ঢাকা : করোনা মহামারিতে আনন্দ, উল্লাস, উৎসব সব ম্লান হয়ে গেছে। টিমটিমে আলোয় জীবন প্রদীপ নিভুনিভু করে। পাহাড়চুম্বী মিনার থেকে সকাল-সন্ধ্যা মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে মৃত্যুর সংবাদ বাতাসের সাথে ভেসে আসে। করোনায় আক্রান্ত হলে আত্মীয়, প্রতিবেশী, বন্ধু সকলে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। মধুর সম্পর্কে ধুলো জমে ধূসর রং ধারণ করেছে। গৃহবন্দি মানুষ অন্তরে উচ্ছলতার সঞ্চার করতে প্রযুক্তির মাধ্যমে বৈচিত্র্যময় বিনোদনে ডুব মারে। আনন্দ-বিনোদন করতে গিয়ে তরুণ-তরুণীরা অশ্লীল কাজে জড়িয়ে পড়ে পাঁচসাত না ভেবে। যা সমাজে বয়ে আনে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা। আল্লাহতায়ালা বলেন, “মানুষ কি মনে করে যে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’ বললেই তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে, আর তাদের পরীক্ষা করা হবে না?” (সুরা আনকাবূত, আয়াত-২)
ছোটোবেলা একের ভিতর সব নামে গাইড বই সবার পড়ার টেবিলে শোভাবর্ধকের পাশাপাশি প্রশ্নগুলোর উত্তর রেডি করে ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে পরিবেশন করত। আজকে টিকটিক অ্যাপ একের ভিতর সব অফার করছে, বিনোদন, নতুন প্রজন্মের প্রাণাধিক প্রিয় শব্দ সেলিব্রিটি গায়ে মাখবে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের রেফার করছে; বিনিময়ে নামেমাত্র কিছু টাকা পকেটে ঢুকছে। এতো সব কিছু দেখে, তরুণ-তরুণীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। কিন্তু তরুণ-তরুণীদের অবচেতন মনে কি একবারও আঘাত করে না? কী করছি? সমাজে কতটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে? করোনার ভয়ে উৎকণ্ঠিত মনে, অশ্লীলতার বীজ বপন করে দিচ্ছে! পর্নোভিডিও, হস্তমৈথুন, ধর্ষণ, মাদকাসক্তির মতো গর্হিত কাজ করতে সুরসুরি দিচ্ছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় যারা এটা পছন্দ করে যে, মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ুক, তাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আজাব। আর আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না।’ (সুরা নূর, আয়াত -১৯)
টিকটিক অ্যাপ ব্যবহার করে অশ্লীলতাপূর্ণ ভিডিও, গানে বা সিনেমার বেহায়াপনায় পরিপূর্ণ ক্ষুদ্র ক্লিপে দেহের বিকৃত অঙ্গভঙ্গি, মানুষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, ইসলামের ধারক-বাহকদের ব্যঙ্গ করে, তরুণ-তরুণীদের ঘুমন্ত মনে সুকৌশলে যৌন কৌতূহলের বিষ ঢেলে; সমাজে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে, মিথ্যা ও গুজব আওড়াতে সাহায্য করে। সমাজে আস্তে আস্তে ফিতনার ডালপালা বিস্তার ঘটে, বৃক্ষের অক্সিজেন বিলানোর মতো সবার দোরগোড়ায় ফিতনার পত্র-পল্লব চোখে পড়ে, তখন নিজেকে মুক্ত রাখা ঢের কঠিন হয়ে পড়ে। ইবনে কাছির (রহ.)-এর মতে, ফিতনা শব্দটির দ্বারা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা বুঝায়। এতো সব কিছু না জেনে, না বুঝে! মানুষ মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ইনবক্সে টিকটকের রেফার করে, আত্মীয়, প্রতিবেশী, ছোটোবড়ো ভাই-বোনকে জোর করে, অ্যাপ ডাউনলোড করতে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পরের সহযোগিতা করো। মন্দকর্ম ও সীমালংঘনে পরস্পরের সহযোগিতা করো না। আর আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ আজাব প্রদানে কঠোর।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত-১৯)
টিকটক অ্যাপে অডিও বা ভিডিও-র সাথে ঠোঁট মিলানোর অনুকরণ প্রবণতা, তরুণ-তরুণীদের সৃজনশীলতা ধ্বংস করছে। যার কারণে নিজেদের মেধা ও জ্ঞানের পরিধি ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। মানুষ দিনে দিনে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হয়ে পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রে, পাকিস্তান ও ভারতসহ অনেক দেশে স্পষ্ট আঁচ করতে পেরেছে, টিকটকের ভয়াবহ পরিণতি। মানুষের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের অন্তরায়, নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটে, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি বাড়ে, তরুণ-তরুণীরা কল্পনার ভেলায় ভাসামান জীবনের অন্তহীন রাস্তায় হাঁটে, অশালীনতা চর্চার মতো মারাত্মক ব্যাধি সমাজের মধ্যে মহামারি রূপ ধারণ করার আশঙ্কা ঘটতে পারে। যা পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের জন্য অশনিসংকেত। তরুণ-তরুণীরা লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে পশ্চিমা নোংরা সংস্কৃতির মিছিলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। সস্তা দামে হাজার হাজার মানুষের মনোরঞ্জনের দায়িত্ব নিয়ে, ফুলের মতো পবিত্র জীবন কলুষিত করে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘লজ্জাশীলতা কেবল কল্যাণই নিয়ে আসে, তা থেকে অকল্যাণের আশঙ্কা নেই।’ (সহিহ বুখারি : ১/৬০৬)
টিকটক অ্যাপে দীর্ঘ ভিডিও থেকে উস্কানিমূলক, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সমাজের অশান্তির বিস্তারের প্রচেষ্টা করে, ক্ষুদ্র ক্লিপ ফেসবুকে, ইউটিউবে ছড়িয়ে দেয়। মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে শান্ত সমাজে বহুমুখ বিশিষ্ট আগ্নেয়গিরির দাবদাহে দগ্ধ করে সবাইকে। মুমিনদের উচিত, মুক্তার দানার মতো যাচাই-বাছাই করে গ্রহণ করা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, যদি কোনো ফাসিক তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তাহলে তোমরা তা যাচাই করে নাও। এ আশঙ্কায় যে, তোমরা অজ্ঞতাবশত কোনো কওমকে আক্রমণ করে বসবে, ফলে তোমরা তোমাদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবে।’ (সুরা হুজরাত, আয়াত-৬) হে আল্লাহ! আমাদের সবাই ফেতনার মহামারি থেকে মুক্ত থাকার শক্তি দান করুন। আমিন।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক