• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৫, ৪ পৌষ ১৪৩২
SonaliNews

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত নিউজ পোর্টাল

যে গানের পূর্ণ রূপ বঙ্গবন্ধুর সম্মানে, শোকগাথা হৃদয়ে


বিশেষ প্রতিনিধি মার্চ ২০, ২০২০, ১১:০৮ পিএম
যে গানের পূর্ণ রূপ বঙ্গবন্ধুর সম্মানে, শোকগাথা হৃদয়ে

ঢাকা : বাঙালির শ্রেষ্ঠতম মহানায়ক ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মানে পূর্ণতা পায় গানটি। শোক ও অশ্রু চেপে গীতিকার চার লাইন থেকে গানটিকে পূর্ণ রূপ দেন বঙ্গবন্ধুর প্রতি অকৃত্রিম ও হূদয়নিংড়ানো ভালোবাসার কারণে। গানটির শিরোনাম—‘তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা, কে বলে আজ তুমি নাই, তুমি আছ মন বলে তাই...।’ বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক ও ভয়ানক অধ্যায় পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ড গানটিকে করে তোলে শোকাহত হূদয়ের আর্তনাদ। কলঙ্কিত ও মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ড না ঘটলে বঙ্গবন্ধুর পরামর্শ ও তার প্রতি মর্যাদা থেকে গানটির বাকি লাইনগুলো হয়তো অন্য রকম হতো।

বঙ্গবন্ধুর পরামর্শে গানটির শিল্পী ও গীতিকার মিলে পূর্ণ করার কালেই ঘটে ওই ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ড, তখন শিল্পী ও গীতিকারের চিন্তা বদলে যায়। হত্যা করার পরও তার অবিনাশী চেতনা ও আদর্শ চির অনির্বাণ হয়ে প্রজ্বলিত থাকবে প্রতিটি বাঙালি-হূদয়ে; তিনি ও বাঙালির অবিভাজ্য সম্পর্কের যেকোনো পরিসমাপ্তি নেই এবং বাঙালির জন্য শেষ পর্যন্ত জীবন দিয়ে মহান আত্মত্যাগের বীরত্বের কথাই উঠে আসে গানটিতে। বাঙালি জাতি শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসায় বাংলাদেশের ইতিহাস বিনির্মাণের কালজয়ী এই মহাপুরুষকে চিরকাল স্মরণ করবে, সে কথাও যেন বলছে গানটি।

‘তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা...’ বঙ্গবন্ধুর প্রিয় গানগুলোর মধ্যে একটি। বিভিন্নজনের স্মৃতিকথা ও তাকে নিয়ে গবেষণাধর্মী নানা লেখায় বিষয়টি এসেছে। নানা কালের শ্রোতাদের কাছে নন্দিত এই গানের শিল্পী পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তুমুল জনপ্রিয়তা পাওয়া শ্যামল মিত্র। কলকাতার ‘অন্তরাল’ সিনেমায় গানটি প্রথম সংযোজিত হয়। সিনেমাটা মুক্তি পায় ১৯৬৫ সালে। সিনেমায় গানটির চার লাইন ব্যবহূত হয়, মূল গানটিই তখনো চার লাইনের ছিল। গানটি খুব ভালো লাগে বঙ্গবন্ধুর। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৪ সালে রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে অংশ নেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায় ও বরেণ্য শিল্পী শ্যামল মিত্র। তাদের দেখা হয় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। তিনি ওই গান তার প্রিয় জানিয়ে শ্যামল মিত্রকে বঙ্গবন্ধু বলেন, গানটির পূর্ণ রূপ দিতে।

ইতিহাসের মহামানব বঙ্গবন্ধুর কথা শ্যামল মিত্র গানটির গীতিকারকে জানান। এরপরই গানটি পূর্ণ রূপ পায়। কে জানত! সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু এমন একটা গানকে পূর্ণ রূপ দিতে বলার মাত্র কয়েক বছর পরই জাতি ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কজনক দিনের মুখোমুখি হবে! একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস পাকিস্তানি জল্লাদরা কারাবন্দী রেখে কবর খুঁড়েও যাকে হত্যা করার সাহস পায়নি; স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় সেই হিমালয়সম ইস্পাতদৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী জাতির পিতাকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একাত্তরের পরাজিত শক্তির পেতাত্মা নরপিশাচ ও ঘাতকরা হত্যা করে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের হয়ে কাজ করা ঘাতকচক্রের বুলেটে সেদিন ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের হূদপিণ্ড। সেদিন বঙ্গবন্ধুকে পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যসহ নরঘাতকরা হত্যা করে। গানটি পূর্ণতা পেলেও এর রেকর্ড শ্যামল মিত্র তুলে দিতে পারেননি তার পরমজন বঙ্গবন্ধুর হাতে। বঙ্গবন্ধুরও তা আর শোনা হয়নি।

গানটির প্রথম চার লাইনের পরের কথায় বঙ্গবন্ধুর বীরত্ব ও তার জন্য হূদয়ের আর্তিই ফোটে ওঠে। ‘ ...তোমারই অমর নাম জয় গৌরবে/ স্মরণে যে চিরদিন জানি লেখা রবে/ মরণে হারায়ে তোমারে খুঁজে পাই/ তোমার জীবন যেন কাহিনির মতো/ হে বিজয়ী বীর ছিল জয় তব ব্রত/ ধূপেরই  মতো যেন মরণের সুখে/ তোমার জীবন তুমি দিলে হাসি মুখে/ এ কথা কখনো যেন না ভুলে যাই’।

