• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বায়োডিজেলের সম্ভাবনা


এস এম মুকুল ডিসেম্বর ২, ২০২০, ১২:৫০ পিএম
বায়োডিজেলের সম্ভাবনা

ঢাকা : পৃথিবীর সঞ্চিত জ্বালানি এক সময় না এক সময় অবশ্যই শেষ হয়ে যাবে। যানবাহনের ওপর এ যুগের মানুষ অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। ‘জ্বালানি ফুরিয়ে যাবে’ ভাবতেও ভয় লাগে। তাহলে কি পৃথিবী আর ঘুরবে না, থেমে থাকবে? তাহলে উপায় কী? উপায় বাতলে দিচ্ছে বরাবরের মতো প্রযুক্তিই।

আমদের চারপাশের প্রাকৃতিক উপাদনগুলোই হয়ে উঠতে যাচ্ছে আগামী দিনের জ্বালানির অফুরন্ত উৎস। সৌরশক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রক্রিয়া অনেক আগেই আমরা জেনেছি। এর সম্ভাবনা ও উন্নতির কাজ এর মধ্যে  অনেক দূর এগিয়েছে।

সম্প্রতি বিশ্ববাসী পরিচিত হচ্ছে বায়োডিজেলের সাথে। এই বায়োডিজেলটি সংগ্রহ করা হয় গাছ থেকে এবং এ জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত গাছ হচ্ছে যাত্রাফা, গম, ভুট্টা, পাম, সাদা মান্দার। এগুলোর ফল ও ফুল থেকে সংগৃহীত তেলকেই বলা হচ্ছে বায়োডিজেল।

বায়োডিজেল, প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ : বাংলাদেশের জন্য বায়োডিজেল উৎপাদন একটি সম্ভাবনার খাত হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। সাদা মান্দার এ ক্ষেত্রে আলোর পথ দেখাচ্ছে। গবেষকরা বলছেন, সাদা মান্দার গাছ থেকেই ডিজেল পাওয়া যাবে।  এক সময় সাদা মান্দারের তেল দিয়ে কুপি বাতি জ্বালাত আদিবাসিরা। পরে বিদ্যুতের আগমনে এর ব্যবহার আর তেমন চোখে পড়ে না।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কৃষি শক্তি ও যন্ত্র বিভাগের প্রফেসর এবং প্রধান গবেষক ড. মো. দৌলত হোসেন ও সহযোগী গবেষক প্রভাষক পারভেজ ইসলাম দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে গবেষণার পর এ তথ্য জানিয়েছেন।

জার্মানির বায়োডিজেল বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. কে বেকার এসেছিলেন বাংলাদেশে। তিনিই বায়োডিজেল তৈরির জন্য সম্ভাব্য সাদা মান্দারের সঠিক জাত শনাক্তকরণে সহায়তা করেন। তিন থেকে পাঁচ ফুট উঁচু সাদা মান্দার গাছ এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ফুল ও ফল দেয়।

গবেষকরা জানান, প্রতি হেক্টর জমি থেকে ১০-১২ টন সাদা মান্দার বীজ পাওয়া সম্ভব। এ থেকে ২৩-২৭ শতাংশ তেল পাওয়া যেতে পারে। প্রতি হেক্টর জমি থেকে প্রতি বছরে দুই-আড়াই হাজার লিটার বায়োডিজেল পাওয়া সম্ভব।

বর্তমান সময়ে ডিজেলের দাম বাড়ায় এবং প্রাপ্তির উৎস ধীরে ধীরে কমতে থাকায় সাদা মান্দার তেলের ব্যবহার ইন্ডিয়া, মাদাগাসকার, থাইল্যান্ড, ব্রাজিলে বাড়ছে। জার্মানির হোহেনহাইস বিশ্ববিদ্যালয়ে সাদা মান্দার তেলের (বায়োডিজেল) গুণাগুণ পরীক্ষা করে দেখা গেছে, বায়োডিজেলের মান ফসিল ডিজেলের চেয়ে উন্নত। এর ব্যবহারে ইঞ্জিনের ধোঁয়া কম হয় ও ইঞ্জিনের লাইফ বেড়ে যায়।

একটি সাদা মান্দার গাছ থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত বায়োডিজেল পাওয়া যেতে পারে। প্রফেসর দৌলত জানান, শুধু এক বিঘা জমিতে সাদা মান্দার চাষ করে এক বছরের কুপি বাতি বা হারিকেন জ্বালানোর তেলের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।

এ দেশেই বহু বছর আগে একটি অতি পরিচিত গাছের বীজ থেকে জ্বালানি তেল তৈরি হতো গাছটির নাম সাদা মান্দার। বৈজ্ঞানিক নাম Jatropa Carcus (যাত্রোপা কারকাস)।

