• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
পর্দার অন্তরালে থেকে যায় দোষীদের নাম

ঝুঁকিপূর্ণ কর্মস্থলে জীবিকার লড়াই


বিশেষ প্রতিনিধি আগস্ট ৫, ২০২১, ১০:০৫ পিএম
ঝুঁকিপূর্ণ কর্মস্থলে জীবিকার লড়াই

ঢাকা : জীবিকার সন্ধানে এসে ঝুঁকিপূর্ণ কর্মস্থলে প্রাণ হারাচ্ছেন শত শত শ্রমিক। কোনোভাবেই থামছে না এই মৃত্যুর মিছিল। সাভারে তাজরিন গার্মেন্ট ও রানা প্লাজা ধস, পুরান ঢাকার নিমতলী-চুড়িহাট্টা, সবশেষ সেজান জুস কারখানা অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু হয়েছে ৫১ জনের। কোথাও পুড়ে, কোথাও চাপা পড়ে কর্মস্থলেই নির্মম মৃত্যু হচ্ছে শ্রমিকের। প্রতিটি ঘটনায় পর্দার অন্তরালে থেকে যাচ্ছে প্রকৃত দোষীরা। 

অভিযোগ রয়েছে, মালিকদের কম ব্যয়ে বেশি মুনাফা লাভের মানসিকতা দুর্ঘটনার অন্যতম বড় কারণ। এছাড়া সরকারি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো নামমাত্র যাচাই বাছাই করে এসব প্রতিষ্ঠাকে লাইসেন্স প্রদান করে। আর দুর্ঘটনায় সরকারি সংস্থাগুলোকে দায় নিতে হবে বলে অভিমত বিশ্লেষকদের। 

এদিকে কলকারখানা মালিকরা বলছেন, কোনো কারখানার ভবন তৈরি হয় প্রকৌশলীদের তত্ত্বাবধানে বিল্ডিং কোড অথরিটির অনুমোদন নিয়ে। এরপর বিস্ফোরক অধিদপ্তর, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডাইফি), পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিসসহ মোট ১৬/১৭ টি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনের পরই বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করা হয়। 

২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীর ট্র্যাজেডিতে প্রাণ হারায় ১২৪ জন। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর সাভারের তাজরিন ফ্যাশনসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যায় ১১৭ টি তাজা প্রাণ। 

পরের বছরে ধসে পড়ে সাভারের আরেক বৃহৎ পোশাক কারখানা রানা প্লাজা, যেখানে প্রাণ হারায় এক হাজার ১৭৫ জন শ্রমিক। এরপর ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় প্রাণ হারায় ৭১ জন শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ। সর্বশেষ গত ৮ জুলাই রূপগঞ্জের হাসেম ফুডস কারখানায় আগুনে পুড়ে ৫১ জনের মৃত্যু হয়। 

এর মধ্যে আগুন থেকে বাঁচতে ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে মারা যাওয়া তিনজনের লাশ তখনই স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বাকি লাশগুলো আগুনে এতটাই পুড়ে গিয়েছিল যে সেগুলো শনাক্ত করার উপায় ছিল না। ফলে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে লাশগুলোর পরিচয় শনাক্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়। এ যেনো একই ট্রাজেডির ভিন্ন ভিন্ন চিত্রায়ন। 

প্রতিটি দুর্ঘটনার পর কয়েকদিন চলে জোর আলোচনা, তারপর প্রেক্ষাপট পাল্টে চাপা পড়ে সেই ঘটনা। পর্দার অন্তরালেই থেকে যায় দোষীদের নাম। অথচ কারখানা চালু করতে কয়েক ধাপে অনুমোদন নেওয়া হয় সরকারি কয়েকটি সংস্থার কাছ থেকে। কীভাবে দেয় তারা অনুমোদন সেই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসছে। 

পেটের দায়ে কেউ কাজ করেন গার্মেন্টসে, কেউ জাহাজ নির্মাণ শিল্পে, কেউ পরিবহনে, কেউ নির্মাণ শিল্পে, আবার কেউ অন্যান্য শিল্পকলকারখানায়। সন্তানদের মুখে দুবেলা দু-মুঠো ভাত তুলে দিতে কী হাঁড়ভাঙ্গা খাটুনি না খাটতে হয়ে তাদের। 

সামান্য কিছু টাকার জন্য শ্রমিকরা যে শ্রম দিতে যান কর্মস্থলে, সেই কর্মস্থলেই নিরাপত্তাহীন শ্রমিকের জীবন। কারণ অনিরাপদ কর্মস্থলের জন্য কাজ করতে দিয়ে কর্মস্থলেই জীবন দিতে হচ্ছে শত শত শ্রমিককে।

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) এক জরিপ তথ্যে জানা যায়, প্রতি বছর গড়ে প্রায় এক হাজারের মতো শ্রমিক মারা যাচ্ছে কর্মস্থলে কর্মরত অবস্থায়। 

সংস্থাটি ২০২০ সালে যে জরিপ করেছে তাতে দেখা যায়, ২০২০ সালে কর্মস্থলে জীবন দিতে হয়েছে ৭২৯ জন শ্রমিককে। এরমধ্যে ৭২৩ জন পুরুষ এবং ৬ জন নারী শ্রমিক। খাত অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি ৩৪৮ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় পরিবহন খাতে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮৪ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় নির্মাণ খাতে। তৃতীয় সর্বোচ্চ ৬৭ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় কৃষি খাতে। 

