• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

কে এই ভয়ংকর জঙ্গি মুসা?


বিশেষ প্রতিনিধি ডিসেম্বর ২৬, ২০১৬, ০৫:৩৫ পিএম
কে এই ভয়ংকর জঙ্গি মুসা?

গুলশান হামলার ‘মাস্টারমাইন্ড’ ও নব্য জেএমবির প্রতিষ্ঠাতা তামিম আহমেদ চৌধুরী নারায়ণগঞ্জে নিহত হওয়ার পর সংগঠনের হাল ধরেছিল তানভীর কাদেরী। গত ১০ সেপ্টেম্বর লালবাগের আজিমপুরে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মাহুতি দেয় সে। এরপর আশুলিয়ায় র‌্যাবের অভিযানে মারা যায় আরেক শীর্ষ জঙ্গি সারোয়ার জাহান।

আর ভারতে পালিয়ে গেছে আরেক শীর্ষ জঙ্গি মামুনুর রশিদ রিপন। গুলশান হামলার অন্যতম সমন্বয়ক নূরুল ইসলাম মারজান, বাশারুজ্জামান চকলেট ও রাজীব গান্ধী এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।

আর তাই নব্য জেএমবির নেতৃত্ব এখন পলাতক জঙ্গি মাঈনুল ওরফে মুসার কাঁধেই। গত শনিবার তাকে ধরতেই আশকোনায় অপারেশন রিপল-২৪ অভিযান চালায় কাউন্টার টেরোরিজম (সিটি) ইউনিট। সিটি সূত্র জানায়, তাদের কাছে তথ্য ছিল মুসার পরিকল্পনায় ‘বড় হামলা’র ছক কষছিল নব্য জেএমবি।

এ মুহূর্তে মুসাই হচ্ছে নব্য জেএমবির ধারক ও বাহক। তাকে ধরতে পারলে অন্য জঙ্গিদের সহজেই গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হবে পুলিশ। ইতোমধ্যে একাধিক আস্তানায় জাল ফেলেও মুসাকে ধরতে পারেনি পুলিশ।

তানভীর কাদেরীর সঙ্গে মুসার দীর্ঘদিনের পরিচয় ছিল। নিহত জঙ্গি মেজর (অব.) জাহিদ, তানভীর ও মুসা উত্তরা এলাকায় দীর্ঘদিন একসঙ্গে ছিল। তারা উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরে নিয়মিত একত্রিত হতো। একসময় মুসা তানভীরের দুই ছেলে তাহরীম কাদেরী (বর্তমানে কারাগারে) ও আফিফ কাদেরীকে (গত শনিবার আশকোনায় নিহত) বাসায় গিয়ে পড়াত।

কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটপ্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, গোপন সংবাদ ছিল পূর্ব আশকোনা এলাকায় মুসা বাসাভাড়া নিয়ে আস্তানা গড়ে তুলেছে। শুক্রবার রাতে সেখানে অভিযান চালানো হয়। তবে মুসাকে পাওয়া যায়নি। তাকে ধরার চেষ্টা অব্যাহত আছে।

সিটি সূত্র জানায়, মুসার পরিকল্পনা ছিল ‘বড় হামলা’র। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিচ্ছিল সে। তাই আশকোনার ভাড়া বাসায় বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরকদ্রব্য মজুদও করছিল সে। সেগুলো দিয়ে হ্যান্ডমেইড গ্রেনেডও তৈরি করেছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। নিজে আত্মগোপনে থাকলেও রাজধানীর আশকোনায় তার আস্তানায় কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট (সিটি) অভিযান চালিয়ে সব পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দেয়।

গোয়েন্দারা মুসার বিষয়টি প্রথম জানতে পারেন, গত ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুরে অভিযানের পর। আজিপুরের জঙ্গি আস্তানা থেকে তানভীর কাদেরীর কিশোর ছেলে আদালতে দেওয়া তার জবানবন্দিতে মাঈনুল ওরফে মুসার কথা বলে।

জঙ্গি তানভীরের কিশোর ছেলে তার জবানবন্দিতে বলে, ‘মেজর জাহিদ ও মাঈনুল ওরফে মুসার সঙ্গে আমার বাবার দীর্ঘদিন আগে থেকে পরিচয় ছিল। আমার বাবা, মেজর জাহিদ, মুসাসহ উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের একটি মসজিদে নামাজ পড়ত। তারা প্রায়ই উত্তরার লাইফ স্কুলের মসজিদে ফজরের নামাজ পড়ে একসঙ্গে জগিং করত।’ ওই কিশোর আরো বলে, ‘বাবার মাধ্যমেই মেজর জাহিদ ও মুসার সঙ্গে পরিচয় হয় তার। আমাকে ও আমার ভাইকে মুসা অঙ্ক, ইংরেজি ও বিজ্ঞানের বিষয় পড়াত।’

