ঢাকা : এক অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। এখানে বারোমাসে বিরাজ করে ছয়টি ঋতু। দুই মাস অন্তর অন্তর ঋতু পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে প্রকৃতিতে ঘটতে থাকে পট পরিবর্তনের লীলাখেলা। একেক ঋতু প্রকৃতিতে নিয়ে আসে একেক রকমের বারতা। ঘটতে থাকে রূপ বদলের পালা। আর প্রকৃতির রূপ পরিবর্তনের এই অপার সৌন্দর্যের মাঝে অমিয় সুধা ঢেলে দেয় বিভিন্ন ধরনের পুস্পরাজি।
গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত প্রতিটি ঋতুরই রয়েছে নিজস্ব কিছু স্বকীয়তা। আর এই স্বকীয়তা ফুটে ওঠে ফুল, পাখি, লতাপাতা ও বৃক্ষরাজির মধ্যদিয়ে। তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত ও বায়ুপ্রবাহের তারতম্যের কারণে ঋতুগুলো একটি থেকে অপরটি পৃথক। তাইতো প্রতিটি ঋতুরই রঙ, রূপ ও সৌন্দর্যও ভিন্ন হয়ে থাকে।
গুরুগম্ভীর বজ্রনিনাদ ও কালবৈশাখীর তাণ্ডবলীলার মধ্যদিয়ে বছরের প্রথম ঋতু গ্রীষ্মের আগমন ধ্বনি বেজে উঠলেও এই ঋতুতেও বিভিন্ন ধরনের বর্ণিল ফুলে রঙিন হয়ে ওঠে প্রকৃতি। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড খরতাপ ও দহনজ্বালা উপেক্ষা করেও শাখায় শাখায় বিকশিত হতে থাকে নানান ধরনের চোখ ধাঁধাঁনো ফুলের সৌন্দর্য। এই ঋতুতে বেশি সংখ্যক উঁচু গাছে ফুল ফুটে। শুধু তা- ই নয়, ফুলগুলোর স্থায়িত্বও হয় অনেক দিন।

বৈশাখ মাসের প্রথম ভাগেই পাওয়া যায় কয়েকটি বাহারি ফুল। কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, জারুল, সোনালু, স্বর্ণচাঁপা, ভাঁট, গন্ধরাজ, উদয়পদ্ম, গুলাচি, লালসোনাইল ইত্যাদি গ্রীষ্মের প্রধানফুল হলেও পালান, দুরন্তলতা, শ্যামটিউলিপ, মে ফ্লাওয়ার, অনন্তলতা, পাদাউক, সোনালী শাপলা, বেলি, জহুরিচাঁপা, বনপারুল, কার্ডওয়েল লিলিসহ কয়েকজাতের লিলি ও এই সময়ে প্রকৃতিতে শোভাবর্ধন করে থাকে। তবে এগুলোর মধ্যে একইগোত্রের কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, ও কনকচূড়ার রয়েছে আলাদা রূপ ও বৈশিষ্ট্য।
গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে জীবন যখন ওষ্ঠাগত, খাঁ খাঁ রোদ্দুরে চারদিক যখন উত্তপ্ত, ঠিক তখন এক ঝলক নির্মল আনন্দ নিয়ে সবচেয়ে চটকদার রঙের যে ফুলটি অনেক দূর থেকে আমাদের নজর কাড়ে তার নাম কৃষ্ণচূড়া। কৃষ্ণচূড়া আমাদের এতই আপন ও পরিচিত যে তাকে নতুন করে আর কাউকে পরিচয় করিয়ে দিতে হয় না। চারিদিকে যখন জারুল, সোনালু, কাঠগোলাপ, লালসোনাইল ইত্যাদি নানান ফুলের সমারোহ ঠিক তখন অন্যান্য দৃষ্টিনন্দন ফুলের ভিড়ে প্রকৃতিতে টুকটুকে লালরঙের শুন্যতা পূরণ করতেই যেন আসে কৃষ্ণচূড়া। এতো রঙ বোধহয় আর কোন ফুলে নেই। মাঝারি উচ্চতার চিরল চিরল পাতার এই গাছটি আমাদের খুবই চেনা। পাঁচ পাপড়ির মধ্যে একটি একটু বড় ও তাতে হলুদ বা সাদা দাগ থাকে। তবে টকটকে লাল রক্তবর্ণ কৃষ্ণচূড়ার সঙ্গে মাঝে মাঝে কমলা রঙের কৃষ্ণচূড়াও দেখতে পাওয়া যায় । বাংলা বৈশাখ আর ইংরেজি এপ্রিল মাসে কৃষ্ণচূড়া ফুটতে শুরু করে। ফোটে জুন পর্যন্ত। গাছ জুড়ে এতই ফুল ফুটে যে লাল ও কমলা রঙের ফুলে যখন চারপাশ রঙিন হয়ে ওঠে তখন সেটা অনেক দূর থেকেই সবাইকে আকৃষ্ট করে। আমাদের অতিপ্রিয় গন্ধহীন এই ফুলের আদি নিবাস পূর্ব আফ্রিকার মাদাগাস্কার।

