টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির পেছনে অবদান রেখেছেন যারা

  • ক্রীড়া ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মার্চ ১৪, ২০১৭, ০১:১০ পিএম

ঢাকা : ভারতের বিপক্ষে ২০০০ সালের ১০ ডিসেম্বরে ম্যাচ দিয়ে টেস্ট আঙ্গিনায় পথ চলা শুরু বাংলাদেশের। এরপর গেল ১৭ বছরে ৯৯টি টেস্ট খেলেছে টাইগাররা। তাই আর একটি টেস্ট খেললেই শততম ম্যাচ খেলার মাইলফলক অর্জন করবে বাংলাদেশ। সেই মাইলফলকে আগামী ১৫ মার্চ পা রাখতে যাচ্ছে টাইগাররা। কলম্বোতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টটি হবে বাংলাদেশের শততম ম্যাচ।

২০০০ সালের ২৬ জুনে নয়টি টেষ্ট খেলুড়ে দেশের সমর্থনে টেস্ট ক্রিকেটের অভিজাত ক্লাবে দশম সদস্য হিসেবে যোগ দেয় বাংলাদেশ। ইংল্যান্ডের লর্ডসে আর্ন্তজাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) বোর্ড সভায় তৎকালীন সভাপতি ম্যালকম গ্রে বাংলাদেশকে পূর্ণ মর্যাদার টেস্ট খেলুড়ে দেশের খেতাব দেয়।

লর্ডসের খুশির খবর দেশে পৌঁছাতে বেশী সময় লাগে নি। টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার খবরে উল্লাসে মাতা জনতার মিছিল তখন ঢাকার রাস্তায় রাস্তায়। কিন্তু ২০০০ সালের টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির পেছনে ছিল অনেক কূটনৈতিক যুদ্ধ আর মাঠের বুক চিতিয়ে দেয়া পারফর্মেন্স।

নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে দেশের ক্রিকেট যখন মৃতপ্রায় অবস্থা, সেখান থেকে পাঁচ বছরের ব্যবধানে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সম্মান পাওয়া মুখের কথা না। নব্বই দশকের দিকে ক্রিকেট বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ছিল না। ফুটবলের অবস্থা তখন জমজমাট।

কিন্তু একজন দূরদর্শী মানুষ তখনকার প্রেক্ষাপটে অবাস্তব স্বপ্ন দেখেছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে। সাবেক বোর্ড প্রেসিডেন্ট সাবের হোসেন চৌধুরীর কথা বলছিলাম। ১৯৯৬ সালে সাবের হোসেন বিসিবির দায়িত্ব নেয়ার পর মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে টেষ্ট স্ট্যাটাস অর্জনের লক্ষ্য স্থির করেছিল বোর্ড।

যেটা তখন এককথায় অসম্ভব ছিল। একের পর এক আইসিসি ট্রফি হারতে থাকা বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে বেশী দূর চিন্তা করার মত লোক খুজে পাওয়া দুস্কর ছিল। কিন্তু সাবের হোসেন স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং সেটা বাস্তবের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।

ক্রিকইনফোকে সাবের হোসেন জানান, ‘আমাদের অবিশ্বাস্য কিছু করতে হতো। আমরা পাঁচ বছরের পরিকল্পনা নিয়েছিলাম। সহযোগী দেশ হলেও শীর্ষে পৌঁছানোর স্বপ্ন ছিল আমার। জিম্বাবুয়ে টেস্ট স্ট্যাটাস চাওয়ার আগে তিনবার আইসিসি ট্রফি জিতেছিল। টেস্ট স্ট্যাটাস না পেলে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট মারা যেত।’

বাংলাদেশের প্রথম লক্ষ্য ছিল আইসিসি ট্রফি জয়, বিশ্বকাপের টিকেট অর্জন করার জন্য ৯৭’র আইসিসি ট্রফিতে বড় কিছু করা আবশ্যক ছিল। ৯৭’র আইসিসি ট্রফি জয়ের পর বিশ্ব ক্রিকেট কর্তাদের বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস নিয়ে কথা বলেন তৎকালীন বোর্ড সভাপতি। একই বছরের জুন মাসে টেস্ট স্ট্যাটাসের জন্য আবেদন করে বিসিবি।

‘যেই মুহূর্তে আমরা চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জয় করেছিলাম… ঠিক তখনই ডেভিড রিচার্ডকে আমি বলেছিলাম, আমরা টেস্ট স্ট্যাটাস নিয়ে কথা বলতে চাই। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি শুনছি’।, বললেন সাবের হোসেন। ৯৭ সালে ওয়ানডে স্ট্যাটাস প্রাপ্তির পর বিসিবির প্রধান লক্ষ্য ছিল ঘরের মাঠে বড় আসর আয়োজন করা। আইসিসি নক আউট টুর্নামেন্টের পর ইন্ডিপেনডেন্ড কাপ ও এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ছিল তারই ফলাফল। সাবেক হোসেন জানতেন, শুধু মাঠের পারফর্মেন্স কখনই টেস্ট স্ট্যাটাস এনে দিবে না।

