় উপকূলের মানুষের মৃত্যুহারও বেশি, বিশেষ করে শিশুদের মৃত্যু এখানে বেশি হয়। লবণাক্ততার কারণে প্রতিবছর বিশ্বের ১৭ কোটি মানুষের প্রয়োজনের সমপরিমাণ খাদ্য উৎপাদন কম হয়। শুধু লবণাক্ততাই নয়, বিশ্বজুড়ে পানির নতুন বিপদ হিসেবে অতি ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণার সমস্যাকে সামনে আনা হয়েছে। একই সঙ্গে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও আর্সেনিকের কারণে পানিদূষণের বিষয়টি উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, এসব সমস্যা বিশ্বের সুপেয় পানির উৎসগুলোকে বিষিয়ে তুলছে।

উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বন্ধে পাকিস্তান আমল থেকে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে বেড়িবাঁধ উল্লেখযোগ্য। কিন্তু সিডর ও আইলার পর অনেক স্থানেই সেই বাঁধ ভেঙে গেছে। এছাড়া চিংড়ি চাষের জন্য অনেকে বাঁধ কেটে ঘের এলাকায় লবণপানি ঢুকিয়ে থাকেন। এতে গুটিকয়েক চিংড়িচাষি লাভবান হলেও এলাকার বেশিরভাগ বাসিন্দার জীবন-জীবিকা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের জরিপ অনুযায়ী, বিশ্বের ৮০ শতাংশ সুপেয় পানি, ট্যাপের পানির ৮১ শতাংশ ও বোতলজাত পানির ৯৩ শতাংশ ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণার দূষণের শিকার। বাংলাদেশেও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। বাংলাদেশের ১২ শতাংশ মানুষ এখনো আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করে। আর গড়ে উপকূলের ৩ শতাংশ শিশু লবণাক্ততার কারণে মারা যায়। এই হার বরিশাল বিভাগে প্রায় ২০ শতাংশ। এসব এলাকার নারীরা প্রতিদিন গড়ে ২০ কিলোমিটার দূর থেকে মিষ্টিপানি সংগ্রহ করে। এতে তাদের নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা হয়।

মানুষের শরীরে নির্দিষ্ট পরিমাণ লবণের প্রয়োজন এবং সেটি আসে খাদ্য ও পানি থেকে। কিন্তু উপকূলীয় এলাকার পানিতে লবণের পরিমাণ অনেক গুণ বেশি। এই পানি শরীরে প্রবেশ করলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায়। বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের জন্য তা হয়ে ওঠে আরো বেশি বিপজ্জনক। গর্ভাবস্থায় নারীরা বেশি লবণাক্ত পানি খেলে খিঁচুনি ও উচ্চ রক্তচাপ হয়। এ কারণে নারীদের গর্ভাবস্থায় সন্তান মারা যাওয়ার হারও বেশি, যা বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) এক গবেষণায় বলা হয়, লবণাক্ততার কারণে উপকূলের নারীরা শুধু অকাল গর্ভপাতেরই শিকার হন না, ৩ শতাংশ শিশুও মারা যায়। এ ছাড়া বেশি লবণ খাওয়ার সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপের সম্পর্ক রয়েছে, যা হূদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। দেশ এবং নেট আবাদযোগ্য ক্ষেত্রের ত্রিশ শতাংশেরও বেশি। এটি উপকূল থেকে ১৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত প্রসারিত হয়। উপকূলীয় ও উপকূলীয় অঞ্চলের ২.৮৮ মিলিয়ন হেক্টর জমির মধ্যে প্রায় ০.৮৮ মিলিয়ন হেক্টর আবাদযোগ্য জমি, যা বাংলাদেশের মোট আবাদযোগ্য জমির ৩০ শতাংশেরও বেশি অংশজুড়ে। উপকূলীয় অঞ্চলের একটি অংশ, সুন্দরবন, একটি রিজার্ভ প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বন যা প্রায় ৪ হাজার ৫০০ কিলোমিটারজুড়ে রয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলের অবশিষ্ট অংশ কৃষিতে ব্যবহূত হয়। উপকূলীয় জেলাগুলোর আবাদযোগ্য অঞ্চল বিভিন্ন ডিগ্রি মাটির লবণাক্ততায় প্রভাবিত হয়। বাংলাদেশের উপকূলীয় এবং উপকূলীয় অঞ্চলে বঙ্গোপসাগরসহ দক্ষিণে জোয়ার, মোহ এবং নদী প্লাবন সমভূমি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই অঞ্চলগুলোতে কৃষিজমি ব্যবহার খুব খারাপ, যা দেশের গড় প্রায় ৫০ শতাংশ লবণাক্ততা প্রতিকূল পরিবেশ এবং জলবিদ্যুৎ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে যা সাধারণ ফসলের উৎপাদনকে সীমাবদ্ধ করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি উপকূলের মানুষ কম লবণাক্ত পানি (যেমন বৃষ্টির পানি) পান করে, তাহলে তাদের রক্তচাপ কমিয়ে আনা সম্ভব। খুলনার দাকোপ উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবা নিতে আসা ১ হাজার ২০৮ জন গর্ভবতী মায়ের তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শুধু নলকূপের পানি পান করা মায়েদের উচ্চ রক্তচাপ বেশি। এই স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষকে সুরক্ষা দিতে হলে সুপেয় ও মিষ্টি পানির ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু ওই অঞ্চলের মানুষ এতটাই দরিদ্র যে তাদের পক্ষে পুকুর খনন বা বৃষ্টির পানি দীর্ঘদিন ধরে রাখা সম্ভব নয়। কিছু অঞ্চল এবং লবণাক্ত পানির আরো অনুপ্রবেশের কারণ হিসেবে লবণ প্রভাবিত অঞ্চলের সম্প্রসারণ, সাধারণ ফসলের উৎপাদন আরো সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। লবণাক্ততায় ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি অঞ্চলগুলোর বর্তমান রাষ্ট্রের মূল্যায়ন প্রয়োজন। অতএব, সরকারি উদ্যোগেই পুকুর খনন ও বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।

মাটির লবণাক্ততা বিশ্বব্যাপী সমস্যা। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশে লবণাক্তকরণ শস্য উৎপাদন ব্যাহতকারী অন্যতম প্রধান প্রাকৃতিক বিপদ। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ৫৩ শতাংশ লবণাক্ততার বিভিন্ন ডিগ্রি দ্বারা আক্রান্ত হয়। এই অঞ্চলগুলোতে কৃষিজমির ব্যবহার খুব খারাপ। দেশে খাদ্য সুরক্ষা সমস্যা নিয়ে উদ্বেগ। লবণাক্ততার সমস্যা অতীতে খুব কম মনোযোগ পেয়েছিল। তবু এর লক্ষণগুলো স্যালাইনাইজেশনের সঙ্গে এ-জাতীয় ভূমির অবক্ষয় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উপেক্ষা করার মতো হয়ে উঠছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বর্ধিত চাপ আরো খাদ্যের চাহিদা করে। সুতরাং দীর্ঘমেয়াদি ভূমি ব্যবস্থাপনার কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে দেশে খাদ্য সুরক্ষার জন্য ভূমি লবণাক্তকরণ সমস্যার মোকাবিলা করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দ্য এনভায়রনমেন্ট রিভিউ