• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

লাইসেন্স পেতে দুর্ভোগ


বিশেষ প্রতিনিধি এপ্রিল ২, ২০২১, ০৬:০২ পিএম
লাইসেন্স পেতে দুর্ভোগ

ঢাকা : বাংলাদেশ রোড অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে ভোগান্তির শেষ নেই। প্রতিটি ধাপেই রয়েছে দীর্ঘ লাইন আর প্রতীক্ষা। শুধু তাই নয়, সকাল থেকে এক কক্ষ থেকে আরেক কক্ষে দৌড়ঝাঁপ করতে হয়। আর কোন কক্ষে যেতে হবে তারও নেই কোনো দিকনির্দেশনা। এমন ভোগান্তি থেকে রেহাই পেতে লাইসেন্সপ্রত্যাশীরা বাধ্য হন দালালের শরণাপন্ন হতে।

ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য শিক্ষানবিশ কার্ড করে ৩ মাস অপেক্ষার পর মৌখিক আর লিখিত পরীক্ষা দিতে রাজধানীর জোয়ার সাহারায় বিআরটিসি বাস ডিপোতে আসেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন। জানালেন, পরীক্ষা দেওয়ার শুরুতেই তাকে পড়তে হয়েছে নানা বিড়ম্বনায়। পরীক্ষা দেওয়ার জন্য তার নামটি তালিকায় আছে কি না সেটি জানতেই রীতিমতো যুদ্ধে করতে হয়েছে।

তিনি জানান, বিআরটিসি বাস ডিপোর গেটের বাইরে একটি গাছে ছোট্ট একটি বোর্ডে টানানো হয় প্রতিদিনের পরীক্ষার্থীদের তালিকা। শত শত পরীক্ষার্থী ঠেলাঠেলি করে খুঁজে পেতে চেষ্টা করেন নিজের নামটি। অনেক কষ্টে নাম খুঁজে পাওয়ার পর ঢুকতে দেওয়া হয় ভেতরে। সেখানে যাওয়ার পর আবারো দীর্ঘ লাইন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর একটি ডেস্কের সামনে পৌঁছালে সেখানে লিখিত পরীক্ষার সিরিয়াল দেওয়া হয়।

এরপর আবারো অপেক্ষার পালা। দীর্ঘ অপেক্ষার পর সুযোগ আসে লিখিত পরীক্ষা দেওয়ার। পরীক্ষা দেওয়ার পর আবারো অপেক্ষা ফলাফলের জন্য। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের অপেক্ষা করতে হবে মৌখিক পরীক্ষার জন্য। সেখানেও দীর্ঘ অপেক্ষা আর লাইনে দাঁড়ানোর বিড়ম্বনা। আর মৌখিক পরীক্ষার পর আবারো অপেক্ষা ফিল্ড টেস্টের জন্য। ফিল্ড টেস্টের জন্য গাড়ি ভাড়া বাবদ গুনতে হয় টাকা। কেউ ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে গেলেও ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না।

তিনি আরো জানান, সব পরীক্ষা শেষে আবারো অপেক্ষা ফলাফলের। যারা পাস করবেন তাদের কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে ফিঙ্গারসহ বায়োমেট্রিক টেস্টের জন্য। কিন্তু কবে নাগাদ এই টেস্ট হবে তার সুনির্দিষ্ট কোনো তারিখ জানানো হয় না। অনুমানিক দেড়-দুই মাস পর সংশ্লিষ্ট বিআরটিএ অফিসে গিয়ে জেনে আসতে হবে কবে ফিঙ্গার দেওয়া যাবে। একাধিকবার যাবার পর পাওয়া যাবে ফিঙ্গার ও ছবি দেওয়ার সুযোগ। ফিঙ্গার ও ছবি দেওয়ার জন্যও গুনতে হবে দীর্ঘ অপেক্ষার প্রহর।

এর আগে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য জমা দিতে হবে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা। পূরণ করতে হবে ফরম এবং সেইসাথে জমা দিতে হবে আনুষঙ্গিক কাগজপত্র। টাকা ও ফরম জমা দেওয়ার ক্ষেত্রেও আছে দীর্ঘ লাইন আর প্রতীক্ষা। সব ক্ষেত্রেই ফর্ম জমা দেওয়ার বিপরীতে ফেরত পেতেও করতে হয় অপেক্ষা। এভাবে প্রতিটি ধাপে দীর্ঘ লাইন আর অপেক্ষায় ক্লান্ত-বিরক্ত হয়ে ওঠেন লাইসেন্সপ্রত্যাশীরা।

আর প্রতিটি ধাপেই দেখা পাওয়া যায় দালালদের। সেবা গ্রহীতাদেরও কখনো কখনো নিজেদেরই কাগজপত্র নিয়ে ছুটোছুটি করতে হয় কাউন্টার থেকে কাউন্টার আর বিভিন্ন কক্ষে। পদে পদে এত বিড়ম্বনা এড়াতে অনেকেই তাই শরণাপন্ন হন দালালের।

