ঢাকা : শৈশবে রেসলিং দেখেননি, এ যুগের মানুষের মধ্যে তা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ক্রিকেট-ফুটবলের পাশাপাশি দ্য রক, স্টিভ অস্টিন, আন্ডারটেকারদের মতো রেসলারদের দেখে বড় হয়ে উঠেছেন অনেক বাঙালি। তাদের অনেকের প্রিয় তারকাও ছিলেন ‘দ্য রক’। কারোর বা প্রিয় ছিলেন ‘দ্য আন্ডারটেকার’।
তবে ‘দ্য রক’ খ্যাত ডোয়াইন জনসন ও ‘দ্য আন্ডারটেকার’ নামে খ্যাত মার্ক উইলিয়াম কালাওয়েকে ভবিষ্যতে আর রেসলিংয়ের রিংয়ে দেখা যাবে না। ডব্লিউডব্লিউই থেকে শেষ হতে যাওয়া ২০২০ সালে এই দুই কিংবদন্তি আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নিয়েছেন।
গত আগস্টে ডব্লিউডব্লিউই-তে দ্য রকের শেষ শোডাউনটি ছিল আরেক বিখ্যাত রেসলার জন সিনার সঙ্গে রেসলম্যানিয়া ২৯-এ। অবশ্য রেসলম্যানিয়া ৩২-এ এসে তিনি বিদায়ের কথা জানান। এদিন ওয়াট ব্রাদার্সের এরিক রাওয়ানকে মাত্র ৬ সেকেন্ডে হারিয়ে দেন। দ্য রক অফিসিয়ালি ডব্লিউডব্লিউই থেকে অবসর নেন ৪ আগস্ট। এর আগে ‘নিঃশব্দে অবসর নিয়েছিলেন’ রিং থেকে, বলেননি একেবারে বিদায় নিচ্ছেন। তবে এবার প্রথমবারের মতো দ্য রক প্রকাশ্যে আনুষ্ঠানিকাভাবে রেসলিং থেকে অবসর নেন।
অবসরের সময় ডব্লিউডব্লিউই আটবারের চ্যাম্পিয়ন দ্য রক বলেন, ‘আমি নিঃশব্দে রেসলিং থেকে অবসর নিয়েছিলাম কারণ চমৎকার একটি ক্যারিয়ার ছিল এবং যেভাবে আমি শেষ করতে চেয়েছি সেভাবেই আমি শেষ করেছি। কিন্তু এই জনতা, এই দর্শক, এই মাইক্রোফোনের মতো আর কিছুই নেই। আমি রেসলিং মিস করবো, আমি রেসলিং ভালোবাসি।’
বর্তমানে ৪৭ বছর বয়সী এই কিংবদন্তি রেসলার হলিউডের সিনেমায় নাম লেখানোর পর থেকে তাকে কালেভদ্রে রেসলিংয়ের রিংয়ে দেখা যেতো। ডোয়াইন জনসন নামে তিনি অনেক উল্লেখযোগ্য সিনেমাও করেছেন।
২০১৯ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিনের প্রকাশিত তালিকায় সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক প্রাপ্ত অভিনেতাদের মধ্যে শীর্ষস্থান দখল করেন ‘দ্য রক’। তার বার্ষিক আয় ১২৪ মিলিয়ন ডলার।
এর আগে প্রায় তিন দশক পেশাদার রেসলিং রিংয়ে রাজত্বের পর অবশেষে চলতি বছরের জুনে সুদীর্ঘ ক্যারিয়ারের ইতি টেনে ওয়ার্ল্ড রেসলিং এন্টারটেইনমেন্টে (ডব্লিউডব্লিউই)-কে বিদায় জানান ‘দ্য আন্ডারটেকার’।
দীর্ঘ ৩০ বছরের কেরিয়ারে বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজও সমান জনপ্রিয় তিনি।
নিজের তথ্যচিত্র 'দ্য লাস্ট রাইড' এর শেষ এপিসোডে আন্ডারটেকার বলছেন, কখনও বিদায় বলা উচিৎ নয়। কিন্তু আমার আর রিংয়ে ফেরার কোনো ইচ্ছা নেই। আমার বোধ হয় এবার সত্যিই বিদায় নেয়ার সময় এসে গিয়েছে।
এর কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, আমার আর কিছু পেতে বাকি নেই। এমন কোনো সাফল্য নেই, যা অধরা। খেলাটা অনেক বদলে গিয়েছে। এখন নতুনদের আগমনের সময়।
