• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মেঘনার নতুন চরে সবুজ বিপ্লবের স্বপ্ন 


জামাল উদ্দিন বাবলু, লক্ষ্মীপুর ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২৩, ১০:২৩ এএম
মেঘনার নতুন চরে সবুজ বিপ্লবের স্বপ্ন 

লক্ষ্মীপুর: লক্ষ্মীপুরের পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চল ঘিরে রেখেছে দেশের দীর্ঘতম নদী মেঘনা। এ নদী একদিকে সর্বনাশা অন্যদিকে উপকূলবাসীর জন্য আশির্বাদ। যেমন ভাঙনে পূর্ব-পুরুষের ভিটেমাটি তলিয়ে নিয়ে হাজারো মানুষকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। আবার এ নদী থেকেই প্রায় ৬০ হাজার জেলে মাছ শিকার করে জীবিকানির্বাহ করছে। এবার এ নদীই নতুন করে চর দিয়ে ভূমি হারা উপকূলবাসীর চোখে স্বপ্ন জাগিয়েছে। ইতিমধ্যে মেঘনা নদীর নতুন চর কাকড়ায় সবুজ বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে উপকূলের দুই শতাধিক মানুষ। 

স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামি বৈশাখ মাসে চর কাকড়ায় চাষাবাদ শুরু করা হবে। এতে ধান, সয়াবিনসহ বিভিন্ন ধরণের ফসলের বিপ্লব ঘটবে বলে ধারণা করছেন স্থানীয়রা। তাদের দাবি, আল্লাহ তাদের দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছেন। খুব অল্প সময়ে মধ্যে মেঘনার নতুন চর তাদের জীবনে নতুন ভোর নিয়ে এসেছে। এরআগে এতো অল্প সময়ে কখনো নদীতে চর জাগেনি। একই সঙ্গে চরের মাটি পলী ধারা বেষ্টিত। বালির পরিমাণ খুবই কম। ঠিক যেন লোকালয়ে চাষাবাদের জমি মেঘনা তার বুক ছিঁড়ে জাগিয়ে দিয়েছে নদী ভাঙনে সর্বস্ব হারাদের জন্য। 

এদিকে ২৫ জানুয়ারি নতুন চর পরিদর্শনে যান কমলনগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ বাপ্পী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুচিত্র রঞ্জন দাস, সহকারী কমিশনার (ভূমি) এসিল্যান্ড ফেরদৌস আরা, কমলনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সোলাইমান, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবু সাঈদ তারেক, উপজেলা মৎস্য কর্মর্তা আবদুল কুদ্দুস, উপজেলা সার্ভেয়ার প্রমেশ্বর চাকমা, চরফলকন ইউনিয়ন পরিষদের  চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন বাঘা, চরলরেন্স ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আহছান উল্যাহ হিরন ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা আব্দুর রহমান দিদারসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার লোকজন। এসময় চরের বুকে বিভিন্ন প্রজাতির বনজ গাছ রোপন করেন তারা। একই দিন চরের বুকে অর্ধ-শতাধিক মুসল্লি খোলা আকাশের নিচে যোহরের নামাজ আদায় করেন। 

চরে নামাজ আদায় করছেন মুসুল্লিরা

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৩ যুগেরও বেশি সময় ধরে মেঘনা নদীতে ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। এতে সরকারি-বেসরকারি বহুস্থাপনা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। উপজেলার চর কাঁকড়া মৌজা, চরকালকিনি, উত্তর চর কালকিনি, দক্ষিণ চর কালকিনি, দক্ষিণ চর লরেঞ্চ মৌজা নামের কয়েকটি মৌজা পুরোপুরি মেঘনায় বিলীন হয়ে গেছে। এসব এলাকার প্রায় ১০-১২ কিলোমিটার এলাকা নদী গিলে নিয়েছে। পূর্ব-পুরুষের ভিটেমাটিসহ সর্বস্ব হারিয়ে হাজারো মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। এখনো ভাঙন থামেনি। প্রতিদিনই উপকূলের বিভিন্ন এলাকা ভেঙে নদীতে তলিয়ে যাচ্ছে। এরমধ্যে কমলনগর উপজেলার চর লরেন্স ও চরকালকিনি ইউনিয়নের নবীগঞ্জ বাজার থেকে পশ্চিমে মেঘনার বুকে চর কাকড়া মৌঁজায় নতুন চর জেগে উঠেছে। স্থানীয়রা এর নতুন নাম দিয়েছে ‘ক্র্যাব আইল্যান্ড’। এর একটি সাইনবোর্ডও স্থাপন করা হয়েছে চরের বুকে। তবে চরটির আয়তন এখনো জানা যায়নি। খুব শিগগিরই জরিপ করে চরে আয়তন পরিমাপ করা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। 

