• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হেমন্ত, অগ্রহায়ণ, নবান্ন এবং কৃষি অর্থনীতি


এস এম মুকুল নভেম্বর ১০, ২০২১, ০১:০৩ পিএম
হেমন্ত, অগ্রহায়ণ, নবান্ন এবং কৃষি অর্থনীতি

ঢাকা : প্রকৃতিতে ঋতু হেমন্তের প্রভাব শুরু হয়েছে। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের সাথে হেমন্ত ঋতুর সম্পর্কটি কৃষি অর্থনীতির ক্ষেত্রে আভিজাত্যও বটে। হেমন্ত কেবল প্রকৃতিতে পরিবর্তনের আবহ তৈরি করে তা নয়, হেমন্ত কৃষকের ঘওে নতুন ধানের আনন্দ তুলে আনে। প্রকৃতির হিম হিম আভার সাথে প্রশান্তি আনে কৃষকের মনে। কারণ হেমন্ত কৃষকের জন্য ফসলে সমৃদ্ধ ঋতু। এই হেমন্তে কৃষকের গোলায় নতুন ধান উঠতে শুরু করে অপর দিকে শীতের শাক-সবজির পরিচর্যাও শুরু হয়।

পল্লীকবি জসীম উদদীন হেমন্তে মাঠ ভরা ফসলের সম্ভারে মুগ্ধ হয়ে বলেছেন-

‘আশ্বিন গেল কার্তিক মাসে পাকিল ক্ষেতের ধান,

সারা মাঠ ভরি গাহিছে কে যেন হলদি-কোটার গান।

ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়িছে বায়,

কলমীলতায় দোলন লেগেছে, হেসে কূল নাহি পায়।’

সত্যিই হেমন্তের আগমনে কৃষক-কৃষাণির মনে আনন্দের কূল নাই। কারণ ১ অগ্রহায়ণ ১৪ নভেম্বর নবান্ন উৎসবের দিন। ধারণা করা হয় একসময় অগ্রহায়ণ মাসই ছিল বাংলা বছরের প্রথম মাস। বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক সভ্যতার নিদর্শন  ও ঐতিহ্যবাহী শস্য উৎসব হলো নবান্ন। ‘নবান্ন’ মানে ‘নতুন অন্ন’ বা নতুন ‘ধানের চালের অন্ন’। অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম দিনে কৃষক নতুন আমন ধান ঘরে তোলার সময় এ উৎসব পালন করা হয় প্রাচীনকাল থেকে।

বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ। আমাদের কৃষক সমাজে অগ্রহায়ণ মাস কৃষকদের উপহার নতুন সোনালি ধানের আনন্দ। অঘ্রানে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে ফসলের সমৃদ্ধতার বিষয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও লিখেছেন- ‘ওমা অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কি দেখেছি মধুর হাসি’। কবির ভাষায় এই ফসলের হাসি আর সেই আনন্দে হাসি ফোটে কৃষকের মুখেও। কিন্তু কাল পরিক্রমায় হারিয়ে গেছে কৃষকের ঐতিহ্যবাহী রীতি রেওয়াজ। গ্রামীণ জনপদে ফসলের মাঠ আছে কিন্তু কৃষকের ঘরে নবান্নের সেই আগেকার আয়োজন নেই। কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসব।

সময় বদলে গেছে। বলদ আর লাঙ্গল-জোয়ালে চাষাবাদের বদলে মাঠে নেমেছে ট্রাক্টর মেশিন, নিড়ানি যন্ত্র, ধানের চারা রোপণ এবং মাড়াই যন্ত্রের দাপট এখন কৃষকের কৃষি উৎপাদনকে করেছে আরো সহজ। ডিজিটাল যুগে ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত এখন গ্রামবাংলা। অনলাইন, ইন্টারনেট আর মোবাইল ফোন কৃষিসেবায় যোগ করেছে নতুন মাত্রা। তাই এখন খরপোষের কৃষি ক্রমেই বাণিজ্যিক কৃষির দিগন্ত উন্মোচন করেছে। তাই উন্নত বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার অন্যতম সঞ্চালক শক্তি কৃষি ও কৃষকদের জানাই লাল সালাম। ২০২১ সালের অগ্রহায়ণের প্রথম দিনের প্রত্যাশা-  বাংলাদেশে ঋতুবৈচিত্র্যে হেমন্ত আসুক বারে বারে অপার সম্ভাবনা আর সমৃদ্ধির বার্তা নিয়ে।

