• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

বোরোয় কৃষকের লোকসান কেজিতে ৯ টাকা


বিশেষ প্রতিনিধি জুলাই ৩, ২০১৮, ০৭:২৩ পিএম
বোরোয় কৃষকের লোকসান কেজিতে ৯ টাকা

ঢাকা : চলতি বোরো মৌসুমে প্রতিকেজি ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচ গুনতে হয়েছে ২৪ টাকা। অর্থাৎ এ বছর মণপ্রতি বোরো ধানের উৎপাদন খরচ ৯৬০ টাকা। আর সেই ধান বাজারে বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৬০০ টাকা মণ দরে। অর্থাৎ প্রতিমণে এবারো কৃষককে ৩৬০ টাকার বেশি লোকসান গুনতে হচ্ছে। সরকার ধানের সংগ্রহ মূল্য ১ হাজার ৪০ টাকা নির্ধারণ করলেও সে সুফল পায়নি প্রকৃত কৃষকরা। কারণ তাদের ধান বিক্রির সময় সরকার সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। ফলে অধিকাংশ ধান ইতোমধ্যে চলে গেছে ফড়িয়াদের হাতে। কৃষকের সর্বনাশে ফুরফুরে মেজাজে আছে ফড়িয়া ও আড়তদাররা। কারণ কিছুদিনের মধ্যে সরকার চড়া দামে বোরো ধান-চাল কিনবে। আবার সরকারের চড়া দামে ধান কেনার প্রভাব পড়বে বাজারে। ভোক্তাও পাবে না কমদামে চাল কেনার সুযোগ। ফলে বাজারও থাকবে চড়া। কমে কেনা আর বেশিতে বিক্রির অর্থ যাবে সেই সুবিধাভোগী ব্যবসায়ীদের হাতে।

রাষ্ট্রায়ত্ত গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক কে এ এস মুর্শিদ বলেন, চালের দাম বেশি আর ধানের দাম পায় না কৃষক- এটা যেন চিরাচরিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু কৃষককে দাম না দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। নতুবা তারা চাষাবাদ করবে কেন?  তিনি বলেন, সরকার যেটুকু ধান-চাল নির্ধারিত মূল্যে কিনছে তা খুবই সামান্য। তা দিয়ে বাজারে দাম নির্ধারণ সম্ভব নয়। আবার এর থেকে বেশি ধান-চাল সরকারের রাখারও সামর্থ্য নেই। ফলে কৃষককে প্রকৃত দাম দিতে বিকল্প কোনো উদ্যোগ নিতে হবে।  

সরকার কৃষকদের নায্য মূল্য দিতে ধান-চালের সংগ্রহ মূল্য বাড়িয়ে নির্ধারণ করেছিল এ বছর। এতে বাজারে চালের দাম বর্ধিত থাকলেও কৃষকের কথা বিবেচনায় এনে সায় দিচ্ছে অনেকে। এই বোরো মৌসুমে প্রতিকেজি ধান ২৬ টাকা দর হিসেবে সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কিন্তু বাজারে বর্তমানে ধান মণপ্রতি ৬০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সে হিসাবে প্রতি কেজি ধানের দাম দাঁড়ায় ১৫ টাকা। এই দামে ধান কিনে দেশের ফড়িয়া ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা সরকারের কাছে বেচবে ২৬ টাকায়।  

ফড়িয়াদের থেকেও বেশি পোয়াবারো হবে মিল মালিকদের। ৬০০ টাকা দরে ধান কিনে তারা যে চাল করছে, তা সরকার প্রতি কেজি ৩৮ টাকা দরে কিনে নেবে। বর্তমান বাজারদরে ধান কিনলে তা চালে রূপান্তর করে এর দাম দাঁড়াবে ২৭ টাকা। অর্থাৎ সেই চাল সরকারি গুদামে দিতে পারলে প্রতি কেজিতে মুনাফা হবে ১১ টাকা। অন্যান্য খরচ বাদে এবার ৯ লাখ টন চাল সরবরাহ করে মিলাররা হাতিয়ে নেবে সাড়ে ৯০০ কোটি টাকার ওপরে।  

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বছর সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ সময়মতো শুরু না হওয়ায় বাজারে ধানের দাম কমেছে। অথচ যখন সরকার পুরোদমে ধান কেনা শুরু করবে, তখন কৃষকের গোলা থাকবে শূন্য। ধান থাকবে ফড়িয়া, দালাল ও মিলারদের কাছে। এ প্রক্রিয়ায় প্রতিবছর ধান-চাল কিনছে সরকার। ফলে মুনাফা যাচ্ছে ফড়িয়া ও মিল মালিকদের পকেটে। দেশের এমন পরিস্থিতিতে বাম্পার ফলনের পরও হাসি নেই কৃষকের মুখে। মুনাফা তো দূরের কথা, এবার ধানের আবাদ করে খরচের ঘাটতি মেটাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছে অনেকে। এ অবস্থায় ফসল উৎপাদনে আগ্রহ হারাচ্ছে কৃষক।

