• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মেসির আর্জেন্টিনা আমাদের দেখতে শুরু করেছে


লিমন আহমেদ ডিসেম্বর ১২, ২০২২, ০৩:১৪ পিএম
মেসির আর্জেন্টিনা আমাদের দেখতে শুরু করেছে

ঢাকা: সেই ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি কিছু চুলকানিবাজি মুরুব্বি আর কিছু বাতিল মাল টিপ্পনি কাটতো। বলতো, আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল করে কি হবে? তোদের দেশের নামও তো জানে না তারা! তোদের ভাত-কাপর জুটবে এসব নিয়ে লাফালাফি করে? অনেকে লজ্জা দিতো ম্যারাডোনা বাংলাদেশ চিনে না বলে!!

সেইসব লোকদের জন্য আজকের এই পোস্ট। ভালোবাসা যে কোনোদিন বৃথা যায় না, অপচয় হয় না তার প্রমাণ মিলছে। ফুটবলের হাত ধরে পৃথিবী একটা গ্রাম হয়ে উঠেছে, একটা পরিবার হয়ে উঠেছে। হাজার হাজার মাইল দূরের মেসি-নেইমারদের জন্য বাংলাদেশ বা বিশ্বের নানা প্রান্তে উচ্ছ্বাস হয়, মিছিল হয়। এতে করে ভালোবাসাটা ছড়িয়ে যাচ্ছে সবখানে। বাংলাদেশ থেকে চোখ বন্ধ করলেই আমরা মেসির আর্জেন্টিনাকে দেখতে পাই, কাতারের মাঠগুলো দেখতে পাই। অনেকটা দেরিতে হলেও মেসির আর্জেন্টিনা আমাদের দেখতে শুরু করেছে। এটাই নিঃস্বার্থ ভালোবাসার ক্ষমতা। সে সংক্রমিত হয়, সে দূরত্ব কমিয়ে দেয়।  

চলতি বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার মানুষ, মিডিয়া, ফুটবল টিম বাংলাদেশের ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়েছে। তারা তাদের পতাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে মাঠে গেছে। সেই পতাকা উড়িয়ে তারা বাংলাদেশ বাংলাদেশ স্লোগানে আমাদের কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। আর্জেন্টিনার মানুষেরা বাংলাদেশের ক্রিকেট দল নিয়ে ফ্যানগ্রুপ খুলেছে। মোড়ে মোড়ে তারা আমাদের খেলা দেখছে। আমাদের পতাকা উড়াচ্ছে। আমাদের পতাকা তাদের শরীরে এঁকে ঘুরে বেড়াচ্ছে! মেসিদের কোচ আামাদের ভালোবাসার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন।

মেসি ঘোষণা দিয়েছেন তার দেশের জন্য, পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ভক্তদের জন্য তিনি কাপটা জিততে চান। আহা! আহা..! এটা কেবলই ভালোবাসার ক্ষমতা....! কিছু হিংসুটে ও ছোট মনের আর্জেন্টিনা হেটার অবশ্য এসব নিয়েও ট্রল করেছেন। দুটি দেশের আবেগকে তারা খাটো করতে চেয়েছেন। সেটা তাদের অজ্ঞতা। 

তাদের জানিয়ে রাখি, ভালোবাসাবাসির এই গল্প শুধু আমাদের আর্জেন্টিনার সঙ্গেই নয়, ব্রাজিলের সঙ্গেও আছে, জার্মানির সঙ্গেও আছে। গেল বিশ্বকাপে বিরাট পতাকা বানিয়ে জার্মান দূতাবাসের নজর কেড়েছিলেন বাংলাদেশের এক ভাই। গেল বিশ্বকাপে ব্রাজিল ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা দেখে বাংলাদেশের ফুটবলের উন্নয়নে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল ব্রাজিল সরকার। হিংসার কিছু নেই। খালি হাতে, বিনা মূলধনে শুধুমাত্র ভালোবাসার বিনিময়ে এগুলো আমাদের জাতিগত অর্জন।

