• ঢাকা
  • রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

অসম্ভবকে সম্ভব করার বাজেট!


নিজস্ব প্রতিবেদক জুন ১, ২০২৩, ০৯:৫০ পিএম
অসম্ভবকে সম্ভব করার বাজেট!

ঢাকা: ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। বিশাল এ বাজেটের ঘাটতি ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। আর অনুদান ছাড়া ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা; যা মোট জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ।  

প্রস্তাবিত বাজেটে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সে সঙ্গে আগামী অর্থবছরেও মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রত্যাশা তার।

তবে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেছেন,  প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবতা বিবর্জিত এবং এ বাজেট দিয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়।

তিনি বলেছেন, মূল্যস্ফীতির চাপ ও পণ্যের লাগাম টেনে ধরার জন্য বাজেটে যেসব সমাধান দেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এমনকি মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার যে কথা বলা হয়েছে সেটাও এই বাজেটের মাধ্যমে করা সম্ভব হবে না। 

তবে অসম্ভবকে সম্ভব করার চ্যালেঞ্জ নিয়েই বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, ‘বিশ্ববাজারে জ্বালানি, খাদ্যপণ্য ও সারের মূল্য কমে এসেছে। এ ছাড়া দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় ও খাদ্য সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য সরকার উদ্যোগ নিয়েছে।’

‘এসব কারণে আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত থাকবে। আগামী অর্থবছরে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের কাছাকাছি দাঁড়াবে আশা করি।’

প্রস্তাবিত বাজেটে ন্যূনতম আয়কর ২ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। অর্থাৎ করমুক্ত সীমার নিচে আয় রয়েছে অথচ সরকার থেকে সেবাগ্রহণের ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা আছে এমন করদাতাদের ন্যূনতম কর ২ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই প্রস্তাব পাস হলে করমুক্ত আয়সীমার ( সাড়ে ৩ লাখ) নিচে আয় থাকলেও নির্ধারিত সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে সব সেবাগ্রহিতাকেই ন্যূনতম কর দিতে হবে।

এখানেও সিপিডি বলছে, ‘ট্যাক্স রিটার্নের নামে ন্যূনতম কর ২ হাজার টাকা নির্ধারণ করাও ঠিক হয়নি। এটি তুলে দেওয়া উচিত।’

ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানোর কথা আমরা বলেছিলাম। সীমারেখা তিন লাখ থেকে সাড়ে তিন লাখ করা হয়েছে, যা একটি ভালো দিক। তবে ৩৮টি সরকারি সেবা গ্রহণ করতে গিয়ে যে সেবাগ্রহীতার ট্যাক্স রিটার্ন সাবমিট করতে হবে এবং আয় যেটাই হোক তাকে ২ হাজার টাকা কর দিতে হবে, সেটা আমাদের কাছে অবিবেচনাপ্রসূত মনে হয়েছে। এই দুই হাজার টাকা ন্যূনতম কর তুলে দেওয়া উচিত।’

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, ফেব্রুয়ারিতে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। মার্চে তা বেড়ে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশে ওঠে। এপ্রিলে তা সামান্য কমে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে নেমেছে। বাজারে জিনিসপত্রের দাম আরেক দফা বেড়েছে। মে মাসের তথ্য পাওয়া গেলে সেটা দুই অঙ্কের ঘরে (ডাবল ডিজিট) গিয়ে পৌঁছতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।

বিশ্ববাজারের অস্থিরতাকে সঙ্গী করে সরকার যখন আইএমএফের ঋণের শর্ত মেনে ভর্তুকি তুলে নিয়ে ধাপে ধাপে জ্বালানির দাম বাড়াচ্ছে, সেই সময়ে গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছেন অর্থমন্ত্রী।

বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান এই সূচককে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে বেধে রাখার লক্ষ্য ঘোষণা করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। পরে তা সংশোধন করে ৬ শতাংশ করা হয়। তবে সেই লক্ষ্যও পূরণ করা যায়নি।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে ১০ মাসের গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশে, যা বহু বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তের সংসারে তেল-নুনের হিসাব মেলাতে স্বাভাবিকভাবেই প্রচণ্ড চাপ পড়ছে।