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু তার কারিশম্যাটিক নেতৃত্বে ৯ মাসের তুমুল লড়াইয়ের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে হারিয়ে জাতি স্বাধীন ভূখণ্ডের মালিক হয়। তার মহত্তম জীবনবোধ, সততা, সাহস, দক্ষতা ও দূরদর্শী নেতৃত্বে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে ওই সময় তিনি ‘আইকন’ হয়ে ওঠেন। ভারতের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে খ্যাতিমানদের কাছেও সমাদৃত ছিলেন এই নেতা। বিশ্বব্যাপী সমাদৃত এই নেতা জ্বালাময়ী ভাষণ আর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের কারণে ভারতের মানুষের কাছে তারকা হয়ে উঠেছিলেন। ব্যক্তিত্বের কারণে তখনকার ভারতীয় রাজনৈতিক নেতাদের কাছেও মুজিব যেমন ছিলেন অনেক আস্থাভাজন, তেমনই দেশটির শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন গুণীজন ও বিখ্যাত ব্যক্তির সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। ছিল ব্যক্তিগত যোগাযোগ। বঙ্গবন্ধুর আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পর ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ তার কিছু ছবি তাদের আর্কাইভে সংরক্ষণ করে। ২০১৮ সালের মার্চে পত্রিকাটি এসব ছবি প্রকাশ করে। এসব ছবিতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ভারতীয় স্বনামধন্য রাজনীতিবিদসহ সংগীতশিল্পী মাহেন্দ্র কাপুর, প্রখ্যাত অভিনেত্রী হেমা মালিনী, শিল্পী শ্যামল মিত্র ও নির্মাতা সত্যজিৎ রায় প্রমুখকে দেখা যায়।

দেশের ভৌগোলিক স্বাধীনতার মুক্তির সঙ্গে সাংস্কৃতিক মুক্তি ও বিকাশের কথাও ভেবেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাঙালির জাতির জনক হয়ে ওঠার আগে সেই ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন উদার ও অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতিমনস্ক। আজীবন শিল্প ও সাহিত্যের মানুষদের তিনি ভালোবেসেছেন, স্নেহ করেছেন ও মহানুভবতায় পাশে দাঁড়িয়েছেন। দুই বাংলার সংগীতজ্ঞ, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী ও অভিনয়শিল্পীদের তিনি সব সময় উৎসাহ দিতেন বাঙালির মুক্তির লক্ষ্যে ও পাকিস্তানি শোষণের বিরুদ্ধে গান ও কবিতা লিখতে। তিনি গান-কবিতা পছন্দ করতেন সেই প্রমাণ মেলে তাকে নিয়ে নানা গবেষণা ও লেখায়।

সুযোগ হলেই গুনগুন করে তিনি দেশপ্রেম ও মানবতা-বিষয়ক গান গাইতেন বলেও নানাজনের লেখায় উল্লেখ আছে। উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, হিন্দি সংগীতজগতে হেমন্ত কুমার নামে প্রসিদ্ধ, তার মেয়ে রানু মুখোপাধ্যায় সম্প্রতি এক স্মৃতিচারণায় বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান  জেলবন্দি অবস্থায় বাবার (হেমন্ত) গান গাইতেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরই আমরা যখন সপরিবারে সেখানে যাই, মনে আছে বাবাকে দেখে তার (বঙ্গবন্ধু) চোখে জল এসে পড়ে।’

জাতির জনকের গান শোনা ও পছন্দের গান সম্পর্কে তার তনয়া, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কাছ থেকেও জানা যায় ‘হাসিনা: অ্যা ডটার্স টেল’ থেকে। এতে ‘আমার সাধ না মিটিল, আশা না ফুরিল, সকলই ফুরায়ে যায় মা’ শিরোনামের গানটির সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে টুঙ্গিপাড়ার বিভিন্ন দৃশ্য। তথ্যচিত্রের নেপথ্য কণ্ঠে শেখ হাসিনা দর্শকদের উদ্দেশ করে বলেন, ‘বাবা করাচি থেকে ঢাকা ফিরে এলেন। তখন এই গানটা, পান্না লালের গাওয়া— আমার সাধ না মিটিল, আশা না ফুরিল, সকলই ফুরায়ে যায় মা, বারবার শুনে যাচ্ছেন।’

বঙ্গবন্ধু নিজের এক লেখায়ও সংগীত ও শিল্পীদের প্রতি তার ভালোবাসা ও অনুরাগের কথা জানা যায়। তিনি লেখেন— ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার নবীনগর থানার কৃষ্ণনগরে জনাব রকিবুল হোসেন এক সভার আয়োজন করেন কৃষ্ণনগর হাইস্কুলের দ্বারোদঘাটন করার জন্য। ... সেখানে বিখ্যাত গায়ক আব্বাসউদ্দিন, সোহরাব হোসেন ও বেদারউদ্দিন আহম্মদ গান গাইবেন। আমাকেও নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। ... সন্ধ্যায় ... গানের আসর বসল।

আব্বাসউদ্দীন সাহেব, সোহরাব হোসেন সাহেব ও আমরা রাতে রফিক সাহেবের বাড়িতে রইলাম। ...পরের দিন নৌকায় আমরা রওয়ানা করলাম, আশুগঞ্জ স্টেশনে ট্রেন ধরতে। পথে পথে গান চলল। নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তাঁর নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলিও যেন তাঁর গান গাইছে। তাঁরই শিষ্য সোহরাব হোসেন ও বেদারউদ্দিন তাঁর নাম কিছুটা রেখেছিলেন। আমি আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম।

তিনি আমাকে বলেছিলেন- মুজিব, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ যে গানকে তুমি ভালোবাস, এর মাধুর্য ও মর্যাদাও নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে। আমি কথা দিয়েছিলাম এবং কথা রাখতে চেষ্টা করেছিলাম’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ইউপিএল, পৃষ্ঠা- ১১১)।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!