ঢাকা : কালের পরিক্রমায় বিদায় নিল আরও একটি বছর। জীর্ণ ঝরাপাতার মতো ঝরে যাবে বিদায়ী বছরের ক্যালেন্ডারের পাতাও। শুরু হয়েছে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব-নিকাশ। এ বছরে কি অর্জন করতে পেরেছি এবং কি পারিনি তার হিসাব মিলাতে ব্যস্ত। হিসাব-নিকাশের আয়নায় পেছন ফেরে দেখা হচ্ছে দেশের ফুটবল-অর্জনও। আসুন দেখে নেয়া যাক কেমন ছিল লাল-সবুজের ফুটবল।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশের জাতীয় ফুটবল দল ছিল গভির ঘুমে আচ্ছন্ন। ফিফা অথবা এএফসি, কোনো পর্যায়ের ম্যাচেই মাঠে নামেননি মামুনুল-এমিলিরা। যে কারণে ফিফা র্যাংকিংয়ে ডাবল সেঞ্চুরির দ্বারপ্রান্তে রয়েছে লাল সবুজের ফুটবল। ইতিহাসে সর্বনিম্ন র্যাংকিং ১৯৭-এ পৌঁছেছে দলটি। তবে সাফল্য এনে দিয়েছে বয়সভিত্তিক নারী ও পুরুষ ফুটবল দলগুলো।
জাতীয় দল
গেল বছর বাংলাদেশের জাতীয় ফুটবল দল বলতে গেলে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। জাতীয় দল নিয়ে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) কোন পরিকল্পনাও চোখে পড়েনি। যদিও ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে চার বছর মেয়াদী ক্যালেন্ডার প্রণয়ন করেছিলো বাফুফে। তবে বছর জুড়ে ক্যালেন্ডারের সঙ্গে টুর্নামেন্টের ছিলো বিস্তর পার্থক্য। বঙ্গবন্ধু গোল্ড কাপ আয়োজন করতেও ব্যর্থ হয়েছে তারা। এই টুর্নামেন্টটা হলে অন্তত কয়েকটি ম্যাচ খেলতে পারত জাতীয় দল।
অথচ ২০১৪ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত মামুনুলরা আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছে মোট ৩৬টি। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে চারটি করে প্রীতি ম্যাচ খেলা হয়েছে, ২০১৬ সালেও তারা খেলেছে দু’টি প্রীতি ম্যাচ। ২০১৭ বছরটি ফিফা র্যাংকিং ১৯৭-এ থেকে শেষ করেছে দলটি। লজ্জার ‘ডাবল সেঞ্চুরি’ থেকে রক্ষা!
২০১৭ সালটি বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের জন্য ছিল পুরোপুরি হতাশাময় কাটলেও নতুন বছরে ভাল কিছুর অপেক্ষায় লাল সবুজের দল। সূচি অনুযায়ী, ২৩ মার্চ কম্বোডিয়া জাতীয় দল ঢাকায় খেলতে পারে। আর ২৭ মার্চ বাংলাদেশ খেলতে পারে ব্রুনাইয়ে। এর ফলে ছয় মাস আগে জাতীয় দলের কোচ হওয়া অ্যান্ডু ওর্ডের ডাগআউটে নামবার অপেক্ষারও অবসান হবে। গত বছরের জুনে অনেক জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অস্ট্রেলিয়ান কোচ এন্ড্রু অর্ডের সঙ্গে চুক্তি করে বাফুফে।
বয়সভিত্তিক দলগুলোর সাফল্য : জাতীয় দলের শূণ্যতায় বয়সভিত্তিক ফুটবলে ছেলে ও মেয়েরা কিন্তু সাফল্য কুড়িয়ে দেশের জন্য সুনাম বয়ে এনেছে। শিরোপা জিততে না পারলেও বিশ্ব দরবারে নিজেদের ঠিকই চিনিয়েছে কিশোররা। যার বড় সাফল্য এসেছে থিম্পুতে। সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ ফুটবলে শক্তিশালী ভারতের বিপক্ষে ৫৪ মিনিট পর্যন্ত ৩-০ গোলে পিছিয়ে থাকার পরও শেষ পর্যন্ত ৪-৩ ব্যবধানে জয় ছিনিয়ে এনেছে বাংলাদেশের যুবারা। চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও টুর্নামেন্টের রানারআপ ট্রফি নিয়ে ফিরেছে লাল সবুজের ছেলেরা। পাশাপাশি টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার আদায়ও করেছে তারা। তার আগে আগস্টে নেপালে অনুষ্ঠিত সাফ অনুর্ধ্ব ১৫ টুর্নামেন্টে ভুটানকে ৮-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে তৃতীয় হয় বাংলাদেশের ছেলেরা।
ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে মেয়েরা। মারিয়া-শামসুন্নাহারদের জন্য বছরটি ছিল সোনায় মোড়ানো। সাফল্য দিয়েই ২০১৭ সালে যাত্রা শুরু করেছিল বাংলাদেশের ফুটবল কন্যারা। জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সাফ ওমেন চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপার নিকটে গিয়েও শেষ অবধি ভারতের কাছে হেরে রানার্স আপ হয় সাবিনা-কৃঞ্চারা। শিরোপা না পেলেও প্রথমবারের মতো সাফের রানার্স আপ হতে পারাটা ছিলো মেয়েদের জন্য কৃতিত্বের।
সেপ্টেম্বরে মেয়েরা অংশ নেয় এএফসি অনুর্ধ ১৬ চ্যাম্পিনশীপে। জাপান, অস্ট্রেলিয়া আর উত্তর কোরিয়ার মতো বাঘা বাঘা দলের সঙ্গে পেরে না উঠলেও সেখানে মাহমুদা-কৃষ্ণাদের পারফরম্যান্স হয়েছে প্রশংসিত। এই মেয়েরা ভবিষ্যতে ভালো কিছু করতে পারবে এমন বিশ্বাসে বছর জুড়েই দীর্ঘ মেয়াদী ক্যাম্প এবং দেশের বাইরে ফুটবল ম্যাচ খেলার সুযোগ করে দেয় বাফুফে। যার ফলটা আসে ডিসেম্বরে। সাফ অনুর্ধ্ব ১৫ নারী চ্যাম্পিয়নশীপে অপরাজীত চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জন করে বাংলাদেশের বাঘীনি কন্যারা।
একাদা দেশীয় ফুটবলের যে উজ্জ্বল অতীত ঐতিহ্য ছিল, তা ছেলেরা ফিরিয়ে আনতে না পারলেও মেয়েরা পেরেছে। নিঃসন্দেহে বিষয়টি গৌরবের। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, এই মেয়েদের অধিকাংশ উঠে এসেছে অবহেলিত প্রত্যান্ত অঞ্চল থেকে। তাদের পরিবারগুলো একেবারেই হতদরিদ্র। বলতে গেলে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় এমন অবস্থা। সেখানে বিদ্যালয়সংলগ্ন পর্যাপ্ত খেলার মাঠ নেই, প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও প্রশিক্ষণের প্রকট অভাব সর্বোপরি নিত্যসঙ্গী দারিদ্র্যের কশাঘাত। অনেক অঞ্চলে এখন পর্যন্ত বিদ্যুতও পর্যন্ত পৌঁছেনি। সে অবস্থায় অদম্য ও অপরাজেয় নারী ফুটবলারদের এমন কৃতিত্ব খাটো করে দেখার কোন অবকাশ নেই। এই দলটিকে যথাযথ প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন করানোর ব্যবস্থা করা হলে দেশে ও বিদেশের মাটিতে এরাই একদিন আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে বিজয় গৌরব ও সুনাম ছিনিয়ে আনতে সমর্থ হবে। সোনার মেয়েদের কীর্তিগাথায় মোড়ানো এ রকম আরও স্বর্ণালি সাফল্য নিশ্চয়ই অবলোকন করা যাবে। নতুন বছরে মেয়েদের সেই সাফল্যে ধারা অব্যাহত থাকবে এমন আশা ফুটবল প্রেমীদের।
সোনালীনিউজ/জেডআই/এমটিআই