• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

নিভৃতচারী বুজুর্গ আল্লামা ফয়জী (রহ.)


মুহাম্মাদ হাবীব আনওয়ার মে ১৭, ২০২১, ০৫:৩৬ পিএম
নিভৃতচারী বুজুর্গ আল্লামা ফয়জী (রহ.)

ঢাকা : মহান আল্লাহতায়ালা এই ধারাপৃষ্ঠে এমন কিছু ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ প্রেরণ করেছেন। যারা তাদের যুগান্তকারী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পৃথিবীতে অমর হয়ে থাকেন। যাদের জ্ঞানের মশাল থেকে শতসহস্র জ্ঞানপিপাসু তাদের আহার সংগ্রহ করেন। যাদের হাতের ছোঁয়ায় চোখের দর্শনে মহাপাপীর মনেও খোদার প্রেমের আলো জ্বলে ওঠে। অন্ধকার ছেড়ে হিদায়েতের পথে চলে আসে। যারা হাজার বছর বেঁচে থাকেন, মানুষের মানসপটে। যাদের অবদান আর অমরকীর্তি পরবর্তী প্রজন্ম স্মরণ করে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সাথে। যারা পথহারা মানুষকে দিয়েছেন পথের সন্ধান। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দিয়েছেন ইসলামের পথনির্দেশিকা। যারা নিজেদের সর্বস্ব বিলীন করে দেশ-জাতির কল্যাণে কাজ করে গেছেন নিঃস্বার্থভাবে। শিরক-বিদআত ও ধ্বংসাত্মক কার্যাবলি প্রতিহত করে আল্লাহর দ্বীনকে সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সংগ্রামে নিজেদের আত্মনিয়োগ করেছেন। যারা সুন্দর পৃথিবীকে আরো সুন্দর করে তুলেছেন, তাদের চরিত্রের মাধুর্যতা দিয়ে। চারপাশের পরিবেশ পরিচিত সবকিছু পাল্টে দেয় তাদের অসাধারণ প্রতিভা দিয়ে! উদারতা, দানশীলতা, আপসহীনতা, সাহসিকতা, বিচক্ষণতা, উত্তম গুণাবলি, সামাজিক অবদানসহ সর্বক্ষেত্রে যাদের অবদান মানুষকে মুগ্ধ করে তোলে। বিজাতীয় সংস্কৃতির করাল গ্রাস থেকে পতনোন্মুখ জাতিকে ফিরিয়ে আনা ও চিন্তানির্ভর চেতনাসমৃদ্ধ সুস্থ-সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেওয়া, জনসাধারণকে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক জুড়ে দেওয়া, তরুণ সমাজকে অধঃপতনের দ্বারপ্রান্ত থেকে তুলে এনে সত্য-সুন্দর ও মুক্তির রাজপথে পৌঁছে দিতে যাদের চিন্তা-চেতনা, মন-মননে বয়ে যায় নির্মল চিন্তা ধারা, তাদের মাঝে উল্লেখযোগ্য একজন হলেন, অখণ্ড বাংলার প্রধান মুফতি, আল্লামা আজম ফয়জুল্লাহ (রহ.)-এর সুযোগ্য দৌহিত্র, ঐতিহ্যবাহী মেখল হামিয়ুচ্ছুন্নাহ মাদরাসার পরিচালক আল্লামা নোমান ফয়জী (রহ.)।

বহুগণের অধিকারী আল্লামা নোমান ফয়জী ১৯৫৩ সালের ১ মার্চ সুবেহ-সাদিকের পূর্বমুহূর্তে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী থানার স্বর্ণপ্রসবিনী গ্রাম মেখল হুজুর বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। মুফতিয়ে আযম আল্লামা ফয়জুল্লাহ (রহ.)-এর পরশ ও বরকতধন্য এই আলেম পরিবার সারাদেশে ধর্মীয় অনুরাগ, শিক্ষা-দীক্ষায় বেশ প্রসিদ্ধ। আল্লামা নোমান ফয়জী (রহ.)-এর শ্রদ্ধেয় পিতা ছিলেন মেখল হামিয়ুচ্ছুন্নাহ মাদরাসার স্বনামধন্য পরিচালক আল্লামা মোজাফফর (রহ.)। শ্রদ্ধেয় নানা অখণ্ড বাংলার প্রধান মুফতি আজম মুফতি ফয়জুল্লাহ (রহ.)। তার শ্রদ্ধেয় শ্বশুর হাটহাজারী মাদরাসার সাবেক মুহতামিম আল্লামা হামেদ সাহেব (রহ.)। মোদ্দাকথা, পারিবারিক দিক দিয়ে মাওলানা নোমান ফয়জী (রহ.) উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন শীর্ষ আলেম ও বুজুর্গ খান্দানের সৌভাগ্যবান ব্যক্তি।

