• ঢাকা
  • বুধবার, ০১ মে, ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

রিফাত হত্যার পরও বন্ডের সঙ্গে ৫ বার কথা হয় মিন্নির


নিজস্ব প্রতিবেদক আগস্ট ২৯, ২০১৯, ০৩:২৮ পিএম
রিফাত হত্যার পরও বন্ডের সঙ্গে ৫ বার কথা হয় মিন্নির

ঢাকা: অনেক নাটকের পর অবশেষে বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি জামিন পেয়েছেন। মিন্নিকে দুই শর্তে জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট।  বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট) হাইকোর্টের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দিয়েছেন। 

আদালতে মিন্নির পক্ষে জামিন শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না, এম আমিন উদ্দিন ও মনসুর হক চৌধুরী। অপরদিকে, রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারোয়ার হোসেন।

শর্ত দুটি হলো, মিন্নি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না ও তাকে তার বাবার জিম্মায় থাকতে হবে। জামিনে থাকা অবস্থায় মিন্নি গণমাধ্যমের সাথে কথা বললে তার জামিন বাতিল হবে বলেও আদেশে উল্লেখ করেছেন আদালত। মিন্নির জামিন প্রশ্নে জারি করা রুলের শুনানি শেষে এসব আদেশ এলো।

এর আগে মিন্নির জামিন কেন দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে গত ২০ আগস্ট রুল জারি করেছিলেন আদালত। এর আগে গত ৩০ জুলাই বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামান মিন্নির জামিন নামঞ্জুর করে আদেশ দেন। তার আগে গত ২১ জুলাই বরগুনার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম মো. সিরাজুল ইসলাম গাজীর আদালত মিন্নির জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করেন। এরপর মিন্নির জামিনের বিষয়টি হাইকোর্টে আসে।

এদিকে, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেছেন, রিফাত হত্যাকাণ্ডের আগে ৮ বার এবং পরে ৫ বার প্রধান আসামি নয়ন বন্ডের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন মিন্নি। বুধবার মিন্নির জামিন আবেদনের ওপর হাইকোর্টের দেয়া রুলের শুনানিতে অংশ নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারোয়ার হোসেন এ দাবি করেন।

বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চে মিন্নির জামিন আবেদনের এই শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।

আদালতে মিন্নির জামিন আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না, তাকে সহযোগিতা করেন আইনজীবী মশিউর রহমান, মাক্কিয়া ফাতেমা, জামিউল হক ফয়সাল। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারোয়ার হোসেন বাপ্পী। এ সময় আদালতে উপস্থিত জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সাবেক বিচারপতি মুনসুরুল হক চৌধুরী মিন্নির জামিনের পক্ষে তার মত তুলে ধরেন।

সারোয়ার হোসেন বলেন, রিফাত হত্যাকাণ্ডের আগে ৮ বার এবং পরে ৫ বার নয়ন বন্ডের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন মিন্নি। এটা কি তাকে নির্দোষ প্রমাণ করে? সে এই ঘটনার প্রধান ষড়যন্ত্রকারী। তার কারণেই দুটো প্রাণ ঝরে গেছে।

এর জবাবে মিন্নির আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, নয়ন বন্ড মারা যাওয়ার আগে পুলিশের সঙ্গে ৭৭ বার টেলিফোনে কথা বলেছে। এ প্রতিবেদন পত্রিকায় এসেছে। সেইসব কললিস্ট কোথায়? আর যে নয়ন বন্ডের কথা বলা হচ্ছে সেই বন্ড তৈরি হয়েছে পুলিশ ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়। পুলিশ এখন বলছে বন্ড মিন্নির সৃষ্টি।

তখন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, নয়ন তার একটি পরিত্যক্ত মোটরসাইকেল আটকের বিষয়ে ওই এসআইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করত। এ পর্যায়ে আদালতে উপস্থিত সিনিয়র আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী বলেন, বিচারের পূর্ব পর্যন্ত আদালত মিন্নিকে জামিন দিতে পারেন। জামিনের সঙ্গে তদন্তের কোনো সম্পর্ক নেই। আসামি যদি তদন্তকে প্রভাবিত না করে এবং আদালত যদি মনে করে জামিন দেয়াটা যুক্তিযুক্ত তাহলে সেই ক্ষমতা কোর্টের রয়েছে।

এর আগে তলব আদেশে হাইকোর্টে সিডিসহ হাজির হন তদন্ত কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির। আদালতের জিজ্ঞাসার জবাবে তিনি বলেন, মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে। হাইকোর্টের তলব আদেশ থাকায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পারিনি।

