• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আখেরি মোনাজাতে শেষ বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব


গাজীপুর প্রতিনিধি জানুয়ারি ১৫, ২০১৭, ০৫:৫১ পিএম
আখেরি মোনাজাতে শেষ বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব

মুসলিম উম্মাহর শান্তি, ঐক্য, সমৃদ্ধি, ইহকাল ও পরকালে মুক্তি, দেশ ও জাতির কল্যাণ শান্তি কামনা করে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে বিশ্ব ইজতেমার প্রথমপর্ব। মোনাজাত চলাকালে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লির কন্ঠে ‘হে আল্লাহ, ইয়া আল্লাহু, আমিন’, ‘আমিন, আমিন’ ধ্বনিতে মুখরিত টঙ্গীর তুরাগ নদের তীর। আত্মশুদ্ধি ও নিজ নিজ গুনাহ মাফের পাশাপাশি দুনিয়ার সব বালা-মুসিবত থেকে হেফাজতের আশায় দুই হাত তুলে অনুনয়-বিনয় করে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে রহমত প্রার্থনা করেন বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে শরিক হওয়া বিভিন্ন বয়সীর মানুষ।

আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে রোববার বেলা ১১টা ৩৬ মিনিটে শেষ হয় ৫২তম বিশ্ব ইজতেমার তিন দিনের প্রথম পর্ব। আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে রোববার ভোর রাত থেকেই মুসল্লিদের ঢল নামে টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে। এদিকে আখেরি মোনাজাতকে কেন্দ্র করে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে।
 
চার দিন বিরতি দিয়ে আবার ২০ জানুয়ারি থেকে বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় দফা শুরু হবে। ২২ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্যামে শেষ হবে এবারের বিশ্বইজতেমার আসর।

৮ মুসুল্লির মৃত্যু : বিশ্ব ইজতেমার মাসলাহাল জামাতের আমীর আদম আলী জানান, শনিবার সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আরও এক মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। তিনি হলেন, ঢাকার সবুজবাগের কদমতলা এলাকার গফুর উদ্দিনের ছেলে বেদন মিয়া (৬০)। এছাড়াও আরও ৭ মুসুল্লির মৃত্যু হয়েছে। এরা হচ্ছে- নিহত বাবুল মিয়া (৬০) ফেনীর দাগনভূইয়া উপজেলার মাছিমপুর এলাকার আব্দুর রশিদের ছেলে, মানিকগঞ্জে সাহেব আলী (৩৫), ময়মনসিংহের নান্দাইলের মারুয়া গ্রামের মৃত আহম্মদ আলীর ছেলে মো. ফজলুল হক (৫৬), সাতক্ষীরা জেলা সদরের খেজুরডাঙ্গা এলাকার মৃত আব্দুস সোবাহানের ছেলে আ. আব্দুস সাত্তার (৬০), টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি উপজেলার নিজবন্নী এলাকায় মো. জানু ফকির (৭০), কক্সবাজারের মো. হোসেন আলী (৬৫) এবং তারা মিয়া (৬৫) ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরের জগতশাহ গ্রামের মৃত হাসান মিয়ার ছেলে মারা যান। এবারের প্রথম পর্বের ইজতেমার প্রথম দফায় মোট ৮ জন মুসল্লির মৃত্যু হয়।

আখেরি মোনাজাত : বিশ্ব তাবলিগ জামাতের শীর্ষস্থানীয় মুরব্বি ভারতের হযরত মাওলানা মুহাম্মদ সাদ বেলা ১১টা ১ মিনিটের দিকে আখেরি মোনাজাত শুরু করেন। মোনাজাত শুরুর পর সমগ্র ইজতেমাস্থল ও আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে নেমে আসে পিনপতন নিরবতা। মোনাজাত চলে ১১টা ৩৬ মিনিট পর্যন্ত। ৩৫ মিনিট স্থায়ী এ আখেরি মোনাজাত চলাকালে ক্ষণে ক্ষণে ‘আমিন’ ‘আমিন ধ্বনিতে চারপাশ প্রকম্পিত হয়ে উঠে। হযরত মাওলানা মুহাম্মদ সাদ আখেরি মোনাজাত আরবি ও উর্দু ভাষায় পরিচালনা করেন। এর আগে রোববার সকাল সোয়া ৮টার দিকে শুরু হয় হেদায়েদি বয়ান। আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত চলে এ বয়ান।

