ইগো মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু

  • রাশেদ নাইব | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মার্চ ১৫, ২০২১, ০৪:৪৮ পিএম

ঢাকা : ‘ইগো’ শব্দটির সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। শব্দটি মূলত ইংরেজি হলেও বাংলায় মোটামুটি প্রচলিত হয়ে গেছে বললেই চলে। কেউ যদি জীবনের যে কোনো কাজে কারো তুলনায় এগিয়ে যায়; সেটা হতে পারে ক্লাসে প্রথম হওয়া, হতে পারে ব্যবসায় বা চাকরিতে তুলনামূলক বেশি সফলতা পাওয়া। এসব ব্যাপারে যদি কারো মনে বিন্দুমাত্র হিংসা জন্ম নেয় তাহলে সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয় তার ‘ইগো প্রবলেম আছে।’ তবে এই সমস্যাকে ইগোর চেয়ে ঈর্ষা বা হিংসা বলা ভালো। ঈর্ষা ইগোর একটি অংশ হলেও ইগোর ব্যপ্তি আরো বড়। এটা আপনার সম্ভাবনাময় জীবন ও ক্যারিয়ারকে পুরোপুরি শেষ করে দিতে পারে। তাই ইগো কি-তা ভালো করে জানা, আর তা থেকে বের হয়ে আসাটা ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনের জন্য খুবই জরুরি।

এখানে যেহেতু বলা হয়েছে ইগোর একটা পার্ট হচ্ছে হিংসা, তাহলে সে ব্যাপারে কিছু আলোচনা প্রয়োজন। পবিত্র কোরআনুল কারীমে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যদি তোমাদের কোনো কল্যাণ লাভ হয়, তাহলে তাদের কাছে খারাপ লাগে। আর যদি তোমাদের অকল্যাণ হয়, তাহলে তাতে তারা আনন্দিত হয়।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত -১২০) অন্য আয়াতে আল্লাহপাক বলেন, ‘তারা কি মানুষের প্রতি এজন্যই হিংসা করে যে, আল্লাহ তাদের স্বীয় অনুগ্রহ দান করেছেন।’ (সুরা আন-নিসা, আয়াত-৫৪) হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘মুমিন বান্দার পেটে আল্লাহর রাস্তার ধুলা এবং জাহান্নামের আগুন একত্রে জমা হতে পারে না। একইভাবে হিংসা এবং ইমানও কোনো বান্দার মাঝে একত্রে থাকতে পারে না।’ (নাসায়ি) বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, ‘তোমরা হিংসা থেকে বেঁচে থাক। কারণ হিংসা দীন ধ্বংস করে দেয়।’ (তিরমিযি)

ইগো নিয়ে বিখ্যাত এক লেখকের কথা। বেস্ট সেলার লেখক রায়ান হলিডের বিখ্যাত বই ‘Ego is the Enemy’ এর আলোকে জেনে নেওয়া যাক কেন ইগো আপনার উন্নতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় শত্রু আর কীভাবেই বা এর থেকে বাঁচা যায়। রায়ান হলিডে একাধারে একজন লেখক, মার্কেটিং বিশেষজ্ঞ এবং সফল উদ্যোক্তা। তিনি Forbes, Huffington Post, The uardianসহ অনেক বিখ্যাত পত্রিকার নিয়মিত কলামিস্ট। Ego is the Enemy ছাড়াও তাঁর আরো কয়েকটি বই ‘The obstacle is the way’, ‘rowth hacker marketing and trust me’, ‘I am lying’ বেশ কয়েকটি টপ চার্টে বেস্ট সেলিং।

ইগোর অনেকগুলো প্রচলিত সংজ্ঞা আছে। তবে রায়ান হলিডের মতে ইগো হচ্ছে ‘নিজের বড়ত্বের প্রতি একটি অস্বাভাবিক বিশ্বাস। যার সাথে মিশে থাকে অতি অহঙ্কার এবং আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর উচ্চাকাঙ্ক্ষা।’ লেখকের মতে, আমরা সবাই জানি ইগো একটি খারাপ জিনিস এবং এটা আমাদের সবার মাঝেই কিছু না কিছু মাত্রায় আছে। আর সেজন্যই এটা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বও আমাদের। ইগো কীভাবে আপনার জীবনকে খারাপ বা ভালো দিকে নিয়ে যেতে পারে, বইয়ে লেখক তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। নিজের প্রতি অস্বাভাবিক ও অবাস্তব উঁচু ধারণা একজন মানুষের সাফল্যের যাত্রাকে পুরোপুরি থামিয়ে দিতে পারে। ইগো আসলে মানুষের মাঝে বাস করা ছোট্ট শয়তানের মতো। একজন মানুষ আসলে যতটা বড়, তাকে তারচেয়েও অনেক বড় হিসেবে ভাবতে শেখায়।