বাংলাদেশের টেষ্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় লড়াই করেছে ক্রিকেটাররা। ৯৯’র বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ড এবং পাকিস্তানের বিপক্ষে জয় তুলে ক্রিকেট বিশ্বে নিজেদের অবস্থান জানান দেয় বাংলাদেশ। সেই টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির তাড়না বাংলাদেশের মাঠের পারফর্মেন্সে স্পষ্ট হয়।

সাবের হোসেন আইসিসি মিটিংয়ে ভোটাভুটির খেলায় জয় নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। তবে তৎকালীন আইসিসি চিফ জাগমোহন ডালমিয়া ভোটের ব্যাপারে সাহায্য করেছিলেন। তিনি এশিয়ার মধ্যে ভারত, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের ভোটের ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন।

জিম্বাবুয়ের সাথে বিসিবির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকায় আরেকটি ভোট নিতে সমস্যা হয় নি। ৯৯’র দিকে ইয়ান বিশপের নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল বাংলাদেশে সফরে আসলে বাংলাদেশের পারফর্মেন্সে মুগ্ধ হন। কূটনীতিক চালে বাংলাদেশের ক্রিকেট কর্তারা ওয়েস্ট ইন্ডিজকেও রাজি করাতে সক্ষম হয়।

তবে সাবের হোসেনের জন্য বড় পরীক্ষা ছিল ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিন আফ্রিকা। এই তিন দেশের ভোট জয় করা সহজ ছিল না সাবেরের জন্য। কিন্তু ইংল্যান্ড নিয়ে নিশ্চিত না থাকলেও অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিন আফ্রিকার ভোট পাওয়ার বিষয়টি আগেই নিশ্চিত করেছিলেন সাবের হোসেন।

তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেক কূটনীতিক চাল চালতে হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ছিল অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিন আফ্রিকা সফর। আমরা জানতাম এশিয়ার দেশ গুলো ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ, জিম্বাবুয়ে থেকে আমরা সাহায্য পাবো। কিন্তু ইংল্যান্ড নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। তবে আমি কিছু চুক্তি করতে পারেছিলাম ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডের সাথে। আমাদের ক্রিকেটীয় সামর্থ্য কম থাকলেও কূটনীতিক খেলায় আমরা পুষিয়ে দিয়েছি।’

আইসিসি বোর্ড মিটিংয়ে অবশ্য সব ভোটই পক্ষে পেয়েছিল বাংলাদেশ। বোর্ড মিটিংয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে সাবের হোসেন বলেন, ‘আমরা ৪৫ মিনিটের প্রেজেন্টেশন দিয়েছিলাম বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটে সম্ভাবনা নিয়ে। শেষে প্রশ্ন উত্তর পর্ব ছিল। বাকিটা নির্ভর করছিল ভোটের উপর। আমাদের লক্ষ্য ছিল সাতটি ভোট। শেষে আমরা নয়টি ভোটই পেয়েছিলাম।

এটা বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভবিষ্যতের জন্য বড় প্রেরনা ছিল। অন্যান্য সহযোগী দেশ গুলোও সন্তুষ্ট ছিল আমাদের উন্নতিতে। আমাদের পথটা সহজ ছিল না। আমাদের সফর করার জন্য পরিবহন খরচও ছিল না। কিন্তু দলগত সাফল্যের কারনে আমরা কঠিন পথ পার করতে পেরেছি। ক্রিকেট বাংলাদেশের জন্য খেলার চেয়েও বেশী কিছু ছিল।

৭১ এর স্বাধীনতার পর ৯৭’র চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে পুরো দেশ এক হয়েছিল। মিটিং শেষে আমি প্রধান মন্ত্রীর সাথে কথা বলেছিলাম। আমার পরিবারের সাথে কথা বলেছিলাম। আমিনুল ইসলাম বুলবুল আমাদের জন্য বাইরে অপেক্ষা করছিল। আমরা ম্যালকম গ্রে’র সাথে সংবাদ সম্মেলন করেছিলাম। আমি চেষ্টা করেছিলাম আমার অনুভূতি শব্দে প্রকাশ করতে। আমার জীবনের সেরা মুহূর্ত ছিল সেটা।’

বাংলাদেশে ক্রিকেটের তুমুল জনপ্রিয়তা এতো দ্রুত টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির আরেকটি কারন। তবে বাংলাদেশে টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির প্রথম শর্ত প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট না থাকায় কাজটি সহজ ছিল না। তবে মাঠের বাইরে সাবের হোসেনের কূটনীতিক পারফর্মেন্স বাংলাদেশকে অসম্ভব সাধন করতে সাহায্য করে।

বাংলাদেশ দল বুধবার (১৫ মার্চ) শততম টেস্ট খেলতে নামবে। শুরুর দিকে ছন্নছাড়া সেই বাংলাদেশ দল এখন অনেক পরিণত। ধীরে ধীরে টেস্ট ক্রিকেটে নিজেদের পায়ের তোলার মাটি শক্ত হওয়া বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাস লিখতে গেলে সবার আগে পর্দার আড়ালের নায়ক সাবের হোসেনের নাম স্মরণ করতেই হয়। সূত্র : ক্রিকইনফো

সোনালীনিউজ/এমটিআই