এ দেশের আদিবাসী ও গ্রামের মানুষ সাদা মান্দারের বীজ থেকে তেল সংগ্রহ করে কুপি বাতি জ্বালাত। কেরোসিন আর বিদ্যুতের আগমন সে বৃক্ষ-জ্বালানির কবর রচনা করেছে। এখন ২০০ কোটি ডলারের আমদানীকৃত জ্বালানির ব্যয় মেটাতে হিমশিম অবস্থায় আবারো বৃক্ষ-জ্বালানির খোঁজ পড়েছে। সাদা মান্দার বা যাত্রোকা গাছের পরিকল্পিত আবাদ ও এর বীজ থেকে বায়োডিজেল উৎপাদন ত্বরান্বিত করতে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাদা মান্দার গাছের ফলের বীজ থেকে বায়োডিজেল পাওয়া যায়। সাধারণত এ গাছ ৮ ফুটের মতো লম্বা হয়। এতে প্রচুর ফল হয়। গাছ লাগানোর ৯ মাস পর থেকে ফুল ধরে। ১টি গাছে বছরে প্রায় ২৫ কেজি ফল ধরে।

এ গাছ ৩০-৪০ বছর বাঁচে। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়কালে সাদা মান্দার ফুল ও ফল দেয়। ফলের প্রতিটি বীজের ওজন ০.৮ থেকে ১ গ্রাম হয়ে থাকে। ১ হেক্টর জমিতে প্রায় আড়াই হাজার গাছ লাগানো যায় যা থেকে ১০-১২ টন পর্যন্ত বীজ পাওয়া সম্ভব। ১ টন বীজ থেকে ২৪৫ কেজি পর্যন্ত তেল পাওয়া যায়। এ তেল সংগ্রহ করাও তেমন কঠিন কিছু নয়।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত, শুধু ১ বিঘা জমিতে সাদা মান্দার চাষ করে ১ বছরের কুপিবাতি বা হ্যারিকেন জ্বালানোর তেলের চাহিদা পূরণ সম্ভব। মান্দার বীজে তেলের পরিমাণ ২৩-৩৭ শতাংশ।

সে হিসেবে ১ হেক্টর জমি থেকে পাওয়া ১০-১২ টন বীজ থেকে প্রতি বছরে দুই থেকে আড়াই হাজার লিটার বায়োডিজেল পাওয়া যেতে পারে। জার্মানির হোহেনা হাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারে সাদা মান্দার তেলের গুণাগুণ পরীক্ষা করে দেখা গেছে এই বায়োডিজেলের গুণাগুণ ফসিল ডিজেল (আমদানিকৃত জ্বালানি) থেকে উন্নত মানের এবং এর ব্যবহারে ইঞ্জিনের ধোঁয়া কম হয়, ইঞ্জিনের আয়ু বাড়ে।

ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ গাছের ফল থেকে বায়োডিজেল উৎপাদন করা হচ্ছে। ভারতের ঝাড়খণ্ডসহ বিভিন্ন রাজ্যের আবাদ অযোগ্য জমিতে বিদেশি কোম্পানিরা এ গাছ চাষ করছে। সেখানে এ গাছের ফল থেকে ১ লিটার ডিজেল উৎপাদনের খরচ পড়ছে মাত্র ২১ রুপি।

সাদা মান্দার বা যাত্রোপা গাছ সর্বত্রই জন্মে। দেশের পাহাড়ি এলাকা, চরাঞ্চল, রাস্তা ও রেললাইনের দু’পাশ, বরেন্দ্র অঞ্চল ও অন্যান্য এলাকার অনাবাদি পতিত জমিতে এ গাছ ব্যাপকভাবে লাগানো যেতে পারে। প্রথম দিকে উৎপাদন কম হলেও পঞ্চম বছর থেকে উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়ে যায়। আমাদের দেশে এখন আমদানি করা জ্বালানি বাবদ প্রতিদিন প্রায় ২৯ কোটি ৫২ লাখ টাকা ব্যয় হচ্ছে। সাদা মান্দার গাছ চাষ করে উৎপাদিত বায়োডিজেল যদি দেশের চাহিদার ২৫ ভাগও মেটাতে সক্ষম হয় তবে বছরে ২৫ কোটি ডলার সাশ্রয় হবে।

সম্প্রতি বিশ্বের কয়েকটি দেশ ব্যাপকভাবে বায়োডিজেলের উৎপাদন শুরু করেছে। এর উৎপাদনের প্রায় পুরোটাই নেতৃত্ব দিচ্ছে ইউরোপিয়ান দেশগুলো। বিশেষভাবে জার্মানির নাম বলা যেতে পারে। ২০০৩ সালের মে মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সব ফসিল ডিজেল চালত যানগুলোতে বায়োডিজেল ব্যবহারের ঘোষণা দিয়েছে। তারা বছরে তিন মিলিয়ন টন বায়োডিজেল উৎপাদন করছে। তা

