• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আত্মীয়বান্ধব নবীপত্নী মায়মুনা (রা.)


নূর মুহাম্মদ রাহমানী আগস্ট ১, ২০২১, ০৩:১৯ পিএম
আত্মীয়বান্ধব নবীপত্নী মায়মুনা (রা.)

ঢাকা : ইতিহাস আলোকিত করা নারী নবীপত্নী মায়মুনা (রা.)। মূল নাম বাররা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরিবর্তন করে নাম রাখেন মায়মুনা। বংশপরম্পরা মায়মুনা বিনতে হারেস ইবনে হাজান ইবনে বুজাইর ইবনে হুজম ইবনে রুয়াইবা ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে হেলাল। মা মহীয়সী নারী হিন্দ বিনতে আওফ ইবনে জুহাইর ইবনে হারেস ইবনে হিমাতাহ ইবনে হিময়ার। বলা হয়, পৃথিবীতে অত্যধিক সম্মানিত বৃদ্ধা মায়মুনা (রা.)-এর মা হিন্দ বিনতে আওফ ইবনে জুহাইর ইবনে হারেস। ১৮তম পূর্বপুরুষ মুজারে গিয়ে তাঁর বাবার বংশ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে মিলে যায়। তিনি মক্কার সম্ভ্রান্ত কোরাইশ বংশে নবুওয়তের প্রায় ১৬ বছর আগে জন্মগ্রহণ করেন।

তিনি ছিলেন নবীজির বিয়ে করা সর্বশেষ স্ত্রী। তাঁর বোন লুবাবা কোবরা আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের স্ত্রী। আর ছোট বোন লুবাবা সোগরা ওয়ালিদ ইবনে মুগিরার স্ত্রী। এ ছাড়াও তিনি মুফাসসির সম্রাট আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) ও বিশিষ্ট সাহাবি খালেদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.)-এর খালা। মায়মুনা (রা.)-এর বৈপিত্রীয় বোন জাফর ইবনে আবু তালেবের স্ত্রী আসমা বিনতে উমাইস, হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিবের স্ত্রী সালমা বিনতে উমাইস এবং আবদুল্লাহ ইবনে কা’ব ইবনে মুনাব্বিহ খাসআমির স্ত্রী সালামা বিনতে উমাইস। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত-এক হাদিসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘মোমিনা বোনগণ : নবীজির স্ত্রী মায়মুনা, উম্মুল ফজল বিনতে হারেস, হামজার (রা.) স্ত্রী সালমা এবং আসমা বিনতে উমাইস।’ (আস-সুনানুল কোবরা, নাসায়ি : ৮৩২৮)।