সবচেয়ে বড় আনন্দের বা সাফল্যের খবরটি হলো, মেজর জিয়ার শাসনামলে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বন্ধু আর্জেন্টিনার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা হয়েছিল। এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশিদের ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে সেই সম্পর্ক আবার জোড়া লাগতে চলেছে। আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সান্তিয়াগো ক্যাফিয়েরো টুইট করে বাংলাদেশে পুনরায় দূতাবাস খোলার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। তিনি স্প্যানিশ ভাষার ওই টুইটে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেনের সঙ্গে নিজের একটি ছবিও সংযুক্ত করেছেন। এই টুইট পড়ে আমার চোখ ভিজে গেছে। আমি আবেগে আক্রান্ত। ফুটবল, ম্যারাডোনা, মেসিদের প্রতি ভালোবাসা খুলে দিয়েছে সম্পর্কের নতুন দুয়ার। 

পৃথিবীটা যে একটা গ্রামে পরিণত হচ্ছে ফুটবলের হাত ধরে সেটার সবচেয়ে মজবুত দৃষ্টান্ত এটা। অচেনা-অজানা দেশের পতাকা উড়িয়ে, ভালোবাসা দিয়ে মিছিল করে কি হবে যারা জানতে চাইতেন, তারা এখান থেকে উত্তর নিতে পারেন।

আমি আবেগে আক্রান্ত! আমি আশা করছি আর্জেন্টিনা-বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক নতুন করে বন্ধুত্বের নতুন গল্প তৈরি করবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তাদের যে সমর্থন ও ভূমিকা, তাদের ফুটবলের প্রতি আমাদের যে ভালোবাসা তা বুকে ধরে এই বন্ধুত্ব অনেক বেশি মহিমান্বিত হবে। মেসিদের সঙ্গে আমাদের ফুটবলের সম্পর্কটাও রাষ্ট্রীয়ভাবে গড়ে উঠুক। তাদের সংস্পর্শে মরক্কোর মতো আমরাও একদিন মাথা তুলে যেন দাঁড়াতে পারি ফুটবলের দুনিয়ায়.... 
ফুটবল তোমাকে আমরা ভালোবাসি। তোমাকে ভালোবেসে বেসে আমরা আরও বেপরোয়া হয়ে যেতে চাই 

যারা জানেন না তাদের জন্য

আর্জেন্টাইন বুদ্ধিজীবী, লেখক ও সাহিত্য সমালোচক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের কারণে তিনি বাংলাভাষী মানুষের কাছে বিশেষভাবে আলোচিত ও সমাদৃত। ওকাম্পো আর্জেন্টিনার আধুনিক সাহিত্য আন্দোলন ও নারী অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর বয়স ছিল ৮১ বছর। বয়সের ভারে দুর্বল হয়ে গেলেও ওকাম্পো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের দ্বারা সংঘটিত নৃশংস গণহত্যার প্রতিবাদে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস এইরেসে একটি মিছিলের আয়োজন করেছিলেন এবং মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন তিনি।

ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো বাংলাদেশের পক্ষে আর্জেন্টিনায় জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ১১ জুন আর্জেন্টাইন লেখক, বুদ্ধিজীবী, মানবতাবাদী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের শরণার্থীদের প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতার জন্য আর্জেন্টাইন সরকারকে বাংলাদেশ ও ভারতের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে তাঁদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লুইস মারিয়া ডি পাবলো পারডোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে একটি স্মারকলিপি দেন। (সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, ত্রয়োদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭৩৯)
ওই প্রতিনিধিদল আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে দেওয়া এক স্মারকলিপিতে বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য সাহায্য পাঠানোর দাবি জানিয়েছিল। দাবিনামায় যাঁরা স্বাক্ষর করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রথমেই ছিল ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর নাম। সঙ্গে ছিলেন খ্যাতনামা সাহিত্যিক হোর্হে লুইস বোর্হেস, এদুয়ার্দো সাবাতো, এদোলফো ওবোইতাসহ সেরা লেখক, শিল্পী, আইনজীবী, ধর্মীয় নেতা ও সেই সময়ের বুদ্ধিজীবীদের অনেকে।

সোনালীনিউজ/এম

Wordbridge School
Link copied!