আপনার মাঝে বড় হবার সম্ভাবনা আছে। কাজ করলে আপনি আসলেই অনেক বড় হতে পারবেন। এটা আত্মবিশ্বাস। কিন্তু আত্মবিশ্বাসী মানুষ এটাও জানে যে, তার বর্তমান অবস্থা কি। সে যতটা বড় হতে চায়, ততটা বড় হতে হলে তাকে আরো কতটা কাজ করতে হবে সেটা সে খুব ভালো করে জানে। তবে যার মাঝে ইগো আছে, সে সত্যিকার বড় হওয়ার আগেই নিজেকে বড় ভাবতে শুরু করে। তার এই ভাবনা তাকে সত্যিকার বড় হওয়ার পথে এগুতে বাধা দেয়। কারণটা খুব স্বাভাবিক। আপনি যদি আগেই ভেবে বসে থাকেন আপনি ইতোমধ্যেই অনেক বড় কিছু করে ফেলেছেন, তবে আর সত্যিকার বড় কিছু করার জন্য কষ্ট করার দরকার মনে করবেন না। এই ভাবনাটা যেনো আজকাল আমাদের রন্ধে রন্ধে প্রবেশ করে ফেলেছে। ইগো আমাদের সাথে এই খেলাটাই খেলে। ইগোসম্পন্ন মানুষ তার মিথ্যা অহঙ্কার নিয়ে বসে থাকে। আর অন্যরা তাকে টপকে সত্যিকারের বড় হয়ে ওঠে। এর বাস্তব নমুনা সমাজের প্রায় প্রতিটা চিত্রে পাওয়া যায়।

আবার অনেক মানুষ কিছুটা সফলতা পেয়েই নিজেকে অনেক বড় ভাবতে শুরু করে। তারা মনে করে তাদের আর প্রমাণ করার কিছু নেই। এই কারণে তারা সামনে চলা আর পরিশ্রম করা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু তারা বুঝতেও পারে না যে, এই ভুল ধারণাটি না থাকলে তারা আরো অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারত। অথবা বুঝলেও সেই সর্বনাশা ইগোর কারণে স্বীকার করতে চায় না। একজন মানুষের মধ্যে যে প্রবল ইগো সমস্যা আছে তার একটি প্রধান লক্ষণ তারা ভুল করেও ভুল স্বীকার করতে চায় না। অনেক সময়ে ভুল বুঝতে পারলেও তারা তা স্বীকার করে না। সেই অস্বীকার যেমন অন্যদের কাছে করে, তেমনি তাদের নিজেদের কাছেও করে। আর ভুল স্বীকার না করলে সেই ভুল শোধরানোও অসম্ভব। একজন ইগোসম্পন্ন মানুষের যদি ইংরেজি গ্রামারে সমস্যা থাকে এবং আপনি যদি তাকে সেটা ধরিয়ে দিতে যান, তাহলে সে আপনারই ওপর রাগ করবে। পরীক্ষায় নম্বর কম পেলে সেটা হবে শিক্ষকের দোষ। কিন্তু নিজের জ্ঞান বাড়ানোর কোনো চেষ্টা সে করবে না।

ইগোসম্পন্ন মানুষদের আরো একটি ব্যাপার। তারা নিজেরা যতটুকু জানে, তার তুলনায় বেশি জ্ঞানী বলে নিজেদের জাহির করতে চায়। সোজা বাংলায় এরা সব সময়ে ‘দুই লাইন বেশি বোঝে’। আপনি যদি মনে করেন, তারা শুধু অন্যদেরকে বিশ্বাস করাতে চায় যে, তারা বেশি জানে, তাহলে ভুল করবেন। এরা আসলে নিজেরাও বিশ্বাস করে যে, তারা যে কোনো বিষয়ে সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী। কোনো একটি বিষয়ে অল্প একটু ঘাঁটাঘাঁটি করেই ধরে নেয়, তারা আসলে অনেক কিছু জেনে ফেলেছে। আর এই বিশ্বাস তাদেরকে যে কোনো ব্যাপারেই খুব বেশি জানার আগেই জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।

একজন ইগোসম্পন্ন মানুষকে আপনি কখনো যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারবেন না। তারা কখনো তর্কে হার মানবে না। তারা যদি বোঝেও যে তাদের তুলনায় তাদের সামনের মানুষটির কথা বেশি যুক্তিসঙ্গত ও প্রমাণিত, তারপরও তারা মানবে না। গ্রাম্য ভাষায় একটা কথা বলে, খালি কলস বাজে বেশি। ঠিক তদ্রূপ এই চিত্রটা আমরাও দেখতে পাই। ইগোর দ্বারা একজন অসুস্থ মানুষ ব্যর্থ হলেও সেই ব্যর্থতা থেকে না শিখে সব সময় পরিস্থিতি বা অন্য মানুষের ওপরে দোষ চাপাতে ভালোবাসে। তারা কখনো নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে না, তাদের কোথায় গলদ আছে। এর কারণ, তারা একটি ঘরের মাঝে থাকে। তারা ভাবে তাদের মধ্যে কোনো খুঁত নেই এবং সেই কারণে তারা কোনোভাবেই ভুল করতে পারে না।

ইগো থেকে মুক্তি পেতে করণীয়

১. অন্যের তুলনায় নিজেকে মহান কিছু ভাবা যাবে না। ২. আমি-ই সব কিছু জানি বা বুঝি এই প্রবণতা সারা জীবিনের জন্য দূর করতে হবে। ৩. অন্যের সাথে ঈর্ষা করে চলা যাবে না। ৪. নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী কথা বলার চেষ্টা করা। ৫. যে ব্যাপারে কোনো আইডিয়া নেই, সেই ব্যাপারগুলোকে উপেক্ষা করে চলা এবং উহ্যভাবে তা জানার চেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত রাখা।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক