গাজীপুর: আধুনিকতার নিত্যনতুন ছোঁয়ায় পুরো বিশ্বই এখন ডিজিটালের আদলে আলোকিত। এর ন্যায়ে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আমরাও ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল ভোগ করছি। তবে এত উন্নতি ও আকাশ ছোঁয়া অবিশ্বাস্য অগ্রগতির মধ্যেও আজও বাঙালি জাতি বাংলার অসংখ্য লোকসংস্কৃতি এবং তার ঐতিহাসিক গৌরব উজ্জ্বল ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।
এমোনি একটি গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি চোখে পড়ে গেলো আজ গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চা-বাগান বাজারে। সংস্কৃতির প্রেমে আমিও যেনো তাই আটকা পড়ে গেলাম সেই ঐতিহ্যের একটু স্বাদ গ্রহণ করার জন্য।
সোমবার (২০ নভেম্বর) বিকেলে বিশেষ একটি কাজে যাচ্ছিলাম কালিয়াকৈরের ফুলবাড়িয়া এলাকায়। পথে চা-বাগান এলাকায় পৌঁছালে মাগরিবের আজান কানে এসে পড়ে। পরে আমি অটোরিকশা থেকে নেমে পড়ি। এর পর বাজারের পাশেই একটি মাঠে মাগরিবের নামাজ আদায় করি। নামাজ শেষ করে মেইন রোড়ের দিকে ২০০ গজ সামনে এগোতেই দেখি অনেক লোকজন একটি দোকানের সামনে ভিড় জমাচ্ছে। পরে আমি এই দেখে কৌতূহলি হলাম। মনে প্রশ্ন ঘোরপাক খাচ্ছে দেখি একটু গিয়ে দেখি এখানে কি হচ্ছে। পরে আস্তে-আস্তে দোকানের সামনে যেতে থাকি। দোকানের সামনে যেতে মাত্র বাকী ৫ গজ।
এর মধ্যে দুর থেকেই আমার নাকে সুবাশ আসছে যেনো খাঁটি সরিষার গাণি বাঙা তেল আর জনপ্রিয় চেপা শুটকি ভর্তার সুবাতাস। তখন মনে ধারণা জন্ম নিলো। এটা মনে হয় কোন শীতের পিঠার দোকান। যার জন্য অসংখ্য মানুষজন সবাই পিঠা নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে।
আমি পরে একেবারে যখন দোকানের কাছে এসে পড়ি। তখন দেখলাম এমন বুঝতে পারলাম। আসলেই আমার ধারণা সঠিক। ওদিকে ঠিক এই মূহুর্তে দেখতে পেলাম। এক টগবগে যুবক বিশেষ ভাবে মাটি দিয়ে তৈরি তিনটি চুল্লীতে শীতের পিঠা বাজছে। পাশেই দুই একজন লোক মজাকরে গরম-গরম পিঠা কেউ শুটকি ভর্তা কেউবা আবার সরিষা ভর্তা দিয়ে খাচ্ছে। আমি এমন দৃশ্য দেখে একটু অন্য রকম হয়ে গেলাম। জিহবায় ইতিমধ্যে জল চলে এসেছে। মনে হচ্ছে না জানি কত স্বাদ হয়েছে পিঠার। যদি একটা খাওয়ার সিরিয়াল পেয়ে যাই। তাহলে ভালোই হতো।
ওই যুবক পিঠাওলা দোকানদার আমার এমন আনমনা ভাব তখনে বুঝতে পেরে অতি তারাতাড়ি একটি পিঠা চুল্লী থেকে উঠিয়ে ছোট্ট একটি প্লাস্টিকের প্লেটের মধ্যে করে আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন। ভাই ধরেন খান।
পরে আমি সেই পিঠাটি খেলাম। খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার খুদার যে তৃশনা যেনো এক মিনিটেই কমতে থাকলো। পরে মজাদার পিঠার স্বাদ পেয়ে দোকানদারকে বললাম,ভাই আমাকে আরেকটা পিঠা ডিম দিয়ে তৈরি করে দেন। তখন পিঠা বিক্রেতা বললো,ভাই ডিম ছাড়া ১০ টাকা ডিম দিয়ে কিন্ত২০ টাকা পিঠার দাম নিচ্ছি।পরে আমি বললাম ঠিক আছে কোন সমস্যা নেই। ভাই আপনি পিঠা দেন।
পরে এক মিনিট পরে আমি ডিম পিঠাটি পেয়েও গেলাম। তার পর দোকানের পাশেই ক্রেতাদের বসার জায়গায় বসে আস্তে আস্তে পিঠা হাতে ছিড়ে খেতে লাগলাম। এর মধ্যেই ওই যুবকদের সঙ্গে তার পরিবার সম্পর্কে নানান রকমের বিষয় নিয়ে কথা হলো। কথা বলার এক পর্যায়ে পিঠার দোকানদার জানান,তার নাম শফিক সরকার।তিনি এ এলাকারই স্থানীয় বাসিন্দা। তিনি এক সময়ে বেকার ছিলেন। তার কোন কর্ম ছিলোনা। তখন তিনি ভাবলেন। আসলে বসে খেলে বাপের ভিটার ধনও শেষ হয়ে যাবে। তাই তিনি ভাবলেন সম্মানজনক অল্প পুঁজি নিয়ে দোকান করা যায়-কিনা।এর পর তার মাথায় একটি বুদ্ধি চলে আসে। এখন যেহেতু শীতকাল। তাই এ সময়ে মানুষের কাছে শীতের পিঠার অনেক চাহিদা রয়েছে। পরে চা বাগান বাজারের ভিতরে ছোট্ট একটি জায়গা নিয়ে পিঠা বিক্রির দোকান দেই।
তিনি বলেন,এক সময়ে নিজে কোন রকম চলতাম। অর্থের অভাবে পরিবার পরিজন নিয়ে সঠিক ভাবে চলতে পারতাম না। মাত্র ৫ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে এই দোকানটি গড়ে তুলি। এখন আমার এই পিঠা বিক্রির দোকানে দৈনিক মুনাফা হচ্ছে ১ হাজার টাকা। এটা দিয়ে সুন্দর স্বচ্ছল ভাবে পরিবার পরিজন নিয়ে সংসার চলছে।
রসনা বিলাসী বাঙালির চিরায়ত লোকজ খাদ্য সংস্কৃতির সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে মিশে আছে পিঠা। শীতের পিঠা-পুলি বাঙালীর আদি খাদ্য সংস্কৃতির একটা বিশেষ অংশ। যার ধারাবাহিকতায় প্রতিবছর শীতকালে দেশজুড়ে পিঠা তৈরির উৎসব রীতিমত চোখে পড়ার মত। পিঠা নিয়ে ঘটা করে উৎসবও পালিত হয়। শীত আসতেই গ্রামীণ জনপদের প্রতি বাড়িতেই ধুম পড়ে যায় পিঠা তৈরীর।
তবে কালিয়াকৈরের এই পিঠা বিক্রেতা শফিক সরকার বাণিজ্যিক ভাবে পিঠা তৈরি করে সরাসরি অর্থ নৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠার বাস্তবতা একেবারেই যুবসমাজের জন্য আর্শীবাদ হয়ে উঠেছে।
উপজেলার অনেকেই এখন শুধু পিঠা খাওয়ার জন্যই তার দোকানে আসছেন না। অনেকেই আসছেন পুরুষ মানুষ হয়ে। মেয়ের সৌখিন কাজ কি ভাবে তিনি বাণিজ্যিক রূপ দিয়েছেন তার বাস্তব অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্য।অনেক স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন। ইচ্ছে থাকলে ছোট-ছোট দোকান দিয়েও যে বেকার জীবনের অবসান ঘটানো যায়। তার প্রমাণ শফিক। এখানে ১০ টি পিঠা একসঙ্গে কিনতে আসা সুমন নামে এক ক্রেতার সঙ্গে কথা হলো আমার।
এ সময়ে তিনি বলেন,তার পিঠার মান অনেক ভাল। মেয়েদের দোকানের পিঠার চেয়ে তার দোকানের পিঠার দোকানে হরেক রকমের ভর্তা পাওয়া যায়। এ ছাড়া তার দোকানের ডিম পিঠার খ্যাতি এখন চা বাগান বাজারের মধ্যে বিখ্যাত। তিনি বলেন,শুধু আমি না সন্ধ্যা হলেই মেলা মানুষ এই দোকানে ভিড় জমায়।
সুমনের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই আরেক বয়োজ্যেষ্ঠ মোতালেব নামে এক ক্রেতার সঙ্গেও কথা হলো। তিনি বলেন, এই ছেলে পিঠার দোকান দিয়ে এই বাজারে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এখন তার দোকানের পিঠা ছাড়া চেনা মানুষজন পিঠাই কিনেন না।
শুধু শীতের সময়ই চলে তার এই পিঠার ব্যবসা। বছরের বাকি সময়টা তিনি অন্য পেশায় নিয়োজিত থাকেন। তবে শীতের সময়ে প্রতিদিন বিকেল ৩ টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত চলে তার এই পিঠা বিক্রি। আর এই সময়ের মধ্যেই তিনি প্রায় ১-২ হাজার টাকার পিঠা বিক্রি করেন।
তরুণ উদীয়মান পিঠার কারিগর সোনালীনিউজকে জানান, তার মূল পেশা চটপটি, ফুসকা। তবে শীতের সময়ে এটা অনেক কম চলে। তাই যাতে বেকার না থাকতে হয়। সে জন্য তিনি শীতের সময়ে পিঠা বিক্রি করেই জীবিকা নির্বাহ করেন। প্রতি দিন তার দোকানে ১০/১২ কেজি চাউলের পিঠা বিক্রি হয়। দৈনিক ১-৩ হাজার টাকা পর্যন্ত পিঠা বিক্রি করেন। ১০ থেকে শুরু করে ৪০ টাকা দামেরও পিঠা তিনি বিক্রি করছেন।
তরুণ উদীয়মান উদ্যোক্তা আরও বলেন, আমার মতো যারা তরুণ বেকার রয়েছে তারা যদি কাজকে ছোট মনে না করেন। তাহলে শীতে পিঠা বিক্রি করেই মাসে লাখ টাকা অর্থ উপার্জন করতে পারবেন।
সোনালীনিউজ/এম







