অঘ্রানে নতুন আমন তুলতে ব্যস্ত কৃষক : হেমন্তের শুরুতেই দেশের বিভিন্ন জেলায় শুরু হয়েছে আগাম জাতের আমন ধান কাটা। কৃষক ও র্কষাণিদের ব্যস্ত সময় কাটছে ফসল ঘরে তোলার কর্মযজ্ঞ নিয়ে। জানা গেছে, বন্যার কারণে অনেক জেলায় এ বছর রোপা আমনের আবাদ কিছুটা বিলম্বে হলেও বাম্পার ফলনে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের আশা প্রকাশ করেছে কৃষি বিভাগ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী এ বছর ৫৫ লাখ ৭৭ হাজার হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। চাষাবাদ হয়েছে ৫৬ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমিতে। রোপা আমন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১ কোটি ৪৭ লাখ ৫২ হাজার ২২০ টন এবং বোনা আমনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ টন। সব মিলিয়ে এ বছর আমনের লক্ষ্যমাত্রা ১ কোটি ৫১ লাখ ৫২ হাজার ২২০ টন। এর মধ্যে হাইব্রিড জাতের ধান চাষ হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৯ লাখ ১১ হাজার ৪০০ টন। উফশী জাতের ধান চাষ হয়েছে ৪৫ লাখ ৩২ হাজার হেক্টর জমিতে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ কোটি ২৬ লাখ ২১ হাজার ৬২০ টন। স্থানীয় জাতের ধান চাষ হয়েছে ৮ লাখ হেক্টর জমিতে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১২ লাখ ১৯ হাজার ২০০ টন। গত ৩১ অক্টোবর খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৭ নভেম্বর থেকে আমন ধান ও চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়েছে। এ সময় ৩ লাখ টন আমন ধান, ৫ লাখ টন সেদ্ধ চাল কেনা হবে। সরকারি ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ধান প্রতিকেজি ২৭ টাকা ও চাল প্রতিকেজি ৪০ টাকা।

ঐতিহ্যের সম্ভারে নবান্ন : কার্তিকের শেষ সপ্তাহ থেকেই শুরু হয়ে যেত ধান মাড়াইয়ের কাজ, চলত বাড়িঘর, ঢেঁকিঘর নিকানোর কাজ। নতুন ধান থেকে চাল ছাঁটা হতো ঢেঁকিতে। তৈরি করা হতো চালের গুঁড়া। চালের গুঁড়া দিয়ে পিঠে তৈরি হতো নবান্নে। এছাড়া চালের গুঁড়া দিয়ে আঁকা হতো মাঙ্গলিক আলপনা। বাড়ির মহিলা সদস্যরা ব্যস্ত থাকতেন চিঁড়ে, মোয়া, নাড়ু এসব তৈরিতে। একসময় নবান্ন উৎসব উপলক্ষে চলতো খন ও বিষহরি পালাগানের আসর, বসত মেলাও। নবান্নে পাকা ধান দেখে চাষি আনন্দে গেয়ে উঠত। ‘নবান্ন’ উপলক্ষে নতুন চালের তৈরি পায়েশ-পোলাও, পিঠা-পুলিসহ রকমারি খাদ্যসামগ্রী পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হয়। পাশাপাশি পালন করা হয় সামাজিকভাবে প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী নানা আচার-অনুষ্ঠান। ধর্মীয় রীতি-নীতি অনুযায়ী এসব আচার- আনুষ্ঠানিকতায় বৈচিত্র্য রয়েছে। মুসলিম কৃষক সমাজে নতুন ফসল ঘরে ওঠার জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্য বাড়ি বাড়ি কোরআনখানি, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল, মসজিদ ও দরগায় শিরনির আয়োজন করা হয়। হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী অন্ন লক্ষ্মীতুল্য। তাই তারা এ দেবীর উদ্দেশ্য পূজা-অর্চনার আয়োজন করে। এছাড়া নবান্ন অনুষ্ঠানে নতুন অন্ন পিতৃপুরুষ, দেবতা, কাঁক ইত্যাদি প্রাণীকে উৎসর্গ করে এবং আত্মীয়জনকে পরিবেশন করার পর গৃহকর্তা ও পরিবার নতুন গুড়সহ নতুন অন্ন গ্রহণ করেন। নতুন চালের তৈরি খাদ্যসামগ্রী কাঁককে নিবেদন করা নবান্নের অঙ্গ একটি বিশেষ লৌকিক প্রথা। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, কাঁকের মাধ্যমে ওই খাদ্য মৃতের আত্মার কাছে পৌঁছে যায়। এই নৈবেদ্যকে বলে ‘কাঁকবলী’।

কৃষিতেই সমৃদ্ধি, কৃষিই অর্থনীতির ভরসা : করোনাকালের মহাবিপর্যয়ের মধ্যে মার্কিন কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ) পূর্বাভাসে বাংলাদেশের জন্য একটি আশার বাণী শুনিয়েছে। ধারাবাহিকভাবে ধান উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ তৃতীয় বৃহত্তম ধান উৎপাদনকারী দেশ। এতদিন চীন ও ভারতের পরই তৃতীয় স্থানে ছিল ইন্দোনেশিয়া। ইউএসডিএ’র প্রতিবেদনমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে সারা বিশ্বে ধানের উৎপাদন ৫০  কোটি ২০ লাখ টন ছাড়াতে পারে। খাদ্যশস্য উৎপাদনের হিসাব অনুযায়ী এখনও ধান চাষে গ্রাম বাংলার ৪৮ ভাগ মানুষের কর্মসংস্থান হয়। বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষি খাতের যে অংশগ্রহণ তার অর্ধেক এবং জাতীয় আয়ের ছয় ভাগের এক ভাগ আসে ধান থেকে। দেশের ১ কোটি ৩০ লাখ পরিবার প্রতিবছর ১ কোটি ৫ লাখ হেক্টর একর জমিতে ধান চাষ করছে।

কৃষি বাংলাদেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে আছে। এদেশের অধিকাংশ মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না কৃষির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কাজেই আমাদের বাঁচতে হলে ‘কৃষি বিপ্লব’ সফল করেই বাঁচতে হবে। সুদীর্ঘকাল থেকেই কৃষি আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। কেননা মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৪.২৩ শতাংশ। কৃষি শুমারি ২০১৯ এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুয়ায়ী, দেশের মোট পরিবারের ৪৬ দশমিক ৬১ শতাংশ পরিবার কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে ৫৩ দশমিক ৮২ শতাংশ গ্রামে, ১০ দশমিক ৪৬ শতাংশ শহরে বাস করে।  এতেই প্রমাণিত হয় কৃষি আমাদের জীবন ও অর্থনীতিতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই কৃষির উন্নতি মানেই দেশের উন্নতি।

বাংলাদেশ কৃষিনির্ভরতার কারণেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা এবং মহামারি করোনায় দেশের অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলতে না পারার অন্যতম কারণ খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জন। কৃষির অন্যতম সাফল্য হলো- দেশে ধান উৎপাদনে এসেছে বিপ্লব। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে এ পর্যন্ত ধানের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চারগুণ। আমরা জানি বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে কৃষি, তৈরি পোশাকশিল্প এবং রেমিট্যান্সের ওপর। এদের মধ্যে তৈরি পোশাক ও রেমিট্যান্স ওঠানামা করে। তবে কৃষি অনেকটাই স্থায়ী পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। কারণ হিসেবে দেখা গেছে, নানারকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর আবহাওয়ার প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কৃষি কোনো না কোনোভাবে উৎপাদনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারছে। বিভিন্ন গবেষণা তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কৃষি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দীর্ঘ বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে প্রকৃতি ও জনসংখ্যার সঙ্গে সমন্বয় রাখতে ক্রমাগতভাবে যুদ্ধ করে এগিয়ে চলেছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, স্বাধীনতার আগে দেশে সাড়ে সাত কোটি মানুষের খাদ্য উৎপাদন চাহিদায় হিমশিম খেতে হতো, অথচ স্বাধীনতার চার দশক পর ১৭ কোটি মানুষের খাদ্যের চাহিদা মেটাতে সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা। উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা ডেভরেসোন্যান্সলি’র গবেষণায় দেখানো হয়েছে, কৃষকরা তাদের কৃষিজমিতে ধানসহ অন্যান্য ফসলও ফলিয়ে থাকেন। জমিতে কোনো না কোনো সবজির চাষ করেন ৭৮ শতাংশ কৃষক। ২৬ শতাংশ কৃষক জমিতে পাট চাষ করেন। ১২ শতাংশ কৃষক জমিতে মাছের চাষ করেন, প্রায় সমপরিমাণ কৃষক সরিষা, ডাল এবং রসুন উৎপাদন করেন। বাদাম এবং সয়াবিন উৎপাদন করেন ১০ শতাংশ কৃষক। ভুট্টা চাষ করেন ৫ শতাংশ কৃষক। আম চাষ করেন ৪ শতাংশ কৃষক। পেঁয়াজ চাষ করেন ৪ শতাংশ কৃষক। তিল চাষ করেন ৩ শতাংশ কৃষক। পান উৎপাদন করেন ৩ শতাংশ কৃষক এবং এছাড়াও কিছু কৃষক তাদের জমিতে অন্যান্য ফল ও ফুলেরও চাষ করেন। তবে ১২ শতাংশ কৃষক ধান ছাড়া অন্য কোনও কৃষিজ কাজে তাদের জমি ব্যবহার করেন না।