এমন বাস্তবতায় গড় মূল্যস্ফীতি কী করে ৬ শতাংশে রাখা যাবে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় দেননি।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কবে শেষ হবে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না। যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব প্রতিনিয়ত পড়ছে অর্থনীতিতে। এমন অস্থির বৈশ্বিক পরিস্থিতির মধ্যে আগামী ডিসেম্বর অথবা পরবর্তী বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনের এই মহাযজ্ঞ আয়োজনে রয়েছে বিশাল ব্যয়ের চাপ। পাশাপাশি এই ভোট ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিরতার শঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।

এসব সংকটের মধ্যেও আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ অর্জন করতে চান অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল। আর সেই লক্ষ্য অনুযায়ী এবার জিডিপির মোট আকার নির্ধারণ করা হচ্ছে ৫০ লাখ ৬ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটেও মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) ৭ দশমিক ৫ শতাংশ অর্জিত হবে বলে লক্ষ্য ধরেছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

কিন্তু ছয় মাসের (জুলাই-ডিসেম্বর) হিসাব কষে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, এবার ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি বলছে আরও কম; ৫ শতাংশের কিছু বেশি।

অর্থনীতি চাপে থাকার পরও কেন এবার বেশি প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা করছেন- সে ব্যাখ্যায় অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘ধীরে হলেও বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে, বিশেষ করে আমাদের বাণিজ্য ও প্রবাস আয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোতে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এবং তা অব্যাহত থাকবে বলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এ বছরের এপ্রিলে প্রক্ষেপণ করেছে। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্য, সার ও জ্বালানির মূল্য স্বাভাবিক হয়ে আসার সুবাদে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাবে বলেও আইএমএফ-এর প্রক্ষেপণে প্রকাশ পেয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ব অর্থনীতির অনুকূল পরিবর্তন আমাদের জন্য আশার সঞ্চার করছে। একইসঙ্গে কোভিড পরিস্থিতির সার্বিক উন্নয়নে দেশের অভ্যন্তরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পূর্ণ গতি সঞ্চার হয়েছে। এছাড়াও, অর্থবছরের শেষাংশে কৃষি খাতে ভাল ফলন আসছে। সার্বিকভাবে, উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ ও উৎপাদশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এবং সুসংহত অভ্যন্তরীণ চাহিদার কল্যাণে অতীতের ধারাবাহিকতায় আগামী অর্থবছরে আমরা উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে আসব এবং ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারব বলে আশা করছি।’

আসন্ন বাজেটের ঘাটতি পূরণে ব্যাংক ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ নেবে বলে লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। এই অঙ্ক চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৬ হাজার ৬১ কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে এক ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। এর আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) ছিল ৭৫ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা।

বাজেটে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। করবহির্ভূত ও অন্যান্য আয়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ২০ হাজার কোটি টাকা। কর ছাড়া প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। আর বৈদেশিক অনুদান থেকে সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।

বাজেটে মোট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে (অনুদান ছাড়া) দুই লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। অনুদান সহ এ ঘাটতি দাঁড়ায় দুই লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। বিশাল এ ঘাটতি পূরণে সরকার কোন খাত থেকে কত টাকা ঋণ নেবে তারও একটি ছক তৈরি করেছে।

ছক অনুযায়ী, এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণ নেবে এক লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা এছাড়া  বৈদেশিক ঋণ হিসাবে নেবে এক লাখ দুই হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে যা আছে ৯৫ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা।

অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধার নিতে চায় ব্যাংক খাত থেকে। যার পরিমাণ  ১ লাখ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। এরপর সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ ১৮ হাজার কোটি টাকা আর অন্যান্য খাত থেকে আসবে পাঁচ হাজার এক কোটি টাকা নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ১০ মে পর্যন্ত সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৬৭ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। আগের অর্থবছরে সরকার নিয়েছিল ৩১ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। গত ১ জুলাই থেকে ১০ মে পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ১০ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। ফলে ব্যাংকিং উৎস থেকে সরকারের সামগ্রিক ঋণের পরিমাণ বেড়ে ৭৮ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা হয়েছে।

সোনালীনিউজ/আইএ

Wordbridge School
Link copied!