• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আজও দাঁড়িয়ে আছে পাবনার জোড় বাংলা মন্দির


সাখাওয়াত হোসেন, পাবনা মার্চ ৯, ২০২৩, ১১:৩৭ এএম
আজও দাঁড়িয়ে আছে পাবনার জোড় বাংলা মন্দির

পাবনা: পদ্মা নদীর কোলঘেঁষে ইতিহাস-ঐতিহ্যে ভরপুর জেলা পাবনা। সুপ্রাচীনকাল থেকেই ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে এই জেলার রয়েছে বেশ সুনাম। অনেক দর্শনীয় স্থানও রয়েছে এখানে। রয়েছে বহু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনও। সেসব ইতিহাস-ঐতিহ্য হাতছানি দিয়ে ডাকে এখনো। ‘জোড় বাংলা মন্দির’ পাবনার অন্যতম আকর্ষণ।

পাবনা শহরের কালাচাঁদ পাড়া এলাকায় কালের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে জোড় বাংলা মন্দিরটি। ব্রজমোহন ক্রোড়ী মন্দিরটি নির্মাণ করেন। তিনি ছিলেন মুর্শিদাবাদের নবাব পরিবারের তহশীলদার। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের তথ্য মতে, আঠারো শতকের মাঝামাঝিতে এর নির্মাণ। মন্দিরের অভ্যন্তরে শিলালিপি না থাকায় এর সঠিক নির্মাণকাল জানা যায়নি।

কালাচাঁদপাড়ার অবস্থান পাবনা শহর থেকে দুই কিলোমিটার দূরে উত্তর-পূর্বদিকে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় স্বকীয় সত্তা নিয়ে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে জোড় বাংলা মন্দির। এই মন্দির এক সময়ের বৃহৎবঙ্গের সমাজ জীবনের সাক্ষী। অমূল্য প্রত্নসম্পদ।

জোড় বাংলা মন্দিরকে খোলা জায়গায় একটি মঞ্চের ওপর স্থাপন করা হয়েছে। মন্দিরটির আকর্ষণীয় দিক হলো এর ছাদ। মন্দিরের ছাদ দোচালা প্রকৃতির। মন্দিরের সামনে রয়েছে তিনটি প্রবেশপথ, যা দুটি স্তম্ভের সাহায্যে নির্মাণ করা হয়েছে। আগে এর প্রবেশপথ কারুকার্যমতি টেরাকোটায় পরিপূর্ণ ছিল কিন্তু এখন তা আগের মতো নেই। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে এই মন্দিরের বেশ ক্ষতি হয়। তা ছাড়া কালের পরিক্রমায় মন্দিরটি সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। এই জেলায় যতগুলো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে, তার মধ্যে ‘জোড় বাংলা মন্দির’ অন্যতম। 

এর দুটি দোচালকে সংযুক্ত করে মন্দিরের ওপরের ছাদ নির্মিত হয়েছে। বেদীর ওপর নির্মিত মন্দিরের সামনের প্রকোষ্ঠ ৭.৩১ মিটার/ ৭.৯২ মিটার এবং পশ্চাতের প্রকোষ্ঠ ৬.১২/ ২.২৮ মিটার আয়তনে ৭.০১ মিটার উঁচুতে তৈরি মন্দিরটির দুটি কক্ষের সামনের কক্ষ মো-প এবং পশ্চাতেরটি গর্ভগৃহ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ম-পের সম্মুখ দেয়ালে তিনটি খিলান প্রবেশপথ রয়েছে। অনুরূপভাবে গর্ভগৃহের উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে একটি করে এবং ম-প ও গর্ভগৃহের মধ্যস্থলে আরো একটি প্রবেশপথ রয়েছে। মন্দিরের ছাদে দুটি দোচালা ব্যবহৃত হয়েছে। দোচালার বহির্বিভাগ বেশ বাঁকানো এবং দরজার উপরাংশে বহু ভাঁজের সুচালা খিলান রয়েছে। মন্দিরটি দুদিকে ৮টি করে ১৬টি স্তম্ভ রয়েছে।

মন্দিরের দেয়াল পোড়ামাটির চিত্রফলক দ্বারা অলঙ্কৃত। বহু ভাঁজের খিলান দরজার ওপর রামায়ণ ও মহাভারতে বর্ণিত যুদ্ধের ভিত্তিমূলে পৌরাণিক ও সামাজিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এই মন্দিরের দক্ষিণ দিকে রয়েছে একটি পুকুর, যা কানা পুকুর নামে পরিচিত। কানা পুকুর ‘জোড় বাংলা মন্দির’ থেকে ৫০ মিটার দূরে অবস্থিত। কালাচাঁদপাড়া মহল্লায় এই মন্দিরটি আছে বলে এই পাড়াকে জোড় বাংলা পাড়া নামেও পরিচিত।