মিরপুর বিআরটিএ কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, নির্দিষ্ট কর্মচারীর বদলে কাগজপত্র আনা-নেওয়া করেন আনসার সদস্যরা। কাগজপত্রগুলো কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন তারও কোনো উত্তর নেই।

সাধারণ নিয়ম আগে আবেদন করলে আগে সেবা পাবেন। অভিযোগ আছে টাকা না দিলে সেই নিয়মও মানা হয় না।

লাইসেন্সপ্রত্যাশীরা জানান, সিরিয়াল পেছনে, সেগুলো আগে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমরা ৬ ঘণ্টা ধরে এখানে অপেক্ষা করছি। অন্য আরেকজন জানান, সিরিয়াল যাই থাক না কেন ৫শ টাকা দিলে আগে যাওয়া যায়। বিআরটিএ সংলগ্ন ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার ক্ষেত্রেও দেখা গেছে এসব অনিয়ম।

বিআরটিএ উত্তরার দিয়াবাড়ী কিংবা কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়া কার্যালয়ের অবস্থাও একই রকম। সবখানেই অভিযোগের শেষ নেই। বছরের পর বছর ঘুরছেন সেবাপ্রত্যাশীরা।

তারা জানান, দালালের মাধ্যমেই দ্রুত কাজ হয়। কিন্তু নিজে গেলে ঘুরতে হয়। যার কাছেই যাই ওনারা বলেন, আমরা কিছু জানি না। এরকম করে ঘোরায়, তাই দালাল ছাড়া কোনো কাজ স্বাভাবিকভাবে হয় না।

এদিকে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণের পরও পাওয়া যাচ্ছে না ডিজিটাল বা স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স। সাদা কাগজের অস্থায়ী লাইসেন্স দিয়ে প্রায় দুই বছর ধরে চলতে হচ্ছে চালকদের। নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে বিআরটিএ থেকে নবায়ন করতে হচ্ছে এই অস্থায়ী লাইসেন্স।

জানা যায়, টেন্ডার জটিলতার কারণে এতদিন স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রিন্টে বিলম্ব হচ্ছিল। তবে সম্প্রতি সমাধান হয়েছে। ঢাকার বাইরে কয়েকটি জেলায় স্মার্ট কার্ড ডেলিভারি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

মিরপুর বিআরটিএতে তৃতীয়বারের মতো ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন করতে আসেন হুমায়ুন শাহেদ নামে এক গাড়িচালক। তিনি জানান, কাগজের অস্থায়ী লাইসেন্স দীর্ঘ সময় ব্যবহারের ফলে ছিঁড়ে যাচ্ছে। বার বার নবায়ন করার ঝামেলাও আছে। এ ছাড়া অনেক সময় মেয়াদ পার হয়ে গেলেও মনে থাকে না। এজন্য ট্রাফিক পুলিশকে জরিমানাও দিতে হয়।

বিআরটিএ মিরপুর কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক শামসুল কবির এ প্রসঙ্গে বলেন, আগামী নভেম্বর থেকে স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স বিতরণ কাজ শুরু হবে। তবে সেবাগ্রহীতাদের হয়রানি কিংবা দালালদের দৌরাত্ম্যে বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, আগে এরকম অভিযোগ থাকলেও এখন তা নেই। সবকিছু কঠোরভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে।

এদিকে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল বলেন, পরিবহন সেক্টরের সব ক্ষেত্রেই অনিয়ম আর হয়রানি। বিআরটিএ’র দুর্নীতি তো সবারই জানা। তিনি বলেন, সরকার যেখানে ব্যাপক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারছে না সেখানে কিছু মানুষ স্বকর্মসংস্থানের প্রয়োজনে ড্রাইভিংকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এ ক্ষেত্রেও যদি সংশ্লিষ্টরা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন তা খুবই দুঃখজনক।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব ও ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ বলেন, দেশে গাড়ির চেয়ে চালকের স্বল্পতা রয়েছে। অনেকে গাড়ি চালাতে পারলেও লাইসেন্স না থাকার কারণে তাদের আমার চাকরি দিতে পারছি না। ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেকে ভুয়া লাইসেন্সে গাড়ি চালাচ্ছেন। অনেকের গাড়ি চালনায় দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও লাইসেন্সের অভাবে গাড়ি চালাতে পারছেন না। তিনি লাইসেন্স প্রাপ্তির দীর্ঘসূত্রতা হ্রাস করে বরং চালকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ দেন।

সার্বিক বিষয়ে বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার এবং পরিচালক (ইঞ্জি.) শীতাংশু শেখর বিশ্বাসের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করলেও তারা ফোন ধরেননি।

সম্প্রতি বিআরটিএ’র সেবা সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, বিআরটিএ’র সেবা পেতে এখনো ভোগান্তি রয়েছে। এখনো দালালদের দৌরাত্ম্য রয়েছে। বিআরটিএ’র কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সঙ্গে দালালদের সখ্য ও যোগাযোগ রয়েছে। তবে প্রযুক্তির ব্যবহারে তা কমে আসছে। ডিজিটাল সেবার আওতা বাড়ানো গেলে দুর্নীতি ও অনিয়ম অনেকটা কমে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!