• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৪ মে, ২০২৪, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

ময়লা আর কচুরিপানায় বিপন্ন মগড়া নদী 


বিজয় চন্দ্র দাস, নেত্রকোনা  জুন ১৩, ২০২৩, ০৪:৩০ পিএম
ময়লা আর কচুরিপানায় বিপন্ন মগড়া নদী 

নেত্রকোনা: জেলা শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ঐতিহ্যবাহী মগড়া নদী। এ নদীর দুই তীরেই অবস্থিত জেলা শহর। এই মগড়া নদীতে ফেলা হচ্ছে বিভিন্ন ময়লা আবর্জনা। নদীর দুই পাড়ে জমে গেছে ময়লা আবর্জনার স্তূপ। পানিতে ভাসমান বদ্ধ কচুরিপানা।  এতে দিন দিন বিপন্ন হচ্ছে একসময়ের প্রবল স্রোতের নদী মগড়া।

নেত্রকোনা শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে মগড়া নদী। গত চার যুগে দখলে নাব্যতা হারিয়েছে এই নদী। আবর্জনা ফেলায় দূষিত হচ্ছে এই নদীর পানি ও জীববৈচিত্র্য। একসময়ের এই জেলার প্রাণচঞ্চল কংশ, মগড়া, সোমেশ্বরী ও ধনু নদী এখন হয়ে উঠছে নিষ্প্রাণ ও অপরিচ্ছন্ন। নেত্রকোনাবাসী দীর্ঘদিন ধরে এই নদী গুলো খননের দাবি জানিয়ে আসছেন। তবে এই নদী গুলোর তীরে গড়ে উঠা কিছু অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ছাড়া প্রশাসন আর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

পরিবেশবিদ সাইফুল্লাহ ইমরান বলেন, ‘যখন যেভাবে প্রয়োজন, তখন সেভাবেই কংশ, মগড়া সহ জেলার সকল নদ নদী গুলো ব্যবহার করা হচ্ছে। দিনের পর দিন নদী গুলো যেভাবে দখল ও দূষণ হচ্ছে, তাতে আমরা শঙ্কিত। এছাড়া শহরের মগড়া নদীর পানি এখন আর ব্যবহার করা যায় না। শহরে আগে ২০টির মতো স্নানের ঘাট ছিল। এখন তিন–চারটি ছাড়া বাকিগুলো দখল হয়ে গেছে। তবে প্রশাসন অভিযান চালিয়ে নদীর অনেক জায়গা উদ্ধার করেছে।

তিনি আরো বলেন, পাশাপাশি সম্পূর্ণ দখলমুক্ত করে নদী সংস্কার ও সৌন্দর্যবর্ধন করা হলে মগড়া নদী নেত্রকোনা শহরবাসীর জন্য আশীর্বাদ হবে। 

জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সারওয়ার জাহান বলেন, নেত্রকোনা শহরের ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া মগড়া নদী পুনঃখনন নামে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে জরিপ কাজ চলছে। আর জেলা প্রশাসনের সঙ্গে পরামর্শ করে বাকি সকল নদ নদী গুলোর তীরে অবস্থিত সকল অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, নেত্রকোনা শহরকে দুই ভাগে ভাগ করেছে এই ঐতিহ্যবাহী মগড়া নদী। এই নদীর উভয় অংশের যোগাযোগের জন্য অন্তত সাতটি সেতু আছে শহরের ভেতরে। এই সেতুগুলোর মধ্যে মোক্তারপাড়া সেতুটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই সেতুটি শহরের প্রধান সড়ক ঢাকা ময়মনসিংহ যেতে হয়। এই জেলার সকল নদীর সব স্থানেই ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। এমনকি পৌরসভার নালা-নর্দমার পানি ও ফেলা হচ্ছে এই মগড়া নদীতে। 

ফলে বিভিন্ন এলাকায় কচুরিপানা ও জলজ উদ্ভিদ জন্মে ডোবার মতো হয়েছে ঐতিহ্যবাহী মগড়া নদীর চেহারা। মোক্তারপাড়া এলাকার কাজল বলেন, এই শহরের প্রাণ মগড়া নদী, এখন এই নদীতে ময়লা-আবর্জনা ফেলায় পানি পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।এখন ময়লা আবর্জনা ফেলার জন্য নোংরা পরিবেশের কারণে মশা-মাছির উপদ্রব থাকে। মাঝে মধ্যে মাছ মরে ভেসে ওঠে। তিন বছর আগে প্রশাসন কিছু এলাকা দখলমুক্ত করে। সেগুলো তদারকি না করায় আবার দখল হয়ে যাচ্ছে নেত্রকোনা জেলা শহরের প্রাণ ঐতিহ্যবাহী মগড়া নদী। 

পাউবোর সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ম. এনামুল হক বাংলাদেশের নদ-নদী গ্রন্থে লিখেছেন, ময়মনসিংহের ফুলপুরের ধলাই নদের দক্ষিণমুখী প্রবাহ সুয়াই নদের সঙ্গে মিলে নেত্রকোনা সদর উপজেলার রৌহা এলাকায় মগড়া নাম ধারণ করে। এরপর জেলা শহর হয়ে আটপাড়া উপজেলা ঘুরে ৯০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মদন উপজেলার বারুণী নদীতে মিলিত হয়েছে। নেত্রকোনার ভেতরে নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৭৪ কিলোমিটার। 

নেত্রকোনা শহরের মোক্তারপাড়া এলাকার বাসিন্দা কামরুল হাসান জানান, অতীতে মগড়া প্রমত্ত ছিল। জোয়ার-ভাটা হতো। বরিশাল, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে নদী দিয়ে বড় বড় মহাজনি নৌকা আসত। সব সময় নদীতে পালতোলা নৌকা, স্টিমার ও লঞ্চ চলত। কিন্তু ১৯৬৫ সালে মোক্তারপাড়া এলাকায় পাকা সেতু নির্মাণ করার পর বড় নৌকা চলাচল বন্ধ হয়ে গেলেও ছোট ও মাঝারি নৌকা চলত। কিন্তু চার বছর আগে এই সেতু নতুন করে নির্মাণ করা হয়। সেতুটির উচ্চতা কম থাকায় শুরু থেকেই নৌ চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।

নির্মাণের সময় স্থানীয় ব্যক্তিরা সেতু উঁচু করার জন্য বারবার দাবি জানালেও কর্মকর্তারা তা শোনেননি। পরিকল্পিতভাবে এই ঐতিহ্যবাহী মগড়া নদীটিকে হত্যা করা হয়েছে। শুধু মগড়া নয় এই জেলার অনেক নদ নদী গুলোর একেই হাল।

নেত্রকোনা শহরের পাটপট্টি এলাকার বাসিন্দা মূদুল চৌধুরী বলেন, দখল-দূষণে মগড়া সহ এখন জেলার অনেক নদী বিপন্ন। গৃহস্থালি থেকে শুরু করে এমন কোনো বর্জ্য নেই, যা নদীতে ফেলা হচ্ছে না। যাঁরা এই নদী গুলোকে হত্যা করছেন, তাঁদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি। 

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন থেকে মগড়া নদীর দখলদারদের যে তালিকা প্রকাশ করা হয়, তাতে ৩১৬টি অবৈধ স্থাপনার উল্লেখ ছিল। এর মধ্যে বিআরএস অনুযায়ী মেপে অভিযান চালিয়ে ২৯৩টি স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। বাকি ২৩টি স্থাপনা নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা থাকায় তা আর করা সম্ভব হয়নি। অভিযানে উদ্ধার হওয়া ভূমির পরিমাণ ১৪ দশমিক ৮০ একর। 

নেত্রকোনার পৌরমেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব নজরুল ইসলাম জানান, মগড়া নদীর পরিস্কার করাসহ আনন্দবাজার থেকে মোক্তার পাড়া সেতু পর্যন্ত সৌন্দর্য বর্ধনে পরিকল্পনা রয়েছে।

জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ জানান, সিএস অনুযায়ী নদীর জরিপ কার্যক্রম চলছে। বাজেট হলে মগড়া নদীর দখলরোধ আর দুষণমুক্তকরণের ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সোনালীনিউজ/এম

Wordbridge School
Link copied!