এই মন্দিরের অভ্যন্তরে কোনো শিলালিপি নেই, যার কারণে এর নির্মাণ সাল, নির্মাতা সম্পর্কে কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। জনশ্রুতি আছে আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রজমোহন ক্রোড়ী নামক একজন ‘জোড় বাংলা মন্দির’ নির্মাণ করেন, যিনি ছিলেন মুর্শিদাবাদ নবাবের তহশিলদার।

জানা গেছে, সপ্তদশ শতকে মন্দিরের নকশায় জোড় বাংলা নামের স্থাপত্যশৈলী লক্ষ করা যায়। স্থাপত্যের স্থায়িত্বের কথা চিন্তা করে ছাদে দুটি চালাকে একসঙ্গে জোড়া দিয়ে দেওয়া হতো। তাই একে জোড় বাংলা বলা হতো এবং এখনো বলা হয়। জোড় বাংলা মন্দিরের স্থাপত্যশৈলীর নমুনা পাওয়া যায় পাবনায়, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায়, বাঁকুড়ায়, পুরুলিয়া ও হুগলি জেলায়।

পাবনার জোড় বাংলা মন্দিরে বর্তমানে পূজা-অর্চনা করা হয় না। তবে কারো কারো মতে, আগে এখানে নিয়মিত পূজা হতো। অভ্যন্তরে গোপীনাথের মূর্তি, রাধা-কৃষ্ণের মূর্তি ছিল। তাই মন্দিরটি গোপীনাথের মন্দির বলেও পরিচিত ছিল। এখন আর এই নামে কেউ চেনে বলে মনে হয় না। অন্যমতে, এই মন্দিরের অভ্যন্তরে কখনো পূজা-অর্চনা হতো না। এটি শুধু পরিত্যক্ত স্থাপনা কিংবা মঠ হিসেবেই দাঁড়িয়ে ছিল খোলা স্থানে। তবে স্বীকার করতে হবে, এই মন্দিরটি ভাস্কর্যশিল্পের উজ্জ্বল উদাহরণ। কারণ মন্দিরটির নির্মাণশৈলী তাই বলে।

মন্দিরটি আকার-আকৃতিতে ছোট হলেও পোড়া মাটির ইট দিয়ে কারুকার্যখচিত নকশা দারুণভাবে আকর্ষণ করে দর্শনার্থীদের। ইমারতের ভেতরের রুমগুলো বেশ অপ্রশস্ত। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর অনাদরে-অবহেলায় পড়েছিল এই মন্দির। যার ফলে মন্দিরের হাবভাব, মেজাজ, কারুকার্যের বেশ পরিবর্তন হয়ে যায়। পরে পাবনার জেলা প্রশাসকের প্রচেষ্টায় ১৯৬০ সালে এই মন্দিরের আমূল সংস্কার করা হয়।

বর্তমানে মন্দিরটির বাইরের অংশ দেখলেই বোঝা যায় আর্দ্রতায় ও বৃষ্টির কারণে কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে পোড়ামাটির ফলক। অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও মন্দিরের কারুকাজে যেন কিছু একটা নিহিত রয়েছে। এই মন্দিরটি ইতিহাস ও সময়ের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রতি বছর অসংখ্য পর্যটক একবারের জন্য হলেও এই মন্দির দেখতে আসে। কারণ এটি সপ্তদশ শতক কিংবা আঠারো শতকের স্থাপত্যশৈলী নিয়ে আজও উজ্জ্বল রয়েছে।

প্রতিদিনই দর্শনার্থীরা মন্দিরটি দেখতে আসেন। রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকার আলুপট্রি থেকে দেখতে আসা শ্রী সুমন কুমার ঘোষ বলেন, জোড় বাংলা মন্দির পাবনা জেলার অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন। এই মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী দেখে পুরনো স্থাপত্যশৈলীর ধারণা পাওয়া যায়। ইতিহাসের খোঁজ করতেই মূলত এই মন্দিরটি দেখতে আসা। মন্দিরটি ছোট হলেও এর কারুকার্যগুলো অসাধারণ সুন্দর। ‘শহরের মধ্যে এই ধরনের স্থাপত্য খুব বেশি দেখা যায় না। মাঝেমধ্যে এখানে ঘুরতে আসি। এখানে এলে সময়টা যেমন ভালো কাটে, তেমনি ইতিহাসের ভেতরে নিজেকে হারিয়ে ফেলি।’

শ্রী সুমন কুমার ঘোষ আরো বলেন, মন্দিরের প্রবেশপথ এবং এর সংলগ্ন দেয়াল টেরাকোটার কারুকার্যে পূর্ণ। এই মন্দিরের দেয়ালের নকশা এবং টেরাকোটার কাজ দিনাজপুরের কান্তজির মন্দিরের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। বহুজ ভাঁজ বিশিষ্ট খিলান দরজার ওপরে রামায়ণ ও মহাভারতে বর্ণিত যুদ্ধের চিত্র এবং পৌরাণিক কাহিনি চিত্রিত হয়েছে। মন্দিরের স্তম্বগুলোর ভিত্তিমূলে পৌরাণিক ও সামাজিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

সোনালীনিউজ/এসএইচ/এসআই

Wordbridge School
Link copied!