• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার টিকা ও নির্ভরশীলতা তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা


মো. শফিকুল ইসলাম নিয়ামত জুলাই ২৫, ২০২১, ০২:৩৫ পিএম
করোনার টিকা ও নির্ভরশীলতা তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা

ঢাকা : আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ‘নির্ভরশীলতার তত্ত্ব’ নামে একটি তত্ত্ব আছে। মার্কসবাদীয় দৃষ্টিকোণে Dependency Theory আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে একটি অবিরত দ্বন্দ্বের ক্ষেত্র হিসেবে পরিগণিত করে। মার্কসবাদ থেকে যে মূল সূত্রটি গ্রহণ করা হয়েছে তা হলো বিশ্বরাজনীতিতে সংঘর্ষ ঘটে চলছে দুটি অর্থনৈতিক শ্রেণির দ্বারা। দুর্বলতর শ্রেণির শোষণ ইতিহাসের সত্য বিশ্বরাজনীতিতে প্রকাশিত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী একটি কাঠামোর মাধ্যমে সারা বিশ্বের ধনিক শ্রেণির দ্বারা নির্ধনের শোষণ অব্যাহত রয়েছে। এই কাঠামোটি বজায় রাখতে শুধু শোষক নয়, শোষিতরাও অংশগ্রহণ করে চলেছে। ফলে একদিকে যেমন কতিপয় জাতি সম্পদে, উৎপাদনে, প্রযুক্তিতে এবং সামরিক শক্তিতে উন্নত; অন্যদিকে অসংখ্য দরিদ্র জাতি অভাবে মূলধনের ঘাটতিতে, বেকার শ্রমিকের বোঝায় সম্পূর্ণভাবে পশ্চাৎপদ হয়ে রয়েছে। কোনো একটি দেশের অতি উন্নয়ন তখনই সম্ভব যখন আরো অনেক দেশকে উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত রাখা হয়। যতদিন বিশ্বে ধনতন্ত্র কায়েম থাকবে, ততদিন ধনতন্ত্রের উৎসমুখ পশ্চিমা শিল্পায়িত সমাজগুলো উন্নতির শীর্ষে অবস্থান করবে।

বর্তমান বিশ্ব এক ভয়ানক অবস্থার মধ্যদিয়ে অতিক্রম করছে। চীনের উহান থেকে ২০১৯ সালে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়। এ পর্যন্ত কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, অসংখ্য মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। আশার কথা হলো, বিজ্ঞানীরা প্রাণপণ চেষ্টা করে এর প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু ধনী দেশগুলো তাদের এই আবিষ্কারের পেটেন্ট অন্য দেশকে দিতে আগ্রহী নয়। সারা বিশ্ব থেকে করোনা মহামারি দ্রুত শেষ হয়ে যাক এই নিমিত্তে বিভিন্ন জোট করলেও, মিডিয়ার সামনে বড় বড় কথা বললেও, বাস্তবতায় সবাই স্বার্থপরের মতো আচরণ করছে।

যেখানে বিশ্বের বহু দেশে এখনো কোভিড-১৯-এর প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ টিকাই দেওয়া হয়নি, সেখানে বিশ্বের ধনী দেশগুলো বুস্টার ডোজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ধনী দেশগুলোর এমন ‘কাণ্ডজ্ঞানহীন লোভী’ দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে বলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান (ডব্লিউএইচও) টেডরস আধানম গ্যাব্রিয়েসাস। কোভিড-১৯ মহামারি এখন বিশ্ব রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এ সুবিধাকেই সক্রিয়ভাবে কাজে লাগাতে চাইছে চীন, ভারত ও রাশিয়া। কেবল পররাষ্ট্র নীতিমালা নিয়ে আপসের মাধ্যমে নয়, বরং টিকার বদলে তারা নিজেদের অনুকূলে ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার পুনর্গঠনেও মনোযোগ দিয়েছে। চীন ও রাশিয়া ছাড়া আরো কয়েকটি দেশ একইভাবে টিকাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। কূটনৈতিকভাবে আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে ভারত প্রথমদিকে বিভিন্ন দেশকে টিকা উপহার দিলেও, তাদের দেশে সংক্রমণ অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ার পর টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্র ভারতে টিকা তৈরির কাঁচামাল দেওয়া বন্ধ করলে ভারত নিজেদের চাহিদা মেটাতে সমস্যার সম্মুখীন হয়। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় রাশিয়া ও চীনের করোনা টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। চলমান সংকট বিবেচনায় এটিই ছিল সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। সরকার আশা করেছে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশ চীন ও রাশিয়ার টিকা পাবে।

এসবের পাশাপাশি জরুরি প্রয়োজন মেটাতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উৎপাদিত ৪০ লাখ ডোজ টিকা চেয়েছিল বাংলাদেশ সরকার। তবে চীন বা রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তিকে যুক্তরাষ্ট্র সুনজরে নাও দেখতে পারে। ভূরাজনীতিতে এই দেশগুলোর অবস্থান পরস্পরবিরোধী। বিশ্ব যখন এই সংকটময় মুহূর্ত পার করছে তখনো ধনী দেশগুলো তাদের অমানবিক আচরণ বন্ধ করতে পারেনি। যারা মানবতার কথা বলে, বিশ্ব শান্তির কথা বলে তারাই পৃথিবীর এই ক্রান্তিলগ্নে সাম্যের গান গাইতে পারছে না। যতদিন পৃথিবীতে ধনতান্ত্রিক পুঁজিবাদ বিদ্যমান থাকবে ততদিন সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে না। সম্পদ কুক্ষিগত হবে। এক পক্ষের শরীর মন সতেজ থাকবে, অন্যপক্ষ জীর্ণশীর্ণ দেহ নিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনবে।

মার্কসের ‘নির্ভরশীলতা তত্ত্বে’র বিশ্লেষণটা পুরোপুরি এই সংকটের মধ্যে মিলে যাচ্ছে। ধনতান্ত্রিক দেশগুলির নগ্নরূপ সবাই দেখতে পাচ্ছে। মানুষের অসহায়ত্বকে কাজে লাগিয়েও তারা অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ধান্দা করতে পিছপা হচ্ছে না। যেহেতু বিশ্বরাজনীতিতে দুটি অর্থনৈতিক শ্রেণির সংগ্রাম চলছে, সেহেতু দুর্বল গরিবদের করোনার টিকা এবং অন্যান্য সরাঞ্জাম পেতে সবল ধনতান্ত্রিক পুঁজিবাদী পশ্চিমা বা অন্যান্য দেশের ওপর নির্ভরশীল হতেই হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!