মধুপুর ফল্টে ভূমিকম্প হলে রাজধানীর সাড়ে ৮ লাখের বেশি ভবন ধসে পড়তে পারে

  • নিউজ ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৬, ২০২৫, ১২:১৮ পিএম

রাজধানী ঢাকায় বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধুপুর ফল্টে ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীর প্রায় ৪০ শতাংশ ভবন—অর্থাৎ সাড়ে ৮ লাখের বেশি ভবন ধসে পড়তে পারে। এতে নিহত হতে পারেন ২ লাখ ১০ হাজার থেকে ৫ লাখ মানুষ। গুরুতর আহত হতে পারেন আরও অন্তত আড়াই লাখের বেশি মানুষ।

এদিকে ভূমিকম্প সহনশীল ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং ভবনগুলোর কাঠামোগত নিরাপত্তা অডিট প্রায় দেড় বছর ধরে আটকে রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ৫৬৮ কোটি টাকার আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের সব প্রস্তুতি শেষ হলেও দায়িত্ব নিয়ে টানাপোড়েন ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার উদাসীনতায় কার্যক্রমটি ফাইলবন্দি হয়ে আছে। 

বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক এবং ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ঢাকাসহ সারা দেশের ভবন বা স্থাপনাগুলো ভূমিকম্প সহনীয় করে গড়ে তুলতে দুটি কাজ করতে হবে। প্রথমত, ভূমিকম্প সহনীয় ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা করা। দ্বিতীয়ত, একটা নির্ধারিত সময় পরপর ভবন বা স্থাপনার কাঠামোগত নিরাপত্তা নিরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

তিনি জানান, রাজউক এলাকার ভূমিকম্প সহনীয় ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা রাজউক করেছে। তবে সেটা রাজউকের মাস্টারপ্ল্যান ড্যাপের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, এটা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি ভবন বা স্থাপনার কাঠামোগত নিরাপত্তা নিরীক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে হবে। এটা বেসরকারি পর্যায়ে করতে হবে। দেশে ইতোমধ্যে বেসরকারি পর্যায়ে অর্ধশত প্রতিষ্ঠান গড় উঠেছে। রানা প্লাজার ঘটনার পর গার্মেন্টসের প্রায় সাড়ে ৩ হাজার ভবনে তার আলোকে ফিটনেস যাচাই করা হয়েছে।

তিনি আরও জানান, রাজউকের আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের আওতায় মহাখালীতে একটি স্টিল স্ট্রাকচারের ভবন করা হয়েছে। সেখানে আধুনিকমানের যন্ত্রপাতিও ক্রয় করা হয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানটি দ্রুত সচল হলে স্ট্রাকচারাল অডিটের কার্যক্রম জোরদার হবে। তবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে খুবই দামি যন্ত্রপাতি কেনা সম্ভব হয়নি, ইতোমধ্যে সরকার প্রায় শতকোটি টাকার যন্ত্রপাতি কিনেছে। সেগুলো বেসরকারি পর্যায়ে ব্যবহার করে কার্যক্রম জোরদার করার সুযোগ রয়েছে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের সাবেক প্রকল্প পরিচালক এবং ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ড. মো. আব্দুল লতিফ হেলালী যুগান্তরকে বলেন, ভূমিকম্প সহনীয় নগর গড়তে একটি উন্নত দেশ হওয়া সত্ত্বেও জাপানের প্রায় ৩০ বছর লেগেছে। সেখানে ঢাকাকে ভূমিকম্প সহনীয় করে গড়ে তুলতে অন্তত ৫০ বছর লাগবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এমন বাস্তবতায় কাজ শুরু করার পর তা আবার বন্ধ করে রাখা হয়েছে।

তিনি বলেন, সরকার ঋণের টাকায় রাজধানীসহ আশপাশের এলাকায় গবেষণা করে ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তা রাজউকের মাস্টারপ্ল্যান ড্যাপে যুক্ত করা হয়নি। পরের ড্যাপের জন্য অপেক্ষা করে থাকলে এরই মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে স্থাপনা গড়ে উঠবে। তাহলে রাজধানী তো আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। তাই ভূমিকম্প সহনীয় ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা এখনই বাস্তবায়ন শুরু করতে হবে। 

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের সাবেক প্রকল্প পরিচালক এবং ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ড. মো. আব্দুল লতিফ হেলালী বলেন, ভূমিকম্প সহনীয় নগর গড়তে একটি উন্নত দেশ হওয়া সত্ত্বেও জাপানের প্রায় ৩০ বছর লেগেছে। সেখানে ঢাকাকে ভূমিকম্প সহনীয় করে গড়ে তুলতে অন্তত ৫০ বছর লাগবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এমন বাস্তবতায় কাজ শুরু করার পর তা আবার বন্ধ করে রাখা হয়েছে।

তিনি বলেন, সরকার ঋণের টাকায় রাজধানীসহ আশপাশের এলাকায় গবেষণা করে ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তা রাজউকের মাস্টারপ্ল্যান ড্যাপে যুক্ত করা হয়নি। পরের ড্যাপের জন্য অপেক্ষা করে থাকলে এরই মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে স্থাপনা গড়ে উঠবে। তাহলে রাজধানী তো আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। তাই ভূমিকম্প সহনীয় ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা এখনই বাস্তবায়ন শুরু করতে হবে।

