• ঢাকা
  • রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

নকল ওষুধ বেচাকেনার আস্তানা মিটফোর্ড


নিজস্ব প্রতিবেদক সেপ্টেম্বর ৪, ২০২১, ০১:৪০ পিএম
নকল ওষুধ বেচাকেনার আস্তানা মিটফোর্ড

ঢাকা : দেশে নামি-দামি ব্রান্ডের নামে বেশ কয়েকটি চক্র তৈরি করছে নকল ওষুধ। আর এসব নকল ওষুধ  কেনাবেচার মূল আস্তানা মিটফোর্ডের পাইকারি বাজার। এখান থেকেই প্রত্যন্ত এলাকায় কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে ভেজাল ওষুধ। বিভিন্ন সময়ে নকল ওষুধ তৈরির সাথে জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হলেও থেমে নেই চক্রের কার্যকলাপ। আর জামিনে বেরিয়ে তারা আবারো একই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, নকল ওষুধ উৎপাদনকারীরা বিভিন্ন এলাকায় কারখানা বানালেও তাদের পাইকারি বাজার মিটফোর্ড। এখান থেকেই ভেজাল ওষুধ ছড়াচ্ছে সারা দেশে। তাই মিটফোর্ড মার্কেটে নিয়মিত অভিযান পরিচালনার তাগিদ দিয়েছেন তারা। একইসাথে এবিষয়ে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে সক্রিয় উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদও দিয়েছেন।

জানা গেছে, গত ২১ দিনে দুটি অভিযানে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নকল ওষুধ তৈরি অভিযোগে দুটি চক্রের ১৫ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে দুই চক্রের সদস্যরাই স্বীকার করেছে, তারা নকল ওষুধ তৈরির পর সেগুলো বাজারজাত করত দেশের সবচে বড় পাইকারি ওষুধের বাজার মিটফোর্ডে।

সর্বশেষ গত বুধবার কাজলা, আরামবাগ ও মিটফোর্ড এলাকা থেকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেপ্তার করে নকল ওষুধ তৈরি চক্রের ৭ সদস্যকে।

ওই সাতজন হলেন তরিকুল ইসলাম, সৈয়দ আল মামুন, সাইদুল ইসলাম, মনোয়ার, আবদুল লতিফ, নাজমুল ঢালী ও সাগর আহমেদ মিলন। তাদের কাছ থেকে একমি কোম্পানির মোনাস ট্যাবলেট ৭০০ বাক্স, স্কয়ার কোম্পানির সেকলোর ৫০ বাক্স, জেনিথ কোম্পানির ন্যাপ্রোক্সেন প্লাসের ৭৪৮ বাক্সসহ অন্য কিছু কোম্পানির বিপুলসংখ্যক নকল ওষুধ, এগুলো তৈরির মেশিন ও ওষুধের খালি বাক্স উদ্ধার করা হয়েছে।

শুক্রবার (৩ সেপ্টেম্বর) এ বিষয়ে প্রেস ব্রিফিং করেন অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার।

তিনি বলেন, ওই চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে নকল ওষুধ তৈরি করে আসছিল। গ্রেপ্তারকৃতরা ঢাকার ভেতর ও বাইরের জেলাগুলোতে কারখানা স্থাপন করেন। তারা নকল ওষুধ উৎপাদন করে তা পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায় পাইকারি দরে বিক্রি করে আসছিলেন।

এর আগে গত ১২ আগস্ট ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কোতয়ালি জোনাল টিম রাজধানী ঢাকা, সাভার ও পিরোজপুরের নেছারাবাদ বিসিক শিল্প এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ নকল ওষুধ জব্দ করে। এসময় গ্রেপ্তার করা হয় আটজনকে।

চক্রটিকে গ্রেপ্তারে পর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার সাইফুর রহমান আজাদ জানিয়েছিলেন, গ্রেপ্তারকৃতরা ঢাকার বাইরে কারখানা বসিয়ে সেখানে নকল ওষধ তৈরি করে সেগুলো মিটফোর্ড ওষধের মার্কেটে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর মাধ্যমে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে বাজারজাত করত।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বিপণনে ঢাকাসহ সারা দেশে বেশ কয়েকটি চক্র সক্রিয়।

গোয়েন্দাতথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে কিছু চক্রকে আইনের আওতায় আনা হয় ঠিকই, কিন্তু জামিনে বেরিয়ে তারা আবার শুরু করে ভেজাল ওষুধ তৈরির কাজ। গত কয়েক বছরে মিটফোর্ডের বাজার থেকেই কয়েক শ কোটি মূল্যের ভেজাল ওষুধ জব্দ করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অনেক ওষুধের দোকানের মালিক কম টাকায় ওষুধ কিনতে মিটফোর্ড আসেন। নকল ওষুধ উৎপাদনকারীরা তাদের প্রস্তাব দেয়। বেশি লাভের আশায় ফার্মেসি মালিকরা রাজি হলে কুরিয়ারের মাধ্যমে ওষুধ পাঠানো হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মিটফোর্ডের পাইকারি ওষুধ মার্কেটের কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির এক পরিচালক জানান, কেউ কেউ আয়ুর্বেদিক লাইসেন্সের আড়ালে কারখানা বানিয়ে নকল ওষুধ তৈরি করছে। অনেকে বাসাবাড়িতেও ভেজাল ওষুধ বানানো হচ্ছে। অল্প কয়েকজন অসাধু ব্যবসায়ীর জন্য পুরো মার্কেটের দুর্নাম হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, তারাও নকল ওষুধ উৎপাদন এবং বিপণনের বিপক্ষে। এজন্য ২০১৮ সালে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে একটি টাস্কফোর্স গঠনের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন তারা। কিন্তু প্রশাসন পদক্ষেপ নেয়নি।