এছাড়া দিনমজুর ৪৯ জন, বিদ্যুৎ খাতে ৩৫ জন, মৎস্য ও মৎস্য শ্রমিক ২৭ জন, স্টিল মিল শ্রমিক ১৫ জন, নৌ-পরিবহন শ্রমিক ১৫ জন, মেকানিক ১৪, অভিবাসী শ্রমিক ১৫ এবং অন্যান্য খাতগুলোতে যেমন ইটভাটা, হকার, চাতাল, জাহাজ ভাঙ্গাসহ ইত্যাদি সেক্টরে ৬০ জন শ্রমিক নিহত হন।

অবশ্য বিলসের তথ্য মতে, ২০১৯ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় বিভিন্ন খাতে ১ হাজার ২০০ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়, এরমধ্যে ১ হাজার ১৯৩ জন ছিল পুরুষ এবং ৭ জন নারী শ্রমিক। খাত অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি নিহতের ঘটনা ঘটে পরিবহন খাতে ৫১৬ জন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শ্রমিক নিহতের ঘটনা ঘটে নির্মাণ খাতে ১৩৪ জন। তৃতীয় সর্বোচ্চ শ্রমিক নিহতের ঘটনা ঘটে কৃষি খাতে ১১৬ জন। সুতরাং সংখ্যাগত দিক থেকে ২০১৯ সালের চেয়ে ২০২০ সালে কর্মস্থলে শ্রমিকের মৃত্যুর হার কিছুটা কমেছে।

বিলসের পরিসংখ্যানে আরো উল্লেখ করা হয়, ২০২০ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৪৩৩ জন শ্রমিক আহত হয়, এরমধ্যে ৩৮৭ জন পুরুষ এবং ৪৬ জন নারী শ্রমিক। মৎস্য খাতে সর্বোচ্চ ৬৮ জন শ্রমিক আহত হন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নির্মাণ খাতে ৪৯ জন শ্রমিক আহত হন। 

এছাড়া বিদ্যুৎ খাতে ৪৮, পরিবহন খাতে ৪৭, জুতা কারখানায় ২০ জন, নৌপরিবহন খাতে ১৬, তৈরি পোশাক শিল্পে ৩৭, জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পে ২৯, দিনমজুর ১৬, উৎপাদন শিল্পে ১৯, স্টিল মিলে ১৯, কৃষিতে ১০ জন শ্রমিক আহত হন। এছাড়া অন্যান্য খাতে ৪০ জন শ্রমিক আহত হন।

বিগত ২০১৯ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় বিভিন্ন সেক্টরে ৬৯৫ জন শ্রমিক আহত হন, এদের মধ্যে ৬৭৮ জন পুরুষ এবং ১৭ জন নারী শ্রমিক। মৎস্য খাতে সর্বোচ্চ ১৩২ জন শ্রমিক আহতের ঘটনা ঘটে, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শ্রমিক আহতের ঘটনা ঘটে নির্মাণ সেক্টরে ১১৭ জন। তৃতীয় সর্বোচ্চ শ্রমিক আহতের ঘটনা পরিবহন খাতে ১০৪ জন।

বিলসের জরিপ তথ্যে আরো উল্লেখ করা হয়, বিগত ১০ বছরে কর্মস্থলে সর্বোচ্চ শ্রমিক মৃত্যু পরিবহন এবং নির্মাণ সেক্টরে। ২০১১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, পরিবহন সেক্টরে ২০২০ সালে ৩৪৮ জন শ্রমিক নিহতের ঘটনা ঘটে, যা পূর্ববর্তী দুই বছরের তুলনায় কম। নির্মাণ খাতে ২০২০ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৮৪ জন শ্রমিক নিহত হন, যা ২০১৯ সালে ছিল ১৩৪ জন এবং ২০১৮ সালে ছিল ১৬১ জন।

কর্মস্থলে শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে শ্রমিক নেতা ও আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন ইন্ডাস্ট্রিয়াল বাংলাদেশের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুর রহমান বলেন, পেটের দায়ে কাজ করতে গিয়ে মালিকদের অবহেলা এবং অব্যবস্থাপনার জন্য কর্মস্থলে জীবন দিতে হচ্ছে শ্রমিককে। নিরাপদ কর্মস্থল শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার। আমাদের দেশের ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রেই শ্রমিকরা সে অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। 

আমাদের দাবি, প্রতিটি শ্রমিকের প্রতিটি কর্মস্থল হোক নিরাপদ। সন্তানদের কাছ থেকে সকালে বিদায় নিয়ে কাজে গিয়ে কোনো বাবা বা মা যেন সে সন্তানের কাছে লাশ হয়ে ফিরে না আসে-এটিই আমাদের প্রত্যাশা।

বিলসের ভাইস চেয়ারম্যান শিরিন আখতার বলেন, দেশের উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে শ্রমিকদের রক্ত মিশ্রিত ঘাম জড়িত। তাদের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে অবশ্যই সরকারকে কমিটি গঠন করে যথাযোগ্য তদারকির ব্যবস্থা করতে হবে।

কলকারখানা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, কর্মস্থলে নির্মাণ শ্রমিকদের মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে আমরাও চিন্তিত। দেশের সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করছে অধিদপ্তর।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!