জনপ্রিয় রেসলার লুক হারপারের চিরবিদায় : অপ্রত্যাশিতভাবে সবাইকে ছেড়ে গত শনিবার না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন দর্শকপ্রিয় রেসলিং তারকা ‘লুক হারপার’। তার বয়স হয়েছিল ৪১ বছর। দীর্ঘদিন ফুসফুসের সমস্যায় ভুগছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের এ রেসলার। রেসলিংয়ের বাইরে লুক হারপারের পরিচিতি ছিল জন হুবার নামে। আরেক রেসলিং সংস্থা অল-এলিট রেসলিংয়ে (এইডব্লিউ) খেলতেন ব্রডি লি নামে।
হারপারের স্ত্রী অ্যামান্ডা হুবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইনস্টাগ্রামে একটি পোস্ট করে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। নিজের পোস্টে অ্যামান্ডা লিখেছেন, ‘আমি এসব কথা লিখতে চাইনি কখনও। আমার হৃদয় আজ ক্ষতবিক্ষত। আমার মনে এখন কী চলছে, সেটি বোঝানোর সামর্থ্য কোনো শব্দের নেই। ও ওর প্রিয়জনদের পাশে রেখেই ওপারে পাড়ি জমিয়েছে। গোটা বিশ্ব তাকে লুক হারপার কিংবা ব্রোডি নামে চিনলেও সে ছিল আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু, আমার স্বামী, ওর চেয়ে ভালো বাবা আর কেউ হতে পারবে না।’
প্রামাণ্যচিত্র ভিত্তিক ডব্লিউডব্লিউই-তে হারপার ওয়্যাট ফ্যামিলির লুক রোয়ানকে (জোসেফ রুড) নিয়ে জিতেছিলেন এনএক্সটি ট্যাগ টিম চ্যাম্পিয়নশিপ। বিশ্বখ্যাত রেসলার র্যান্ডি অরটনের সঙ্গে জুটি বেঁধেও জিতেছিলেন ডব্লিউডব্লিউই ট্যাগ টিম চ্যাম্পিয়নশিপ। ডলফ জিগলারকে (নিক নেমেথ) হারিয়ে একবার ইন্টারকন্টিনেন্টাল চ্যাম্পিয়নও হয়েছিলেন এই তারকা।
নিউইয়র্কের বাসিন্দা লুক হারপার ২০১২ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত লুক হারপার নামে রেসলিং করেছেন ডব্লিউডব্লিউইতে। দ্য ওয়েট ফ্যামিলির হয়ে দারুণ খ্যাতি কুড়ান। গত ডিসেম্বরে ডব্লিউডব্লিউই ছেড়ে চুক্তিবদ্ধ হন এইডব্লিউয়ের সঙ্গে। যেখান গত মার্চে হয় অভিষেক। এইডব্লিউডব্লিউইতেও ভীষণ প্রশংসিত হন তিনি, যেখানে তার পরিচিতি ছিল ব্রডি লি নামে। গত অক্টোবরে কোডি রডসের সঙ্গে তার লড়াইকে বলা হয় এইডব্লিউ ইতিহাসে অন্যতম লড়াই।
র্যান্ডি অরটন, ক্রিস জেরিকো, ট্রিপল এইচ, কোডি রোডস থেকে শুরু করে ব্রেই ওয়্যাট, ড্র ম্যাকিন্টায়ার, ড্যানিয়েল ব্রায়ান, ভিন্স ম্যাকমাহনসহ রেসলিং জগতের অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন এই তারকার প্রতি। তার মৃত্যুতে সহকর্মীরা সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেছেন।
বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়ে কিংবদন্তি খাবিবের আকস্মিক অবসর : মিক্সড মার্শাল আর্টে খাবিব আব্দুলমানাপোভিচ নুরমাগোমেদভ এক কিংবদন্তি নাম। জীবনে ২৯ ম্যাচ খেলে কখনই হারের মুখ দেখেননি। আল্টিমেট ফাইটিং চ্যাম্পিয়নশিপ (ইউএফসি)তেও অপরাজিত খাবিব। এখানে খেলা ১৩ ম্যাচের সবকটিই জিতেছেন। রাশান এই মিক্সড মার্শাল আর্ট তারকা খেলতেন লাইটওয়েট শ্রেণিতে।
আল্টিমেট ফাইটিং চ্যাম্পিয়নশিপ (ইউএফসি) ক্যারিয়ারের পুরো সময়টায় তিনি চ্যাম্পিয়ন। ফাইট ম্যাট্রিক্সের র্যাংকিং অনুযায়ী, লাইটওয়েট শ্রেণির সর্বকালের দ্বিতীয় সেরা মার্শাল আর্টিস্ট খাবিব নুরমাগোমেদভ। কারো কারো মতে, তিনিই সর্বকালের সেরা।