শিক্ষা সূচনা : প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় শ্রদ্ধেয় নানা মুফতি ফয়জুল্লাহ (রহ.)-এর কাছে। তারপর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়ালেখা ঐতিহ্যবাহী মেখল হামিয়ুচ্ছুন্নাহ মাদরাসায়। এরপর উপমহাদেশের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হাটহাজারী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স) ও তাফসির সমাপ্ত করেন।

বর্ণাঢ্য কর্মজীবন : শিক্ষাজীবন সমাপ্ত হলে মেখল মাদরাসার তৎকালীন মুহতামিম মাওলানা মুজাফফর আহমদ (রহ.) তার যোগ্যতা ও দক্ষতা দেখে মেখল মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগদান করেন। সাবলীল উপস্থাপনা, মধুময় বাক্যশৈলী ও সর্ববোধগম্য  দরসের (পাঠদানের) ফলশ্রুতিতে স্বল্প সময়ে তিনি ছাত্রদের মন জয় করে সবার কাছে হয়ে ওঠেন একজন আদর্শ উস্তাদ। তার পাঠদানের সুখ্যাতিতে মুগ্ধ হয়ে তৎকালীন হাটহাজারী মাদরাসার মজলিসে শুরার সদস্যরা হযরতকে হাটহাজারী মাদরাসায় নিয়োগ দেন। হাটহাজারী মাদরাসায় চার বছর দক্ষতার সঙ্গে পাঠদান করেন। ২০০৫ সালে হজরতের আব্বা আল্লামা মোজাফফর (রহ.) ইন্তেকাল করলে মুরব্বিদের পরামর্শে তিনি মেখল মাদরাসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে মৃত্যু অবধি তাঁর মেধা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা দিয়ে দক্ষতার সঙ্গে দরসে নিজামীর বিভিন্ন কিতাবের পাঠদান ও মাদরাসার সার্বিক উন্নয়নে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছেন।

আল্লামা নোমান ফয়জী (রহ.) ছিলেন একজন আদর্শ ও দক্ষ মুহতামিম, দাওয়াতের ময়দানে একজন দরদি দায়ী। সমাজসেবার ময়দানে ছিলেন জনদরদি সেবক। তিনি ছিলেন প্রজ্ঞা সম্পূর্ণ আপসহীন ও স্পষ্টভাষী। যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হাটহাজারী মাদরাসার সংকটের সহজ সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা। তাই তিনি একাধারে দেশের সর্ববৃহৎ অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের উপদেষ্টা, হাটহাজারী মাদরাসার শূরা সদস্য, নূরানী তালিমুল কোরআন বোর্ড চট্টগ্রামের চেয়ারম্যান, হাটহাজারী ওলামা পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালনসহ সারাদেশে অসংখ্য মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন।

দীর্ঘ ১০ বছর খুব কাছ থেকে হুজরকে দেখেছি। আল্লামা নোমান ফয়জী (রহ.)-এর সদা হাস্যোজ্জ্বল চেহারা, মনকাড়া মুচকি হাসিতে যে কারো মন কাড়তো। তার মন মননে ছিল না কোনো বিদ্বেষ। ছিল না কারো প্রতি আক্রোশ বা আক্রমণাত্মক আচরণ। প্রান্তিকতা ও হীনম্মন্যতার ঊর্ধ্বে ছিলেন তিনি। চিন্তার দৈন্য থেকে যোজন যোজন দূরে ছিল তার অবস্থান। সত্যই আকাবীর ও আসলাফের বাস্তব নমুনা ছিলেন আল্লামা নোমান ফয়জী (রহ.)।

আল্লামা ফয়জী (রহ.) প্রখর মেধা, তীক্ষ্ন দৃষ্টি, সূক্ষ্ম চিন্তা ও বহু গুণে গুণান্বিত এক ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর ধৈর্য, কর্মদক্ষতা এবং স্থিরতা  ছিল পাহাড়ের ন্যায়, পাহাড় যেমন তার আপন স্থানে অবিচল, তদ্রূপ তিনিও ধৈর্য ও নিজ কর্মে ছিলেন অটল। যার জ্বলন্ত প্রমাণ, তার দ্বীনি খেদমতের সূচনা এবং শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রান্তিকতা ও চতুর্মুখী ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও ধৈর্যের সাথে দ্বীনের খেদমতে অটল থাকা। যার নজির খুঁজে পাওয়া বিরল। তার অনুপম আদর্শ ও হূদয়ের স্বচ্ছতা, সততা পথহারা পথিকদের জন্য মাইলফলক হয়ে থাকবে।