কিশোরটি জবানবন্দিতে আরো বলে, ‘প্রায়ই আমার বাসায় জাহিদ আংকেল, আন্টি (জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহার), মেয়ে জুনায়রা ওরফে পিংকি এবং মুসা আংকেল, আন্টিসহ যাতায়াত করত। জাহিদ আংকেলের বাসা ছিল উত্তরা ১৩নং সেক্টরে। তাদের বাসায় আমরাও যেতাম। মুসা আংকেল, আন্টিসহ ওই বাসায় যেত।’

সিটির এক কর্মকর্তা জানান, উত্তরার লাইফ স্কুলে একসময়ে শিক্ষকতা করত মাঈনুল ওরফে মুসা। সেখান থেকেই নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম ও তানভীর কাদেরীর সঙ্গে তার পরিচয়। একপর্যায়ে নব্য জেএমবির দলে ভিড়ে যায় মুসা। ধীরে ধীরে সে নব্য জেএমবির গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠে।

গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত ছিল এই মুসা। তামিম চৌধুরীসহ নব্য জেএমবির তানভীর কাদেরী, জাহিদ, রাশেদ, জাহাঙ্গীর, মারজান, বাসারুজ্জামানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হতো।

আজিমপুরে আস্তানা থেকে উদ্ধারের পর জাহিদের মেয়ে পিংকী ওই সময় সিটির কর্মকর্তাদের জানিয়েছিল, তার মা মুসা আংকেলের বাসায় গিয়েছে। তাহরীম ও পিংকীর দেওয়া তথ্যের সূত্র ধরেই মুসাকে খুঁজতে শুরু করে পুলিশ।

সূত্র জানায়, আশকোনার আস্তানায় মুসার স্ত্রী-সন্তান থাকলেও সে নিয়মিত এখানে থাকত না। অন্য জঙ্গিদের স্ত্রীদের নিজের বাসায় রেখে সে অন্য একটি আস্তানায় থাকত। প্রতি মঙ্গল ও শুক্রবার সে আশকোনার বাসায় আসত।

সেই হিসেবে গত শুক্রবার (২৩ ডিসেম্বর) তার আশকোনার আস্তানায় আসার কথা থাকলেও সে আসেনি। মাঝেমধ্যে তার সঙ্গে বছর চল্লিশ বয়সী দাড়িওয়ালা এক ব্যক্তিও আসত। পুলিশ কর্মকর্তাদের ধারণা, মুসা অন্য কোনো আস্তানাতেও একইভাবে বিস্ফোরকদ্রব্য দিয়ে হ্যান্ডগ্রেনেড তৈরি করছিল।

অনুসন্ধানের একপর্যায়ে উত্তরার লাইফ স্কুল থেকে মুসার জীবনবৃত্তান্ত ও ছবি সংগ্রহ করা হয়। পরবর্তী সময়ে দক্ষিণখানের এক মসজিদের ইমামের সঙ্গে তার সখ্যের তথ্য পাওয়া যায়।

গোয়েন্দারা ধারণা করেন, মুসা দক্ষিণখান এলাকার কোথাও আত্মগোপন করে রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় মুসার আশকোনার আস্তানার সন্ধান পায়। সূত্র আরো জানায়, নব্য জেএমবির অনেক নেতা-কর্মী নিহত ও গ্রেপ্তার হলেও মুসা নিজে দায়িত্ব নিয়ে সংগঠন গোছানোর কাজ করছিল।

এ কারণে সে অস্ত্র ও বিস্ফোরক সংগ্রহ করে। নিজের বাসাতেই হ্যান্ডগ্রেনেড ও সুইসাইডাল ভেস্ট তৈরি করে। আশকোনায় অভিযান চালানো বোম্ব ডিসপোজেবল ইউনিটের এক কর্মকর্তা জানান, এই আস্তানা থেকে পাওয়া প্রতিটি সুইসাইডাল ভেস্টে ৫টি করে হ্যান্ড মেইড গ্রেনেড রাখা হয়েছিল। সব গ্রেনেডের একটি ‘কি পয়েন্ট’ তৈরি করা হয়। যেন একটি পিন খুললেই পাঁচটি গ্রেনেড একসঙ্গে বিস্ফোরিত হয়।

সিটির উপ-কমিশনার মহিবুল ইসলাম খান বলেন, ‘একটি সুইসাইডাল ভেস্ট বিস্ফোরিত করেছে জঙ্গি সুমনের স্ত্রী। আরেকটি সুইসাইডাল ভেস্ট ছিল জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহারের কাছে। আত্মসমর্পণের আগে সে ওই সুইসাইডাল ভেস্টটি খুলে রাখে। এ ছাড়া আরো দুটি সুইসাইডাল ভেস্ট সেখানে দেখা যায়। এগুলো দিয়ে বড় হামলার জন্য তারা প্রস্তুতি নিচ্ছিল বলে জানান এই কর্মকর্তা।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/এইচএআর

Wordbridge School
Link copied!