মহামারি করোনার পাশাপাশি উপর্যুপরি বন্যা সত্ত্বেও সরকারের জনবান্ধব কৃষিনীতি ও বিভিন্ন পদক্ষেপ যেমন ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি, এমওপি সারে উল্লেখযোগ্য ভর্তুকি এবং তেলের মূল্য হ্রাস, কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ভর্তুকি প্রদান, সেচ সুবিধা বৃদ্ধি, কৃষিতে প্রণোদনা প্রদান, সার বিতরণ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন, আধুনিক উফশি ও হাইব্রিড জাতের ধানের বীজ সরবরাহ, প্রতিকূলতা সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের ফলে বিগত বছরগুলোতে চালের উৎপাদন বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দানাশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ অভূত সাফল্য অর্জন করেছে।

তরুণ সমাজ : আধুনিক কৃষির দিকপাল : শিক্ষিত তরুণরাই বদলে দিচ্ছে কৃষির গতিপ্রকৃতি। কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা এবং সাফল্য আসছে তরুণদের হাত ধরেই। বর্তমান সময়ের কৃষি এখন আর সেই আগেকার মান্দাতার কৃষি নেই। কৃষি ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এসেছে। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের সুফলও পাচ্ছে দেশ। কৃষিতে বেড়েছে প্রযুক্তির প্রয়োগ। সনাতন ধারণার বাইরে এসে এখন কৃষকরা বিজ্ঞানসম্মত কৃষির দিকে ঝুঁকছে। আর এই কাজটিতে গতিসঞ্চার করেছে তরুণ কৃষকরা। বর্তমান সময়ে কৃষি ক্ষেত্রে তরুণ-তরুণীদের অংশগ্রহণ নতুন আশাবাদ জাগাচ্ছে। নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে। উৎপাদন ও বাণিজ্যের আধুনিক ধারা বুঝেই শিক্ষিত তরুণরা কৃষিতে যুক্ত হচ্ছেন। একটি সমন্বিত কৃষি খামারকে তারা অনায়াসেই লাভজনক শিল্পপ্রতিষ্ঠান ভাবতে পারছেন। দেশের প্রায় সব এলাকাতেই কৃষির নতুন নতুন খাতে আধুনিক প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী চিন্তা নিয়ে এগিয়ে আসছেন তারা। বর্তমান সময়ে যেসব তরুণ সমাজ কৃষি কাজকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন তাদেরকে কৃষক না বলে বরং কৃষি উদ্যোক্তা বলাটাই অধিকতর যৌক্তিক হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মতে, তরুণরাই এখন কৃষির প্রাণ। কৃষিকাজে জড়িতদের ৬০-৭০ শতাংশই ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী তরুণ। এই তরুণ সমাজ কৃষিকে খরপোষের কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরের  ঐতিহাসিক পথ রচনা করেছে। কেউ করছেন গবাদি পশুর খামার। কেউ করছেন হাঁস-মুরগি খামার বা মাছের চাষ। কারোবা নার্সারি, ফলের বাগান বা সমন্বিত খামার করে লাখ টাকা আয় হচ্ছে। কেউ কৃষকদের সংগঠিত ও প্রশিক্ষিত করে সার ও বিষমুক্ত ফসল উৎপাদনে আত্মনিয়োগ করেছেন। মধ্যস্বত্বভোগী কমিয়ে নিজস্ব বিপণন ব্যবস্থার মাধ্যমে সেইসব বিষমুক্ত সবজি, শস্য ও মাছ-মাংস পৌঁছে দিচ্ছেন সারা দেশে। সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও সংশ্লিষ্টদের মতে কৃষিতে আত্মনিয়োগ করে স্বাবলম্বী হওয়া শিক্ষিত তরুণ-তরুণীর সংখ্যা এখন দুই-তিন লাখের কম হবে না। জানা গেছে, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) অর্থায়নে কৃষির বিভিন্ন খাতে প্রায় ২২ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষি উদ্যোগকে অর্থায়ন করা হচ্ছে। এর মধ্যে নতুন ধরনের ফসল ও পণ্য উৎপাদনে যুক্ত হয়েছেন প্রায় তিন লাখ উদ্যোক্তা। প্রচলিত ধারার বাইরে বিকল্প খামারের দিকেও ঝুঁকছেন দেশের তরুণরা। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও গড়ে উঠছে কচ্ছপ, উট, উটপাখি, টার্কি, কুমির, ব্যাঙ এমনকি সাপের খামার। বাংলাদেশের তারুণ্যনির্ভর এই কৃষিব্যবস্থা মূল কারণ কৃষিতে নানা ধরনের সহায়তা বেড়েছে। ঋণের সুযোগ বেড়েছে, বেড়েছে কৃষি সহায়তার ক্ষেত্র। আর এর ফলেই শিক্ষিত তরুণরা তাদের কর্মসংস্থানের নতুন ক্ষেত্র খুঁজতে গিয়ে কৃষিতে আত্মনিয়োগ করে সফলতা পাচ্ছে।