দের ধারাবাহিকতায় এখন অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, ইনডিয়া, মালয়েশিয়া এবং আমেরিকা এই খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। আফ্রিকা ও এশিয়ার কয়েকটি দেশে ব্যাপক পরিমানে বায়োডিজেল উৎপাদন করতে সক্ষম শুধু যাত্রাফা গাছের ওপর ভিত্তি করে। এই সম্ভাবনা নিরূপণ করে দশটি উন্নয়নশীল দেশে যাত্রাফা উৎপাদন শুরু করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

দেশগুলো হচ্ছে বারকিনা ফাসো, চায়না, ঘানা, ইনডিয়া, লেসোথো, মাদাগাসকার, মালাবি, দক্ষিণ আফ্রিকা, সুইজারল্যান্ড ও জাম্বিয়া।

ইউরোপের ভেজিটেবল ফেডারেশন ফিডিয়লের ভাষ্যমতে, ইইউ’র ধারণা অনুযায়ী এশিয়ার পাম অয়েল ২০ ভাগ বায়োডিজেল জোগান দিতে সক্ষম। মালয়েশিয়ান পাম অয়েল বোর্ড ঘোষণা দিয়েছে যে, যৌথ মালিকানার ভিত্তিতে তারা তিনটি বায়োডিজেল প্ল্যান্ট তৈরি করবে এবং এর প্রতিটি থেকে পাওয়া যাবে বছরে ৬০ হাজার টন যার পুরোটাই বিক্রি হবে ইউরোপে।

হাওরের করচের তেলে বায়োডিজেল : জনশ্রুতি আছে, ‘হিজল-করচ-আড়াং বন, হাওরের মূলধন।’ উপমহাদেশ তথা ভারতে উদ্ভিদটির উৎপত্তিস্থল বলে জানা যায়। ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান, আফ্রিকার পূর্বাঞ্চল, উত্তর অস্ট্রেলিয়া এবং আমেরিকাতেও উদ্ভিদটি বর্তমানে পাওয়া যায়। উষ্ণ ও অব-উষ্ণমণ্ডলের আর্দ্র ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে সাধারণত উদ্ভিদটি জন্মে থাকে।

দীর্ঘ ৫-৬ মাস পানির নিচে থেকেও টিকে থাকতে পারে করচ গাছ। এ প্রজাতিটির লবণাক্ততা সহ্য ক্ষমতা উত্তম। উপকূলীয় অঞ্চলে জমির লবণাক্ততা শোধনে করচ একটি আদর্শ প্রজাতি হতে পারে।

তাই বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে এর গুরুত্ব অনেক। হাওর এলাকার প্লাবনভূমি- সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার বিভিন্ন এলাকায় এ প্রজাতিটির আধিক্য এখনো লক্ষণীয়। চিরসবুজ বন করচ। করচ ঘন ডালপালাবিশিষ্ট বহুবর্ষজীবী বৃক্ষ। করচের তেল বায়োডিজেল হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে বলে বিস্তর গবেষণা চলছে। সুনামগঞ্জ জেলার ১৩৩টি ছোটবড় হাওরে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া হিজল-করচের অনেক গাছ রয়েছে। টাঙ্গুয়ার হাওরে রয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় হিজল-করচের বাগ।

দেশের বৃহত্তম হাওর টাঙ্গুয়া ও হাকালুকিসহ হাওরাঞ্চলে রয়েছে অসংখ্য করচ গাছ। এপ্রিলে করচের ফুল ফোটে। অযত্ন, অবহেলার কারণে হিজল-করচ বাগ হারিয়ে যাচ্ছে। নার্সারিতে চারা উৎপাদন করে পরিকল্পিতভাবে রোপণ করলে হাওরে হিজল গাছ বনায়ন তৈরিতে সহায়ক হবে বলে হাওরবাসীরা মনে করেন। দেশের জ্বালানি তেলের চরম সংকটকালে নতুন এক সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে করচ গাছ। করচের তেল বায়োডিজেল হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব বলে জানা গেছে।

ভারতেও এ তেল কেরোসিনের পরিবর্তে কুপি জ্বালানো, রান্নাবান্না, পাম্প মেশিন চালানো, পাওয়ার ট্রিলার ও ট্রাক্টর চালানো; বাস, ট্রাক ও জেনারেটর চালানোর কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

লেখক : উন্নয়ন গবেষক ও কলাম লেখক
[email protected]

 

Wordbridge School
Link copied!