কৃষ্ণচূড়ার সমগোত্রীয় গ্রীষ্মের আরেকটি সুদর্শন ফুলের নাম রাধাচূড়া। কৃষ্ণচূড়ার পাশাপাশি এই ফুলের সৌন্দর্যও সবাইকে মোহিত করে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে আগত এই ফুলের গাছ, পাতা ও ফুলের গড়ন কৃষ্ণচূড়ার কাছাকাছি, পার্থক্য শুধু রঙে। লাল ও হলুদ রঙের কমনীয় এই ফুলগাছ শীতকালে পাতাশূন্য হয়ে পড়ে। বসন্তের মাঝামাঝি আবার গাছটিতে নতুন পাতা গজায়। ফুল ফোটে গ্রীষ্মের শুরুতে এবং প্রায় সারা বছরই দেখতে পাওয়া যায়। সবুজ পাতাভরা গাছের বড় বড় খাড়া মঞ্জরিতে থোকা থোকা হলুদ ফুলে থাকে কড়া সুগন্ধ। রাধাচূড়ার গাছে বর্ষার শেষে ছোট ছোট চ্যাপ্টা, তামাটে রঙের ফল আসে। এর শোভাও অত্যন্ত মনোহর।
কৃষ্ণচূড়া ও রাধাচূড়া নামের সাথে মিল রেখে গ্রীষ্মের আরেকটি নান্দনিক ফুলের নাম কনকচূড়া। এটিও আমাদের দেশের নিজস্ব গাছ নয় । এটি শ্রীলংকা, আন্দামান, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া এসব এলাকার প্রজাতি। বৈজ্ঞানিক নাম peltophorum pterocarpum. আমাদের নিসর্গীরা নামকরণ করেছেন কনকচূড়া। গাছ মোটামুটি ২০ মিটারের মতো লম্বা হতে পারে। চারপাশে শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে দিয়ে বেড়ে ওঠে। পাতা যৌগিক। গাছ, পাতার আকৃতি কৃষ্ণচূড়া গাছের মতোই। তবে ফুল উজ্জ্বল কমলারঙের হলেও দূর থেকে হলুদ দেখায়। কনকচূড়ারও শীতের শেষভাগে পাতা ঝরে যায়। গ্রীষ্মে নতুন কচি পাতা আর ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। ফুলে পাপড়ির সংখ্যা পাঁচটি, পাপড়িগুলো কুঞ্চিত। ফুল ফোটে শাখার ডগার লম্বা মঞ্জরিতে। অজস্র প্রস্ফুটনের ফলে দূর থেকে সবুজের ওপর স্বর্ণালির প্রলেপের মতো দ্যুতিময় দেখায়। ফুল সুরভিময়। কনকচূড়ার ফল শিমের মতো। দুই থেকে ছয় সেন্টিমিটার লম্বা, রঙ তামাটে। ফুলের মতো ফলও প্রচুর হয়। তামাটে রঙের পাতলা ফলগুলোর হাওয়ার ঝাপটায় দুলতে থাকার দৃশ্যও চমৎকার।

এই তিনটি বৃক্ষই ভারত উপমহাদেশে এসেছে প্রায় তিন থেকে চারশ বছর আগে। কিন্তু অনেকেই মনে করে থাকেন মহাভারতের যুগে রাধাকৃষ্ণের নামের সাথে মিল রেখে কৃষ্ণচূড়া ও রাধাচূড়া ফুলগুলোর নামকরণ করা হয়েছে। মূলত মহাভারতে রাধাকৃষ্ণের প্রসঙ্গ প্রায় দুই হাজার বছরের পুরনো। সেই সূত্রে ফুলগুলোর নামকরণ আরও অনেক পরের ঘটনা। আবার এই নামগুলো কোনও নিসর্গী, কবি বা উদ্ভিদবিজ্ঞানীও দিতে পারেন এমন ধারণাও পোষণ করা হয়।
চূড়াযুক্ত নামের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ এই তিন ফুলের বর্ণ, গড়ন ও উচ্চতার দিক থেকে নানা বৈসাদৃশ্যও রয়েছে । যেমন, কৃষ্ণচূড়া ও রাধাচূড়া লাল ও হলুদ রঙের দেখা যায়। কিন্তু কনকচূড়ার শুধু একটিই রঙ হয়, হলুদ। কৃষ্ণচূড়া এবং কনকচূড়ার প্রস্ফুটনকাল গ্রীষ্ম হলেও রাধাচূড়া প্রায় সারাবছরই দেখতে পাওয়া যায়। তবে বিভিন্ন ধরনের বৈসাদৃশ্য থাকলেও উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের ধারণামতে তিনটি বৃক্ষই Caesalpinaceae পরিবারের।
সোনালীনিউজ/এমটিআই







































