ঢাকা: কাঠ কাটার ঠকঠক শব্দ ভেসে আসে। ধীরে ধীরে খুলতে থাকে ঘরের দরজা, আর একে একে ৩০টি ঘর থেকে বেরিয়ে আসে গ্রামবাসী। গোসল, ধোয়া-মোছা, আর সকালের অন্যান্য কাজগুলো সেরে সবাই একত্রে হাজির হয় কমিউনাল রান্নাঘরে, সকালের নাশতার জন্য।
এভাবেই ভিয়েতনামের তাই হাই গ্রামে প্রতিদিন সকাল শুরু হয়। গ্রামটিতে ২০০ মানুষ বাস করেন, যাদের জীবনযাত্রা একেবারেই একত্রিত। তারা একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করে যেমন দিন শুরু করেন, তেমনি একসঙ্গে রাতে ঘুমাতে যান। এটি কোনো কল্পনার গল্প নয়, তাই হাই এমনই একটি জীবন্ত গ্রাম।
এই গ্রামে বাসিন্দারা ২২ বছর ধরে একসঙ্গে তিন বেলা খায়। নাশতার পর সবাই নিজের কাজে চলে যায়। কেউ চা-বাগানে কাজ করে, কেউ কাঠের কাজ করে, আবার কেউ ভ্রমণ গাইডের কাজ করে। ভিয়েতনাম এখন আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আকর্ষণীয় গন্তব্য। গ্রামে কেউ মধু সংগ্রহ করে, কেউ চাষবাস বা গরু-মুরগির খামারে কাজ করে, আবার কেউ শিশুদের স্কুলে পাঠিয়ে নিজে কাজ করে।
দুপুরের খাবারের জন্যও একইভাবে ঘণ্টা বাজে, যেমন সকাল বা সন্ধ্যায়। দুপুর ১১টায় কাঠ কাটার শব্দ ভেসে আসে, যখন সবাই একসঙ্গে খেতে বসে। প্রথমে এক প্লেটে খাওয়া হলেও, এখন আলাদা প্লেটে খাবার খাওয়ার প্রচলন হয়েছে। তবে অনেক পরিবার এখনও পুরনো নিয়ম মেনে একসঙ্গে খায়।
সন্ধ্যায়, রাতের খাবারের ঘণ্টা বাজে সন্ধ্যা ৭টায়। দিনের কাজ শেষে সবাই খাবার খেয়ে ঘরে ফিরে যায়, এবং পরিবারের সঙ্গে সময় কাটায়।
গ্রামের বাসিন্দাদের মতে, তাদের জীবনযাত্রা অন্য গ্রামগুলোর চেয়ে আলাদা। এখানে সবাই এক হাঁড়ির খাবার খায় এবং একই খরচে চলে। গ্রামে কাজের দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে প্রত্যেকের কাজ ভাগ হয়ে যায়। গ্রামবাসীর সব আয় গ্রামপ্রধান এবং কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে থাকা তহবিলে জমা হয়, যেখানে খাওয়া-দাওয়া, বিদ্যুৎ, যন্ত্রপাতি, ঘরের মেরামত, পড়াশোনা, চিকিৎসা এবং বিয়ের খরচও সম্পন্ন হয়। এখানে সম্পত্তি বা আয় নিয়ে তুলনা করার কোনো সুযোগ নেই। মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপ কেনার জন্য কাউন্সিলের অনুমতি প্রয়োজন।
[253739]
ভিয়েতনামের তাই হাই গ্রামে এই বিশেষ জীবনযাত্রার সূচনা করেছিলেন ৬৩ বছর বয়সী নগুয়েন থি থান হাই, একজন তাই জাতির নারী। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, তরুণরা ধীরে ধীরে তাদের ঐতিহ্যবাহী কাঠের বাড়ি ও সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। তাই তিনি নিজের জমি বন্ধক রেখে ৩০টি প্রাচীন কাঠের বাড়ি কিনে ২০০৩ সালে ২০ হেক্টর জায়গায় স্থাপন করেন, যেখানে তিনি তাই জাতির সংস্কৃতি রক্ষার জন্য একটি গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমে শুধুমাত্র তার পরিবার এবং তাই সংস্কৃতি প্রেমীরা সেখানে বসবাস শুরু করেন, এরপর ধীরে ধীরে গ্রামের সম্প্রসারণ ঘটে। সবাই মিলে গ্রামে জলপ্রবাহ তৈরি, বিদ্যুৎ সরবরাহ, রাস্তা পাকা করা, এবং বনভূমি তৈরি করেন।
এ সম্মিলিত জীবনযাত্রার সবচেয়ে বড় উপকারিতা পেয়েছে গ্রামের নারীরা। তাদের রান্না নিয়ে চিন্তা করতে হয় না, কারণ গ্রামের মধ্যেই রান্নার ব্যবস্থা রয়েছে। শিশুদের জন্য স্কুল আছে, ফলে তাদের দূরে কোথাও পাঠানোর প্রয়োজন হয় না। বিয়ের সময় পুরো গ্রাম এসে সাহায্য করে। অন্যরা তাদের নিজেদের কাজ ভাগ করে নেয়, যেমন বিক্রি এবং পর্যটকদের দেখভাল করা।
২০১৪ সালে থাই গুয়েন প্রদেশ সরকার এই গ্রামকে আনুষ্ঠানিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করে। প্রথমে গ্রামটি গ্রাম্য পরিবেশ এবং ঐতিহ্যবাহী খাবারের জন্য পর্যটকদের আকর্ষণ করেছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে পর্যটন আরও প্রসারিত হয়েছে। ২০২২ সালে জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থা তাই হাই গ্রামকে বিশ্বের অন্যতম সেরা পর্যটন গ্রাম হিসেবে ঘোষণা করে।
এই গ্রামটি এখনও ঐতিহ্যের মধ্যে জীবন যাপন করে এবং এখানকার পুরনো কাঠের বাড়িগুলো এখনো মানুষের বাসস্থান এবং অতিথিদের থাকার জায়গা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এখানে শিশুরা তাই ভাষায় কথা বলে, দেশীয় খেলনা দিয়ে খেলাধুলা করে এবং লোকসংগীত গায়। এখনকার তরুণরা বিশ্বাস করেন, ‘এক হাঁড়ি, এক পয়সা’ এই দর্শনেই প্রকৃত শান্তি নিহিত। গ্রামটি এখনও অনেক জাতিগোষ্ঠীর মানুষের আকর্ষণ, যারা ঐতিহ্যের মধ্যে সুখের খোঁজে এখানে আসেন।
ইউআর