৩২ বছর বয়েসী এই ইউএফসি তারকা খেলা চালিয়ে যেতে পারতেন আরও। কিন্তু জীবনের শেষ ম্যাচ জিতে হুট করেই অবসর নিয়ে নেন তিনি।
এই রুশ তারকার বাবা আব্দুলমানাপোভিচ গত জুলাই মাসে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান । বাবা ছিলেন তার কোচও। তার সবগুলো ম্যাচে রিংয়ের বাইরে উপস্থিত থাকতেন তিনি। বাবাকে হারানোর পর তাই মুষড়ে পড়েন খাবিব। তার মা বলেছিলেন আর খেলা চালিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। মাকে কথা দিয়েছিলেন সেটাই হবে। গত ২৫ আগস্ট আবুধাবিতে জাস্টিন গেইটজেকে হারিয়ে দিয়ে জানিয়ে দেন নিজের বিদায়ের কথা।
বিদায় বেলায় আবেগময় বার্তায় খাবিব জানান মাকে দেয়া কথা রেখেছেন তিনি, ‘ইউএফসিতে আমি অবিসংবাদিত, অপরাজিত থেকে রেকর্ড ১৩-০ বারের চ্যাম্পিয়ন। আর এমএমএতে ২৯ লড়াই ধরে অপরাজিত।
আজ আমি বলতে চাই– এটিই আমার শেষ লড়াই। আমি আমার বাবাকে ছাড়া আর এখানে আসতে চাই না। আমি এই পর্যন্ত আসতেই পারতাম না যদি না আমার বাবা থাকতেন। এই ম্যাচটা যখন এলো আমি আমার মার সঙ্গে তিনদিন ধরে কথা বলেছি। তিনি চাননি বাবাকে ছাড়া আমি আর খেলি। আমি তাকে বলেছিলাম এটাই আমার শেষ ম্যাচ। আমি তাকে কথা দিয়েছিলাম।’
প্রতিপক্ষ জাস্টিনকেও ধন্যবাদ দেন খাবিব, ‘অনেক ধন্যবাদ জাস্টিন। আমি জানি তুমি সেরা। সবার প্রতি খেয়াল রাখ। বাবা-মায়ের পাশে থেকো। কারণ তুমি জানো না কাল কি হবে। ধন্যবাদ সবাইকে।’
খাবিব প্রথম মুসলিম অ্যাথলেট, যিনি ইউএফসি শিরোপা জিতেছেন। সৃষ্টিকর্তার উপর অগাধ আস্থা এই কিংবদন্তি তার শেষ ম্যাচের পর আবেগে ভেসে গিয়ে বলেছিলেন- ‘যখন আল্লাহ তোমার সাথে থাকে, পৃথিবীর কেউ তোমাকে কখনো হারাতে পারবে না। তোমার এটি বিশ্বাস করতে হবে।’
ম্যাচ শেষে জানা যায়, পায়ের তিনটি ভাঙ্গা হাড় নিয়ে খেলেছেন খাবিব! ইউএফসি প্রেসিডেন্ট ডানা হোয়াইট ম্যাচশেষে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সে হাসপাতালে ছিল। তিন সপ্তাহ আগে তার পা ভেঙে যায়। তার পায়ের তিনটি হাড় ছিল ভাঙা। এটি কেউই জানতো না।
কিন্তু সে এই পৃথিবীর সবচেয়ে দৃঢ়চেতা মানুষ এবং আপনি যদি সর্বকালের সেরা অ্যাথলেটদের তালিকা করতে চান, তাকে সবার উপরে রাখতেই হবে।
খাবিবের অবসরের ঘোষণা পুরো বিশ্বকে নাড়িয়ে দেয়। বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের অন্যতম আলোচিত এই তারকার অবসরের ঘোষণায় কষ্ট পান অন্যান্য তারকারাও। বাংলাদেশ দলের টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদসহ বিশ্ব ক্রিকেটের অনেক তারকারা ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ জেতায় খাবিবকে অভিনন্দন জানান।
সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, লিভারপুলের মিশরীয় তারকা মোহামেদ সালাহ, জার্মানির বিশ্বকাপজয়ী তারকা মেসুত ওজিলও তাকে জানিয়েছিলেন পূর্ণ সমর্থন।
সোনালীনিউজ/এমটিআই