চর কাকড়ায় জমি হারানো বাসিন্দা আহসান উল্যাহ হিরন, আবদুর রহমান দিদার, হারুনুর রশিদ ডিলার, নুরুল ইসলাম ও বারেক পালোয়ানসহ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। এরমধ্যে আহসান উল্যাহ হিরন জানান, চর কাকড়া মৌজায় তাদের বাড়িসহ কৃষি জমি ছিল। ১০-১২ বছর আগে মেঘনার ভয়াবহ ভাঙনে সব বিলীন হয়ে যায়। এখন সেখানে নতুন করে চর জেগে উঠেছে। সেখানে জমি হারানো বাসিন্দা একত্রিত হয়েছি। এ চরের মাটিও ফসল উৎপাদনের জন্য উপযোগী। নদী ভাঙনের কারণে এ অঞ্চলে চাষের জমি কমে গেছে। নতুন চরে ফসল উৎপাদন করার প্রস্তুতি চলছে।

আহসান উল্লাহ হিরন আরও বলেন, এ চরে ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের খাদ্য সংকট লাঘবে চেষ্টা করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী এক ইঞ্চি জমিও খালি থাকবে না। এ চরে প্রায় হাজারো একর জমি রয়েছে। পুরো জমিই আমরা চাষযোগ্য করে ফসল উৎপাদন করবো।

সাবেক সেনা কর্মকর্তা আবদুর রহমান দিদার সোনালীনিউজকে জানান, এ চরে তারা ফসল উৎপাদনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন। এজন্য বিষয়টি তারা উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনকে অবহিত করেছেন। প্রশাসনের কর্মকর্তারা চর পরিদর্শন করেছেন। ভাতৃপ্রতীমভাবে আমাদেরকে চাষাবাদ করার জন্য প্রশাসন থেকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। 

নদী ভাঙনে ভুক্তভোগী হারুনুর রশিদ ডিলার সোনালীনিউজকে জানান, চর কাকড়ায় চাষাবাদ শুরু হলে মেঘনায় মাছ শিকারী জেলেদেরও নিরাপত্তা বাড়বে। কারণ খালি পড়ে থাকা জনমানবহীবন এ চরে অপরাধীরা আশ্রয় নেয়। এখান থেকেই তারা ডাকাতিসহ বিভিন্ন ধরণের অপরাধ কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়। চাষাবাদ শুরু হলে এখানে মানুষজনের যাতায়াত বাড়বে। একই সঙ্গে অপরাধও কমে যাবে। 

ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত বারেক পলোয়ান জানান, নদী ভাঙনে তাদের প্রায় ১০ একর জমি বিলীন হয়ে গেছে। এখানে চাষাবাদ করে ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি সরকারের কাছে জমি ফিরে পেতে সহযোগীতা চাইবেন। এতে প্রয়োজনীয় আইনের আশ্রয়ও নিবেন তারা। 

চর কাকড়ায় প্রথম নামাজের জামায়াতের ইমাম ছিলেন রামগতি রব্বানিয়া ফাযিল মাদ্রাসার উপাধ্যক্ষ নুরুল ইসলাম। তিনিও নদী ভাঙনে ভিটেমাটিসহ বিস্তির্ণ ফসলী জমি হারিয়েছেন। তিনি জানান, এ চর দিয়ে আল্লাহ তাদের প্রতি দয়া করেছেন। নতুন করে স্বপ্ন দেখার আশা জাগিয়েছে। এ চর ভাঙন কবলিত উপকূলবাসীর জন্য আল্লাহর রহমত। এখানে ফসল উৎপাদনে সবুজ বিপ্লব ঘটবে বলে আশাবাদি তিনি। 

কমলনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুচিত্র রঞ্জন দাস সোনালীনিউজকে জানান, চরের জমি সরকারের মালিকানা। আপাতত এতে কারও ব্যক্তি মালিকানা নেই। খুব শিগগিরই জমি পরিমাপের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে কথা বলা হবে। এরপর জমিগুলো জেলা প্রশাসনের এখতিয়ারভুক্ত হবে। পরে এ মৌজার পূর্ব মালিকানাধীন লোকজন সঠিক কাগজপত্র দেখাতে পারলে আইন অনুযায়ী তাদেরকে জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হবে। এরআগে খাদ্যসংকট দূর করার লক্ষ্য ভাতৃপ্রতীমভাবে এ চরে সবাই চাষাবাদ করে ফসল উৎপাদন করতে পারবে। তবে কোন ধরণের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটানো যাবে না। ঐক্যবদ্ধ হয়ে চাষাবাদ করে ফসল উৎপাদন করতে হবে। 

সোনালীনিউজ/এম

Wordbridge School
Link copied!