আটকে থাকা প্রকল্প ও যন্ত্রপাতি

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, রাজউকের আওতায় আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্প শুরু হয় ২০১৫ সালের জুলাইয়ে। বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তায় এ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ২০২৪ সালের জুনে। ইতোমধ্যে প্রায় দেড় বছর পার হয়েছে। ভূমিকম্প ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি কমাতে রাজউকের নেওয়া এ প্রকল্পের পরবর্তী কার্যক্রম রাজউকের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার সুযোগ নেই। কেননা, প্রকল্পের সুপারিশের ভিত্তিতে গঠিত প্রতিষ্ঠানটির কাজের ক্ষেত্র হবে দেশজুড়ে বিস্তৃত। স্বতন্ত্র-স্বাধীন প্রতিষ্ঠান ছাড়া তা করা সম্ভব নয়; কিন্তু তৎকালীন রাজউক ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা সে ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেন। যে কারণে আটকে যায়-প্রকল্পের সুপারিশ বাস্তবায়ন। এ অবস্থায় রাজধানীর মহাখালীতে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত স্টিল স্ট্রাকচারের ১০ তলা ভবন এবং প্রায় শতকোটি টাকা ব্যয়ে কেনা বিশ্বমানের প্রযুক্তিগুলো। তবে ২১ নভেম্বরে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের পর নড়েচড়ে বসেছে রাজউক এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণলায়। সরকারের পক্ষে বলা হচ্ছে, শিগগিরই প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠানের আইন অনুমোদন করা হবে।

তথ্যানুসন্ধানে আরও জানা যায়, ভূমিকম্প সহনীয় স্থাপনা বা ভবন নির্মাণ নিশ্চিতে ক্রয় করা আধুনিক যন্ত্রপাতির মধ্যে রয়েছে-দুটি ২০০ কিলোনিউটন ক্ষমতার ট্র্যাক মাউন্টেড সিটিপি মেশিন, একটি ১২ ইঞ্চির কাটার ক্রেন, ৪০ টন ক্ষমতার ওভারহেড ক্রেন, ৫ টন ক্ষমতার একটি ফর্ক লিফটসহ ২৫ ধরনের ১৫০টি যন্ত্রপাতি। প্রকল্পের সুপারিশের ভিত্তিতে ট্রাস্ট গঠন এবং দেশব্যাপী কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠান করার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

ঢাকার ঝুঁকির চিত্র

রাজউকের জরিপ অনুযায়ী—

১.৫% এলাকা ভূমিকম্পের জন্য অতি ঝুঁকিপূর্ণ, যেখানে কোনো স্থাপনা করা যাবে না।
২৬% এলাকায় উন্নয়ন সীমা নির্ধারণ করতে হবে
১৩% এলাকায় উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ জরুরি
২৯% এলাকায় ঝুঁকি তুলনামূলক কম
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এবং আশপাশের ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকার ওপর জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে।

ঢাকার মোট ভবন এখন ২১ লাখের বেশি। এর মধ্যে ৬ লাখ পাকা স্থাপনা। গবেষণা বলছে—মধুপুর ফল্টে বড় ভূমিকম্প হলে পাকা ভবনের ৭৫ হাজারটি পর্যন্ত ধসে পড়তে পারে। 
রাজউকের অবস্থান

রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রিয়াজুল ইসলাম বলেন, রাজউকের কাজ ভূমিকম্প সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণ নিশ্চিতে কাজ করা। নগরীর ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নানা ব্যত্যয় থাকলেও এখন তা নিশ্চিতে কাজ করা হচ্ছে। বিশেষ করে নতুন করে ট্রাস্ট গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানের আওতায় নগরীর ভবনের ফিটনেস যাচাই-বাছাই করে বিশেষ রং দিয়ে মার্কিং করে দেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, রাজউকের একটি প্রকল্পের আওতায় একটি ভবনসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ক্রয় করা হয়েছে। সেগুলো সবই ওই ট্রাস্টে দিয়ে দেওয়া হবে। পূর্ত সচিব ওই ট্রাস্টের চেয়ারম্যান এবং রাজউক চেয়ারম্যান ওই প্রতিষ্ঠানের কো-চেয়ারম্যান হবেন। তিনি জানান, রাজউক চেষ্টা করছে ৭ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করতে। এ লক্ষ্যে বিল্ডিং কোড অনুসরণ করে ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে এটা তখন সফল হবে, যখন ভবন মালিকরা রাজউকের অনুমোদন নিয়ে ভবন নির্মাণ করবে।

রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, রাজউক বিশ্বব্যাংকের একটি প্রকল্পের আওতায় দুর্যোগ সহনশীল ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা করেছে। সেখানে প্রত্যেক এলাকার ভূমিকম্পের ঝুঁকি অনুযায়ী কি ধরনের ভবন তৈরি করা যাবে, সে বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। তিনি জানান, বিদ্যমান ড্যাপে ওই পরিকল্পনা যুক্ত করা সম্ভব হয়নি। এরপর ড্যাপ যখন সংশোধন হবে সেখানে ওই পরিকল্পনা যুক্ত করা হবে।

রাজধানীর বিপুল জনগোষ্ঠী ও অগণিত ঝুঁকিপূর্ণ ভবনকে সামনে রেখে ভূমিকম্প মোকাবিলার প্রস্তুতি এখন সময়ের দাবি। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন—প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং ভূমি পরিকল্পনা বিলম্বিত হলে ঢাকায় সম্ভাব্য ভূমিকম্প ক্ষয়ক্ষতি হবে অকল্পনীয়। সূত্র: যুগান্তর