খরপোষের কৃষি এখন শিল্প বিকাশের পথে : কৃষি আজ শুধু বেঁচে থাকার অবলম্বন নয়-  কৃষি এখন লাভজনক শিল্প বিকাশের হাতিয়ার। বর্তমান সময়ে কৃষিতে দেশের তরুণদের অংশগ্রহণ সত্যি আশাব্যঞ্জক। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাব মতে বাংলাদেশ চাষের মাছ উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ, সবজি চাষের জমি বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে প্রথম আর উৎপাদন বৃদ্ধির হারে তৃতীয়। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের সবজি উৎপাদন বেড়েছে পাঁচ গুণ। ফল উৎপাদন বৃদ্ধির দিক থেকেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বে শীর্ষে। আর এসব সাফল্যের ধারায় তরুণদের অংশগ্রহণ নতুন মাত্রা যোগ করছে। তরুণ সমাজই কৃষি ব্যবস্থায় নিয়ে এসেছে আধুনিক ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন এবং কৃষির বহুমুখী বাণিজ্যিক তৎপরতা। তারা কৃষিজমির সঠিক ব্যবহার, মাটির উর্বরতা, শস্যের সময়োপযোগিতা, শস্যের গুণগত মান, বাজারজাতকরণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, রপ্তানিসহ কৃষিজ পণ্যেও সর্বাধিক ব্যবহারে গবেষণাভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালণা করছে। যার ফলে দেখা যাচ্ছে- অনাবাদি ও পতিত জমিতে ফুল, ফল আর ফসলের উৎপাদনে আশাতিত পরিবর্তন এসেছে। কৃষি ক্ষেত্রেকে তারা ছড়িয়ে দিচ্ছে বাণিজ্যিক তৎপরতার দিকে। যার ফলে কৃষিভিত্তিক শিল্প বিকাশের নতুন নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি হচ্ছে। আর এরই মাধ্যমে বাড়ছে ব্যাপক কর্মসংস্থান সর্বোপরি গ্রামীণ অর্থনৈতিক তৎপরতা।

বহুমাত্রিক কর্মক্ষেত্র অবারিত কৃষি অর্থনীতি শিক্ষায় : দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে কৃষি অর্থনীতির বহুমাত্রিক কর্মক্ষেত্র। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক পরেশচন্দ্র মোদক বলেন, কৃষি অর্থনীতি গ্র্যাজুয়েটদের কৃষি বিষয়ে ব্যবহারিক জ্ঞান থাকায় চাকরির ক্ষেত্র তারা অনেক ভালো করছেন। দেশে তো বটেই, দেশের বাইরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কৃষি অর্থনীতিবিদেরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তো বটেই, কৃষি অর্থনীতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও এ বিষয়ে পাঠদান করা হচ্ছে। কৃষি অর্থনীতি বিষয়ে পড়ে দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারেন। কৃষি অর্থনীতি গ্র্যাজুয়েটরা সরকারি কর্মকমিশনের আওতাভুক্ত বিসিএসের যেকোনো সাধারণ ক্যাডারে আবেদন করতে পারেন। যেকোনো সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকে রয়েছে চাকরির সুযোগ। কৃষিভিত্তিক ব্যাংকগুলোতে প্রাধান্য বেশি দেওয়া হচ্ছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিতে পারেন। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, আন্তর্জাতিক ফসল গবেষণা ইনস্টিটিউট, আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা ইনস্টিটিউট, আন্তর্জাতিক গম ও ভুট্টা উন্নয়ন কেন্দ্রে কৃষি অর্থনীতি গ্র্যাজুয়েটরা চাকরি করতে পারেন। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, বগুড়ার পল্লী উন্নয়ন একাডেমি, বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল, বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডে এ গ্র্যাজুয়েটরা চাকরি করছেন। এ ছাড়া রয়েছে কোম্পানি এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিও (বেসরকারি সংস্থা)।

লেখক : কৃষি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক, [email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!