আদালত বলেন, আমাদের তলব আদেশের সঙ্গে তদন্ত রিপোর্ট দাখিল না করার সম্পর্ক কী? মামলার সিডি পর্যালোচনা করে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর উদ্দেশে আদালত বলেন, সিডিতে যা রয়েছে তার সঙ্গে এসপির সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যের কোনো মিল পাচ্ছি না। যত বড় পদে আসীন তাকে তত সতর্ক থাকতে হয়।

আদালত বলেন, এ মামলায় কি নয়ন বন্ডকে গ্রেফতার করেছিলেন? জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, আমি গত ৩০ মে বরগুনায় নিযুক্ত হই। এরপর অন্য মামলায় নয়ন বন্ডকে আসামি হিসেবে পাই। এ মামলায় সে গ্রেফতার হয়নি। বিশ্বস্ত সূত্রের মাধ্যমে খবর পেয়ে নয়নকে গ্রেফতার করতে গেলে বন্ধুকযুদ্ধে সে মারা যায়।

এর পর আদালত তদন্ত কর্মকর্তাকে পেছনে বসতে বলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীকে তার বক্তব্য উপস্থাপন করতে বলেন। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আদালতকে বলেন, নয়নের সঙ্গে মিন্নির সম্পর্ক ছিল— এটা তিনি প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের স্বীকার করেছেন। এই মামলাটি অনেক স্পর্শকাতর এবং জনমনে বেশ আগ্রহ কাজ করছে।

তখন আদালত জানতে চান, ঘটনার পর পুলিশ নয়নের বাড়ি গিয়ে বুঝতে পারল তাকে (মিন্নি) গ্রেফতার করা প্রয়োজন। কিন্তু তার আগে প্রেস ব্রিফিং করায় তার (মিন্নির) সঙ্গে কোনো মিল আছে?

তখন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, কলেজের সামনে ওই ঘটনার আগে নয়নকে মিন্নি আট বার ফোন করে কথা বলেছিলেন। ঘটনার পরও পাঁচ বার নয়নকে ফোন করে কথা বলেন। কল লিস্টে তাই উঠে এসেছে। তাছাড়া ঘটনার পর রিফাতকে হাসাপাতালে পাঠানো হলেও মিন্নি কিন্তু যায়নি। এটা কি তাকে নিষ্পাপ প্রমাণ করে?

আদালত বলেন, এখানে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপস্থিত আছেন। তারা ফোনের কথোপকথন তুলে দেখতে পারেন, কী কী কথা হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী তখন বলেন, তিনি (মিন্নি) এই ঘটনার মূল ষড়যন্ত্রকারী। তার বয়স ১৯ এবং তিনি নারী— এসব বলে জামিনের কোনো সুযোগ নেই। তাকে জামিন না দিয়ে মামলার ন্যায়বিচারে স্বার্থে তার জামিনের বিষয়ে জারি করা রুল খারিজ করা হোক।

এদিকে, জেড আই খান পান্না বলেন, মিন্নি ১৯ বছর বয়সী একটা মেয়ে। তার স্বামী এ ঘটনায় মারা গেছেন। বিধবা, তার পালানোর কোনো সুযোগ নেই। তার পক্ষে জামিন চান তিনি।

উল্লেখ্য, গত ২৬ জুন রিফাতকে বরগুনার রাস্তায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশে আলোচনার সৃষ্টি হয়। পরদিন রিফাত শরীফের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ ১২ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন, তাতে প্রধান সাক্ষী করা হয়েছিল মিন্নিকে। পরে মিন্নির শ্বশুর তার ছেলেকে হত্যায় পুত্রবধূর জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে সংবাদ সম্মেলন করলে ঘটনা নতুন দিকে মোড় নেয়।

গত ১৬ জুলাই মিন্নিকে বরগুনার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে দিনভর জিজ্ঞাসাবাদের পর এ মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। পরদিন আদালতে হাজির করা হলে বিচারক তাকে পাঁচদিনের রিমান্ডে পাঠান। রিমান্ডের তৃতীয় দিন শেষে মিন্নিকে আদালতে হাজির করা হলে সেখানে তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন বলে পুলিশ জানায়।

তার আগের দিনই পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘মিন্নি হত্যাকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা এবং হত্যা পরিকল্পনাকারীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। মিন্নিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই হত্যা পরিকল্পনার সঙ্গে মিন্নির যুক্ত থাকার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ।’

মিন্নি পরে জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন করেন জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে। মিন্নির বাবা অভিযোগ করে আসছেন, ‘নির্যাতন করে ও ভয়ভীতি দেখিয়ে’ মিন্নিকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেছে পুলিশ। এর পেছনে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের হাত আছে বলেও তার দাবি। বরগুনার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালত এবং জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মিন্নির জামিন আবেদন নাকচ হয়ে যাওয়ার পর গত ৫ আগস্ট হাইকোর্টে জামিন আবেদন করেন তার আইনজীবীরা

সোনালীনিউজ/এমএএইচ

Wordbridge School
Link copied!