মায়মুনা (রা.)-এর প্রথম বিয়ে হয় মাসউদ ইবনে আমর ইবনে ওমায়ের সাকাফির সঙ্গে। তাদের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটলে বিয়ে হয় আবু রুহম ইবনে আবদুল ওজ্জা ইবনে আবু কায়েসের সঙ্গে। তিনি ছিলেন বনু মালেক ইবনে হাসাল ইবনে আমের ইবনে লুইয়ের লোক। ৭ম হিজরিতে এ স্বামী মৃত্যুবরণ করেন। ৭ম হিজরির শাওয়াল কিংবা জিলকদ মাস। মদিনা থেকে মক্কার উদ্দেশে যাত্রা করেছেন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। সঙ্গে তাঁর বিশাল বাহিনী। উদ্দেশ্য কাজা ওমরা আদায়। গেল ৬ষ্ঠ হিজরির ওমরা এটি। হুদায়বিয়ার সন্ধির শর্তের কারণে এ বছর কাজা আদায় করতে হচ্ছে সবাইকে। রাসুলের সঙ্গে আছেন চাচাতো ভাই জাফর ইবনে আবু তালেব (রা.)। তিনি জাফরকে বললেন, আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়, হারেসের কন্যা মায়মুনাকে (রা.) বিয়ে করার জন্য। আমার পক্ষ থেকে তুমি তাকে প্রস্তাব দাও। জাফর (রা.) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে মায়মুনাকে (রা.) বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। তিনি সানন্দে রাজি হলেন। বিয়ের সার্বিক কার্যক্রম আব্বাস (রা.)-এর ওপর ন্যস্ত হয়। তিনি ছিলেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আপন চাচা ও মায়মুনা (রা.)-এর আপন দুলাভাই। আল্লামা রশিদ রেজা (রহ.)-এর মতে চাচা আব্বাস-ই (রা.) নবীজিকে (সা.) এ বিয়েতে উৎসাহিত করেন এবং বিয়ের ব্যবস্থা করেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইহরাম অবস্থায় চাচার মাধ্যমে জানতে পারলেন, মায়মুনা (রা.) বিয়েতে রাজি হয়েছেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৪০০ কিংবা ৫০০ দেরহাম মোহরানার বিনিময়ে তাঁকে বিয়ে করেন। চাচা আব্বাস (রা.) নবীজির পক্ষ থেকে এ অর্থ পরিশোধ করে দেন। ওমরা থেকে ফেরার পথে তানঈম-এর নিকটবর্তী মক্কা থেকে ১০-১২ মাইল দূরে সারিফ এলাকায় বাসর যাপন করেন। বিয়ের সময় তাঁর বয়স ছিল ২৬ মতান্তরে ৩৭ বছর। আর নবীজির ছিল ৫৯ বছর। নবীজি এ বিয়েতে একাধিক বকরি জবাই করে ওলিমার আয়োজন করেন।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে ইহরাম অবস্থায় বিয়ে করেন নাকি হালাল অবস্থায় বিয়ে করেন এতে মতবিরোধ রয়েছে। হাফেজ শামসুদ্দিন জাহাবি (রহ.) ইহরাম অবস্থায় বিয়ে হওয়ার বিষয়টিকে মুতাওয়াতির বলেছেন। একটি বর্ণনায় আছে-ইকরিমা ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, ‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মায়মুনা (রা.)-কে মুহরিম অবস্থায় বিয়ে করেছেন।’ (মুসলিম : ২৫২৭)।

চরিত্র : মায়মুনা (রা.) ছিলেন অত্যধিক খোদাভীরু। দুনিয়া বিরাগভাজনে প্রসিদ্ধি ছিল এ নারীর। তাঁর সম্পর্কে অপর উম্মুল মোমিনিন আয়েশা (রা.) বলেন, জেনে রেখ, নিশ্চয়ই তিনি ছিলেন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আল্লাহভীরু এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারিণী।’ (আল-মুসতাদরাক : ৪/৩৪)। আল্লাহর নাফরমানিকে কখনোই সহ্য করেননি। আত্মীয়স্বজনদের বেলায়ও নয়। তিনি ছিলেন অনেক ইবাদতগুজার নারী। অসহায় মানুষদের খুব দান-খয়রাত করতেন। দাস-দাসী মুক্ত করার অদম্য নেশা ছিল। দিনের বিধানের প্রতি ছিলেন অত্যধিক কঠোর।

জ্ঞান ও মর্যাদা : নবীপত্নীদের মধ্যে মায়মুনা (রা.)-এর খুব ভালো অবস্থান ছিল। কারণ, তিনি ছিলেন আব্বাস (রা.)-এর স্ত্রী উম্মুল ফজলের বোন এবং খালেদ ইবনে ওয়ালিদের (রা.) খালা। হাদিস ও ফিকহ শাস্ত্রে তাঁর অবদান ছিল উল্লেখ করার মতো। বোখারি-মুসলিমে তাঁর থেকে সাতটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। সর্বমোট বর্ণিত হাদিস সংখ্যা ১৩। তাঁর অধিকাংশ হাদিসই ছিল পবিত্রতাকেন্দ্রিক। নবীজির জীবন বর্ণনায় অন্যান্য স্ত্রীদের মতো তাঁরও ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অজু-গোসলের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ঘুম, ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়া, ঘরে প্রবেশ করা-বের হওয়া বিষয়গুলো খুবই সতর্কতার সঙ্গে বর্ণনা করেছেন। আর এটা রাসুলের সঙ্গে দীর্ঘ সময়ের সংশ্রবের কারণে সম্ভব হয়েছে। তাঁর থেকে বর্ণনা করেন ইবরাহিম ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মা’বাদ ইবনে আব্বাস ও তাঁর কৃতদাস সোলাইমান ইবনে ইয়াসার, আবদুল্লাহ ইবনে সালিত ও তাঁর ভাগ্নে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস এবং তাঁর ভাতিজা আবদুর রহমান ইবনে সায়েব হেলালি প্রমুখ।