শস্যভান্ডার হিসেবে খ্যাত নওগাঁর কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক বিঘা (৩৩ শতক) জমিতে এ বছর ধান উৎপাদন করতে খরচ হয়েছে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। যদিও বর্গাচাষিদের ক্ষেত্রে সে খরচ আরো ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা বেশি। আর এবার বিঘাপ্রতি ধানের ফলন হয়েছে ২২ থেকে ২৫ মণ পর্যন্ত, যা চড়া পারিশ্রমিক দিয়ে ঘরে উঠাতে হচ্ছে। চলতি দামে বাজারে ধান বিক্রি করে বিঘাপ্রতি ১৫ হাজার টাকার বেশি মিলছে না। ফলে অধিকাংশ প্রান্তিক কৃষকই লোকসানের মুখে পড়েছে।  

জেলার রানীনগর উপজেলার কনোজ গ্রামের বর্গাচাষি ওহিদুর রহমান বলেন, গত বছর ধানের ক্ষতি হওয়াতে এবার কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণ তুলে প্রায় পাঁচ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করেছিলাম। নিজে শ্রম দিয়েও প্রতি বিঘায় তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে। ব্যাংক লোনের টাকা পরিশোধে এখন বাড়িঘর ছাড়ার অবস্থা দাঁড়াবে।  

পাশের হরিশপুর গ্রামের কৃষক আবদুল মান্নান জানান, ধানের ফলন ভালো হলেও শেষদিকে বৈরী আবহাওয়ার কারণে ধান কাটতে অনেক বেশি পারিশ্রমিক দিয়ে শ্রমিক নিতে হয়েছে। কিন্তু উপযুক্ত মূল্য না পাওয়ায় খুব লোকসান হয়েছে তার। কীভাবে এ লোকসান কাটিয়ে উঠবেন তা নিয়ে চরম হতাশায় রয়েছে তার পুরো পরিবার। কৃষকদের হিসাবে, গত এক মাস অতিবৃষ্টি ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে নিচু জমিতে জলাবদ্ধতায় অতিরিক্ত শ্রমিক মজুরি, পরিবহন, মাড়াইসহ খরচ কয়েকগুণ বেড়েছে। শুধু জমি থেকে ধান কেটে ঘরে তুলতে বিঘাপ্রতি ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। রোপণ খরচসহ যা দাঁড়িয়েছে ১৪ থেকে ১৮ হাজার টাকায়। কিন্তু বাজারে ধান মণপ্রতি ৬০০ থেকে ৭০০ টাকার বেশি বিক্রি সম্ভব হচ্ছে না। একই পরিস্থিতির খবর পাওয়া গেছে উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম, নাটোরসহ কুষ্টিয়া, সুনামগঞ্জ ও খুলনা থেকে।

এদিকে কৃষকসহ সংশ্লিষ্টদের দাবি, সরকার যে ধান-চাল কিনছে তা প্রকৃত কৃষকের কাছ থেকে কেনা হচ্ছে না। এ ছাড়া সরকারের বিলম্ব ক্রয়নীতি ও ধান সরবরাহের শর্তে আট ধরনের জটিলতায় কৃষকরা স্থানীয় খাদ্যগুদামে ধান সরবরাহ করতে পারছে না। ফলে সরকারের দেওয়া সুফল যাচ্ছে ফড়িয়া ও মিল মালিকদের ঘরে।  

এ পর্যন্ত সারা দেশে বোরো ধান কাটার ৯৮ ভাগ শেষ হলেও সর্বত্র ধান সংগ্রহ শুরু করতে পারেনি সরকার। খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির বৈঠকে দেড় লাখ টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত হয় দেড় মাস আগে। ২ মে থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত এই ধান কেনার কথা ছিল। কিন্তু গত ২৮ মে পর্যন্ত সারা দেশে ধান সংগ্রহের অনুমতি দেয়নি খাদ্য মন্ত্রণালয়। ধান সংগ্রহের অনুমতি না পাওয়া একটি জেলা সুনামগঞ্জের খাদ্য নিয়ন্ত্রক জাকারিয়া মুস্তফা বলেন, সরকার থেকে ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার চিঠি আমরা পেয়েছি। তবে জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সঙ্গে মিটিং করতে পারিনি। ফলে সংগ্রহ শুরু হয়নি। দ্রুত আমরা এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত নেব।

এদিকে সম্প্রতি সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ বিলম্বিত হওয়া কৃষকের উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার বড় কারণ বলে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে হাওর অ্যাডভোকেসি প্লাটফর্ম (হ্যাপ)। সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক শরিফুজ্জামান শরিফ বলেন, হাওর অঞ্চলের কৃষকদের ধান বিক্রির জন্য পর্যাপ্ত ক্রয়কেন্দ্র ও সংরক্ষণের জায়গা নেই। বাধ্য হয়ে কৃষকরা কমদামে ফড়িয়াদের কাছে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। তিনি জানান, সরকার ১ হাজার ৪০ টাকা মণ দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু হাওরের কৃষকরা কোথাও কোথাও ৫৫০ টাকা মণ দরে ধান বিক্রি করছে।

এদিকে খাদ্য অধিদফতর বলছে, বোরো সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার বিভাজন চেয়ে মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হলেও সাড়া মেলেনি। এ পর্যন্ত মাত্র ৯ জেলায় ১৫ হাজার ২০০ টন ধান সংগ্রহের অনুমতি মিললেও বাকি জেলায় এখনো কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়নি। তবে এ বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কারো মন্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। 

প্রতিবেদন প্রস্তুতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন খুলনা ব্যুরো, নওগাঁ, কুড়িগ্রাম, নাটোর ও সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!