ঢাকা : পানি শোধন হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট ব্যবহার শেষে পানিকে আরো গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য এটির গুণগত মানকে আরো উন্নত করা। পানির সর্বোচ্চ ব্যবহার হচ্ছে পানি পান, শিল্পে পানি সরবরাহ ও সেচ, নদী প্রবাহ রক্ষণাবেক্ষণ এবং কৃষি ক্ষেত্রে। দূষিত পানি শোধন বলতে আমরা সাধারণত পানি থেকে অবাঞ্ছিত উপাদানগুলো সরিয়ে দেওয়া বা তাদের ঘনত্ব হ্রাস করাকে বুঝি, যেন পানির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়।
প্রথমেই আমাদের জানতে হবে পানি কীভাবে দূষিত হয়, সাধারণত মানুষই এর জন্য দায়ী। মানুষের দৈনন্দিন বিভিন্ন কার্যকলাপের ফলে জলাশয় দূষিত হয়ে পড়লে তাকে পানিদূষণ বলা হয়। উদাহারণস্বরূপ জলাশয় বলতে হ্রদ, নদী, সমুদ্র ভূগর্ভস্থ পানি এবং ভৌমজলকেই বোঝায়। স্বাভাবিক পরিবেশে দূষণকারী পদার্থ উপস্থিত হলে পানিদূষণ হয়। বিপুল পরিমাণ দূষিত পানি যদি স্বাভাবিক জলাশয়ে জমা হয়, তবে তা জলজ বাস্তুতন্ত্রের পরিবশেগত অবনতি ঘটাতে পারে। এর ফলে ভাটির দিকে যা নিচু এলাকার মানুষের জনস্বাস্থ্যের ব্যাপক সমস্যা দেখা দিতে পারে। তারা এই দূষিত পানি পান করা, গোসলের জন্য এবং নানান রকম দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করে এবং সেইসাথে সেচকাজেও তারা এই পানি ব্যবহার করবে। পানিবাহিত রোগের প্রকোপে সারা বিশ্বে যত মানুষ আক্রান্ত হয় বা মারা যায়, তাদের সিংহভাগই ঘটে পানিদূষণের কারণে।
পানিদূষণের কারণ হিসেবে প্রচুর রাসায়নিক এবং রোগজীবাণুর কথা বলা যেতে পারে। তা ছাড়া অনেক ভৌত স্থিতিমাপও রয়েছে। দূষকগুলো জৈব অথবা অজৈব পদার্থের হতে পারে। উচ্চ তাপমাত্রা ও পানি দূষণের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। তাপীয় দূষণের একটি সাধারণ কারণ হলো তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং শিল্পোৎপাদন কেন্দ্রে কুল্যান্ট হিসেবে পানির ব্যবহার। উচ্চ জলীয় তাপমাত্রা পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা কমিয়ে দেয় যার ফলে মাছ মারা যায় এবং খাদ্যশৃঙ্খলের উপাদানও পরিবর্তিত হয়, প্রজাতির বাস্তুতন্ত্র কমে আসে এবং এর ফলে সৃষ্ট ব্যাকটেরিয়ায় নতুন প্রজাতির উদ্ভব হয়। পানির নমুনা বিশ্লেষণ করে পানি দূষণ পরিমাপ করা হয়। রাসায়নিক, জৈব এবং ভৌত পরীক্ষা করা হয়। সঠিক পরিকাঠামো এবং পরিচালনা ও পরিকল্পনা দ্বারাই জলদূষণকে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
বিশ্বব্যাপী পানিদূষণ একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এর জন্য আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় পর্যায়ে পানিসম্পদ নীতির মূল্যায়ন এবং পুনর্মূল্যায়ন জরুরি। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বে যত রোগ ও মৃত্যু হয়, তার সাথে কোনো না কোনোভাবে দূষিত পানির প্রভাব রয়েছে। ২০১৫ সালে ১৮ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল দূষিত পানি। বৈশ্বিক সামুদ্রিক পরিবেশগত সমীক্ষা নামক সংস্থার মতে পানিদূষণ হল অন্যতম প্রধান একটি পরিবেশগত সমস্যা যেটা পরবর্তী দশকগুলোতে পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্বকে সংকটে ফেলে দিতে পারে। ফাইটোপ্ল্যাক্টন যেগুলো ৭০% অক্সিজেন উৎপন্ন করে এবং পৃথিবীর কার্বন ডাই-অক্সাইডের একটি বড় অংশ শোষণ করে, পানিদূষণ তাদের জন্য একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা।
পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে উন্নত দেশগুলোতে। ভারত এবং চীন এই দুই দেশে পানি দূষণের মাত্রা অত্যন্ত বেশি। ভারতে প্রতিদিন আনুমানিক ৫৮০ জন মানুষ পানি দূষণজনিত রোগে মারা যায়। এদিকে চীনের শহরের জলের প্রায় ৯০ শতাংশই দূষিত। ২০০৭ সালের হিসোব অনুযায়ী, চীনে প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ নিরাপদ পানি থেকে বঞ্চিত। পানি শোধনের বেশ কিছু পদ্ধতি রয়েছে যার মাধ্যমে পানি দূষণরোধ এবং দূষিত পানি শোধন করা যায়। পানীয় জল শোধনের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে অপরিশোধিত পানি থেকে দূষণকারী উপাদান সরানো, যাতে বিশুদ্ধ পানি উৎপাদন করা যায় যা কোনো প্রতিকূল স্বাস্থ্যের প্রভাবে স্বল্পমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি ব্যতীত মানুষের ব্যবহারযোগ্য হয়। পানীয় জল শোধনে যেসব পদার্থ সরিয়ে ফেলা হয় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে বাতিল হয়ে যাওয়া কঠিন বস্তু, ব্যাকটেরিয়া, শৈবাল, ভাইরাস, ছত্রাক এবং খনিজ পদার্থ, যেমন আয়রন এবং ম্যাঙ্গানিজ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) নির্দেশিকা হলো এমন একটি সাধারণ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা, যেটির মাধ্যমে স্থানীয় মানের বাস্তবায়ন হবে। উন্নত দেশেগুলোতে পানি শোধনের কঠোর মানগুলো প্রযোজ্য। এগুলো পানীয় জলের মানের প্রয়োজনীয়তার জন্য সারা বিশ্বজুড়ে অনুসরণ করা হয়। বিশ্বব্যাপী পৌর পানীয় জল শোধনের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। যেমন শ্যাওলা নিয়ন্ত্রণ এবং জৈবিক বৃদ্ধি কমানোর জন্য ক্লোরিন প্রয়োগ; দ্রবীভূত লৌহ অপসারণের জন্য ক্লোরিনের সাথে বাতান্বয়ন প্রয়োগ এবং যখন অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণে ম্যাঙ্গানিজ উপস্থিত থাকে, ব্যাকটেরিয়া ভাইরাস এবং অন্যান্য জীবাণু অপসারণ করার জন্য নির্বীজন।
পানীয় জল এবং অন্যান্য ব্যবহারের জন্য প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতি হলেও আমাদের দেশে তা পরিলক্ষিত হয়নি। উন্নত বিশ্বে পানি এবং বর্জ্য পানি শোধনে স্বয়ংক্রিয়করণ ব্যবস্থা একটি সাধারণ বিষয়। বর্জ্য জল শোধন হচ্ছে এমন এক প্রক্রিয়া যা বর্জ্য বা নর্দমার ময়লা জল থেকে দূষণকারী উপদানগুলির সংখ্যাগরিষ্ঠতা অপসারণ করে এবং পানিকে বিশুদ্ধ রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।
জৈব প্রযুক্তির মাধ্যমে ও দূষিত পানি শোধন করা হয়ে থাকে। পানি দূষণ রোধে পরিবেশগত বায়োটেকনোলজির ব্যবহার করা হয়ে থাকে উন্নত বিশ্বে। বহু বিভাগীয় ইন্টিগ্রেশন বিজ্ঞান এবং প্রকৌশল ব্যবহার করার জন্য অণুজীবের বিশাল জৈব রাসায়নিক সম্ভাবনা রয়েছে। পরিবেশগত বায়োটেকনোলজি ব্যবহার করা হয় উন্নত প্রযুক্তি বিকাশ দক্ষতা বাড়াতে এবং বর্জ্য হ্রাস বা ব্যবহার করতে শিল্প এবং পরিবেশ গবেষণায় জড়িত। বায়োরিমিডিয়েশনের মতো নিয়ন্ত্রণ এবং বায়োপ্রোসেসগুলো শিল্প বর্জ্যজল শোধন ব্যবহার হয়ে থাকে। আমাদের দেশের পানি শোধনের জন্য সরকারীভাবে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও বায়োটেকনোলজি বা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে পানি শোধনের ব্যবস্থা কিছু বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানে পরিলক্ষিত হয়েছে।
আমাদের দেশে দিন দিন মানুষের জীবণযাত্রার মান বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এর সাথে প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার ও দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। তার মধ্যে সবচাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পানি। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ হয় এমন ভূমির পরিমাণও কমে যাচ্ছে। ব্যবহূত জল জমা হবে এমন জমির পারিমণ কমে যাচ্ছে। পরিবেশ তার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হারাচ্ছে। পানি দূষণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েই যাচ্ছে। এমতাবস্থায় উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে পানিদূষণ রোধ করা এখন একান্ত জরুরি। এক্ষত্রে বায়োটেকনোলজি হতে পারে উপযুক্ত সমাধান।
লেখক : শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