এ প্রসঙ্গে মিটফোর্ডের ড্রাগিস্ট অ্যান্ড কেমিস্ট সমিতির সাবেক পরিচালক জাকির হোসেন রনি বলেন, আমরা চাই নকল ওষুধ যারা তৈরি করে তাদের সর্বোচ্চ সাজা হোক। যারা বিপণন করে তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি যাবতীয় লাইসেন্স বাতিল করে কালো তালিকাভুক্ত করা হোক।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, করোনা মহামারিতে বহুল ব্যবহূত একমি ল্যাবরেটরিসের মোনাস-১০ ও ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস-এর মনটেয়ার-১০ নকল করতো চক্রটি। আবার স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের সেফ-৩, সেকলো-২০, জেনিথ ফার্মাসিউটিক্যালস-এর ন্যাপ্রোক্সেন প্লাস-৫০০ ও বানাতো ওরা।

গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, সেফ-৩ এর বাজার মূল্য প্রতি পিস ৩৫ টাকা ৫০ পয়সা। চক্রটি নকল সেফ-৩ বিক্রি করতো ৫ টাকা করে। একইভাবে ছয় টাকা দামের সেকলো ৭৫ পয়সা, ১৬ টাকা মূল্যের মনটেয়ার ৩ টাকা, ১১ টাকা মূল্যের ন্যাপ্রোক্সেন আড়াই টাকা এবং ১৬ টাকা মূল্যের মোনাস ৩ টাকায় বিক্রি করত। ফার্মেসি মালিকরাও মাত্রাতিরিক্ত মুনাফার লোভে বিক্রি করত এসব ভুয়া ওষুধ।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, গত ১২ আগস্ট গ্রেপ্তার হওয়া নকল ওষুধ উৎপাদনকারী চক্রটির মূলহোতা ফয়সাল। সে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে আয়ুবের্দিক ওষুধ তৈরির একটি লাইসেন্স নিয়েছিল। ওটা ব্যবহার করে সে পিরোজপুরের বিসিক শিল্পনগরীতে কারখানা স্থাপন করে। আতিয়ার নামের এক কেমিস্টের কাছ থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ওষুধের ফর্মুলাও নিয়েছিল সে। তারপর শুরু করে নকল ওষুধ উৎপাদন।

রাজধানীর মিটফোর্ডের মুহিব নামের এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে রাসায়নিক সংগ্রহ করত ফয়সাল। সেগুলো সাভার ও পিরোজপুর পাঠিয়ে নকল ওষুধ তৈরি করে আবার নিয়ে আসত মিটফোর্ডে।

মিটফোর্ড থেকেই ফয়সালের সহযোগী মোবারক, নাসির, ওহিদুল, মামুন, রবিন, ইব্রাহীম, আবু নাইম ও আরেক ফয়সালের মাধ্যমে সারা দেশে বিক্রি করত।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তদারকির অভাবেই নকল ও নিম্নমানের ওষুধ দেদারছে বিক্রি হচ্ছে।

ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এখন দেশে ২৪১টি প্রতিষ্ঠান প্রায় ৩০ হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধ বানাচ্ছে। যে কোনো ওষুধ বাজারজাত করার আগে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়ে বাজারজাত করতে হয়। কিন্তু একবার বাজারজাত করার পর সেই ওষুধের গুণগত মান নিয়ে আর কোনো তদারকি হয় না। এই সুযোগেও অনেক নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান ওষুধের মান কমিয়ে দেয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কাজ হলো মাঝে মাঝে বাজার থেকে ওষুধ সংগ্রহ করে মান পরীক্ষা করা। কিন্তু তাদের ল্যাবরেটরির সক্ষমতা কম। এই সুযোগও কাজে লাগায় অনেক কোম্পানি। লোকবলের অভাব ও ক্যাপাসিটি না থাকার দোহাই দিয়ে কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয় না।

এদিকে নকল ওষুধ ব্যবহারে শারীরিক ও আর্থিক উভয় ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন রোগীরা। এ জন্য কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সায়েদুর রহমান।

তিনি বলেন, নকল ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন ভয়াবহ অপরাধ। দৃষ্টান্তমূলক সাজা না হলে এটি থামবে না। এতে রোগ তো সারেই না, উল্টো আরো জটিলতা বাড়ে। নকল ওষুধের কারণে ব্যক্তির শারীরিক ক্ষতির সঙ্গে আর্থিক ক্ষতিও হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থাকে একযোগে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে যেখান থেকে এগুলো উৎপাদন ও বিক্রি হচ্ছে সেখান থেকেই অভিযান শুরু করতে হবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!