নিভৃতচারী এই মহান বুজুর্গ আল্লামা নোমান ফয়জী (রহ.) দরস-তদরিসের পাশাপাশি লেখনীর অঙ্গেও বিস্তর অবদান রেখেছেন। লিখেছেন দরসে নিজামীর কঠিন কিতাবসমূহের ব্যাখ্যাসহ প্রায় ডজনখানেক কিতাব। হযরতের লিখিত উল্লেখযোগ্য কিতাব হলো ফয়জুল বুরদা শরহে উর্দু কছিদা বুরদা, তোহফায়ে নোমানী শরহে ফছুলে আকবারী, ফয়জে আবরার শরহে পান্দানামা আত্তার, জামেউল ফয়ুজ শরহে মাছদার ফয়ুজ, ফয়ুজাতে আফিফ শরহে হেকায়েতুল লতীফ, ফয়জুত তাছরিফ উর্দু কাওয়ায়েদে সরফ, রিয়াজুল মুমিন (উর্দু-বাংলা), মোজেযাতে রাসুল আকরাম ছা. (উর্দু-বাংলা), মরছিয়াতে মুফতি আজম রহ. (উর্দু), ফাজায়েলে মাসায়েলে মিসওয়াক ও ধূমপানের বিষফল (বাংলা), মছরিয়ায়ে মাওলানা হামেদ সাহেব (রহ.), ফয়জে মাআরিব শরহে মিযান।

আল্লামা ফয়জী (রহ.) ছিলেন নির্লোভী ও জোশ-খ্যাতির ঊর্ধ্বে একজন সরলমনা ব্যক্তি। তার একটি বিশেষ গুণ হলো শুনতেন বেশি কিন্তু বলতেন খুব কম। পুরো হাটহাজারী এলাকার সর্বসাধারণের সব সমস্যা হজরত দক্ষতার সঙ্গে সমাধান করে দিতেন। নিকট অতীতে হাটহাজারী মাদরাসার সৃষ্ট সমস্যা নিরসনে অনেকেই হজরতকে হাটহাজারী মাদরাসার দায়িত্ব গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু হুজুর সম্মানের সাথে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। হজরতের জীবনের পুরোটা সময় জুড়েই ছিল মসজিদ-মাদরাসার খেদমতে নিয়োজিত। এরই ধারাবাহিকতায় সারাদেশে প্রায় শতাধিক মাদরাসা প্রতিষ্ঠার সাথে বিভিন্নভাবে জড়িত ছিলেন। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মাঝে দ্বীনের আলো পৌঁছাতে হলে আগে সেই সমাজের শিশুদের কচিমনে দ্বীনের তালিম আগে ঢোকাতে হবে এই উপলব্ধি থেকেই তিনি শীর্ষ আলেমদের সাথে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন নূরানী তালিমুল কোরআন বোর্ড চট্টগ্রাম। হজরত নূরানী বোর্ডের প্রতিষ্ঠা হওয়া সত্ত্বেও কখনো তিনি বোর্ডের চেয়ারম্যানের পদ গ্রহণ করেননি। শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.)-এর ইন্তেকালের পরে মজলিসে শূরা হজরতকে চেয়ারম্যান দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ করলে তিনি বৃহৎ স্বার্থে শায়খুল হাদিস আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী হাফি.-কে বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন। এছাড়াও হজরতের বর্ণাঢ্য জীবনী নিয়ে একটি আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকার নেওয়ার আবেদন করেছিলাম অনেকবার। কিন্তু হুজুর কখনোই তাতে রাজি হননি। হুজুর বলতেন, আমার এমন কোনো গুণ নেই যা মানুষের সামনে তুলে ধরার মতো। আমি একজন সাধারণ মুসলমান। তোমরা শুধু দোয়া করিও আল্লাহ যেন মৃত্যু পর্যন্ত দ্বীনের খেদমত করার তৌফিক দান করেন।

প্রিয় পাঠক! কত বড় চিত্তের অধিকারী হলে এমন উদারতা, নম্রতা দেখাতে পারেন চিন্তার রুদ্ধদ্বার কক্ষকে উন্মুক্ত করে গবেষণা করা আমাদের অতীব প্রয়োজন। শুধু আমি নয়, তার এমন অসংখ্য উত্তম গুণাবলির কারণে অসংখ্য মানুষ ভালোবাসতেন তাকে। আমি তার ভালোবাসায় মুগ্ধ ও সিক্ত। কারণ তিনি ছিলেন হিংসা, অহংকার ও অহমিকা থেকে মুক্ত। হাসিমুখে জাদুময়ী বাকশৈলীতে মানুষকে কাছে টানার অসাধারণ প্রতিভার অধিকারীও ছিলেন তিনি।

বহুগুণের অধিকারী নিভৃতচারী এই মহান ব্যক্তিত্ব আল্লামা নোমান ফয়জী (রহ.) ২২ মার্চ ২০২১ সালে সোমবার বাদ মাগরিব ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে তার জীবনের ব্যস্ততম ৬৮টি বসন্তের ইতি ঘটিয়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। তার চলে যাওয়ায় আমরা শোকাহত। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন হজরতকে জান্নাতুল ফেরদৌসের উচ্চ মাকাম দান করুন! এবং তার রেখে যাওয়া কাজগুলোকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য যোগ্য ব্যক্তি তৈরি করে দিন। আমিন!

লেখক : শিক্ষার্থী, দারুল উলূম হাটহাজারী মাদরাসা

Wordbridge School
Link copied!