কোরআনের অমর ভাষ্যকার ভাগ্নে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) কখনো কখনো খালা মায়মুনা (রা.)-এর কাছে থাকার জন্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘরে আসতেন। জ্ঞানার্জন করতেন। শিখতেন অনুপম চরিত্র ও শিষ্টাচার। তিনি ওই নারী যিনি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য নিজেকে হেবা করে দেন। নবীজির প্রস্তাব তাঁর কাছে পৌঁছলে তিনি উটে সওয়ার থাকাবস্থায়ই বলে উঠলেন, উট ও এতে যা আছে তা আল্লাহ ও রাসুলের জন্য। কতো ভাগ্যবতী নারী তিনি! মহান আল্লাহ এ পরিপ্রেক্ষিতে নাজিল করলেন, ‘কোনো মোমিন নারী যদি নিজেকে নবীর কাছে সমর্পন করে, নবী তাকে বিয়ে করতে চাইলে সে-ও হালাল। এটা বিশেষ করে আপনার জন্য-অন্য মোমিনদের জন্য নয়। আপনার অসুবিধা দূরীকরণের উদ্দেশে।’ (সুরা আহজাব : ৫০)।

তিনি ছিলেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খুবই ঘনিষ্ঠ। একই সঙ্গে একই পাত্র থেকে গোসল করতেন। নবীজির সঙ্গে থেকে যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন। তার মধ্যে তাবুক যুদ্ধ অন্যতম। সেখানে তিনি যুদ্ধাদের পানি-পাথেয় সরবরাহ করেন। আহতদের সেবা করেন। অসুস্থদের চিকিৎসা করেন। তাদের ক্ষতস্থানে পট্টি লাগিয়ে দেন। এ যুদ্ধে একটি তীরের আঘাত পান তিনি। তবে আল্লাহ তাঁকে হেফাজত করেন।

তাঁকে বিয়ে করার মাধ্যমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনেক বড় একটা কল্যাণ বাস্তবায়ন করেন। তিনি এ বিয়ের মাধ্যমে স্ত্রী মায়মুনার বংশ বনু হেলালের মনোরঞ্জন করেন। ইসলামে দীক্ষিত হতে উদ্ধুদ্ধ করেন। নবীজিও লাভ করেন তাদের থেকে ভালোবাসা ও সমর্থন। ফলে দলে দলে তারা ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করেন।

মৃত্যু : তাবারি (রহ.)-এর মতে, নবী (সা.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি উম্মে সালামা (রা.)-এর কাছে ছিলেন। আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) লিখেছেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর মায়মুনা (রা.) মদিনায় আরো ৪০ বছর বসবাস করেছিলেন। তারপর ৫১ হিজরিতে মক্কা ও মদিনার মাঝামাঝি এলাকা সারিফ নামক স্থানে মৃত্যুবরণ করেন। ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) দেখিয়েছেন, তিনি আয়েশা (রা.)-এর আগে ইন্তেকাল করেন। এ জায়গায়তেই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সঙ্গে বাসর যাপন করেছিলেন। এখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ কিংবা ৮১ বছর। জানাজার ইমামতি করেন ভাগ্নে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)। দাফনের জন্য কবরে নামেন ইয়াজিদ ইবনে আসাম আবদুল্লাহ ইবনে শাদ্দাদ ইবনুল হাদি (তারা সবাই তাঁর ভাগ্নে) এবং তাঁর তত্ত্বাবধানে পালিত ওবায়দুল্লাহ খাওলানি প্রমুখ। (সূত্র : সিয়ারু আলামিন নুবালা, তাবারানি, তাবাকাতে কোবরা, মাআলিমুল তানজিল, আল-ইসাবা ফি তাময়িজিস সাহাবা, তাহজিবুত তাহজিব।)।

লেখক : শিক্ষক, হাদিস ও ফতোয়া বিভাগ, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম বাগে জান্নাত, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ

 

Wordbridge School
Link copied!