সরেজমিনে দেখা গেছে, রোববার (১৫ জানুয়ারি) ভোররাত থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাড়কের গাজীপুরের চান্দনা-চৌরাস্তা এলাকা থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকায় মুসল্লিরা পায়ে হেঁটে ইজতেমা ময়দানের দিকে যাচ্ছেন। যানবাহন চালাচল বন্ধ থাকায় অনেকে রিকশা দিয়েও ইজতেমা ময়দানে পৌঁছান।

গাজীপুর ভোগড়া বাইপাস এলাকার বাসিন্দা আ. হালিম মিয়ার সঙ্গে এলাকায় কথা হয়। তিনি জানান, ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে ভোররাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছেন। চৌরাস্তার পর থেকে গাড়ি চলতে না দেয়ায় পায়ে হেঁটে রওনা হয়েছেন। তার মতো আরও হাজার হাজার মুসল্লি পায়ে হেটে ছুটে চলছেন। ফজরের নামাজেও আশপাশের এলাকার মুসল্লিরা অংশগ্রহণ করেছেন।

কনকনে শীত উপেক্ষা করে আখেরি মোনাজাতে শরিক হতে তাবলিগ জামাতের মুসল্লিরা ছাড়াও আশপাশের জেলার মুসল্লিরা শীত উপেক্ষা শনিবার রাত থেকেই ইজতেমা ময়দানে আসেন। আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের আশপাশের মহাসড়ক-সড়কে (ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ভোগড়া বাইপাস থেকে ঢাকা রেডিসন পর্যন্ত, টঙ্গী-কালীগঞ্জ স্টেশনরোড থেকে মীরেরবাজার পর্যন্ত, আশুলিয়া সড়কের সড়কের আব্দুল্লাহপুর থেকে বাইপাইল সড়ক পর্যন্ত) গণপরিবহন চলাচল বন্ধ থাকায় ওই সব সড়ক দিয়ে রোববার ভোর থেকে মুসল্লিরা হেটে দলে দলে লোক ইজতেমাস্থলে আসেন। ময়দানের চারদিক দিয়েই ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা আসেন। কেউ ময়দানে গিয়ে নিজের এলাকা থেকে আসা তাবলীগ জামাতের সাথীদের সঙ্গে নির্দিষ্ট খিত্তায় গিয়ে অবস্থান নেন।

সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ইজতেমা ময়দান পূর্ণ হয়ে গেলে মুসল্লিরা মাঠের আশে-পাশের রাস্তা, অলি-গলিতে অবস্থান নেন। পুরানো খবরের কাগজ, পাটি, সিমেন্টের বস্তা ও পলিথিন সিট বিছিয়ে বসে পড়েন। এছাড়াও পার্শ্ববর্তী বাসা-বাড়ি, কলকারখানা-অফিস, দোকানের ছাদে, যানবাহনের ছাদে ও তুরাগ নদীতে নৌকায় মুসল্লিরা অবস্থান নেন। ইজতেমাস্থলের চারপাশের ৫-৬ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। ইজতেমা ময়দান ও আশপাশ এলাকায় যে দিকে চোখ যায় সে দিকেই দেখা যায় শুধু টুপি-পাঞ্জাবি পড়া মানুষের কাফেলা। নানা বয়সি ও পেশার মানুষ এমনকি নারীরাও ভিড় ঠেলে মোনাজাতে অংশ নিতে রোববার সকালেই টঙ্গী এলাকায় পৌঁছেন।

মোনাজাতে ভিআইপি’র অংশগ্রহণ : মুসল্লিদের সাথে ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আ ক ম মোজাম্মেল হক, স্থানীয় সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল, গাজীপুরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র মো. আসাদুজ্জামান কিরণ, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাভোকেট আজমত উল্যাহ খান প্রমুখ মোনাজাতে অংশ নেন।

আখেরি মোনাজাতে নিরাপত্তা : গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন আর রশিদ জানান, আখেরি মোনাজাতের পর মুসল্লিদের বাড়ি ফেরা পর্যন্ত ইজতেমা ময়দানসহ আশপাশের এলাকায় পুলিশের ৬ হাজারের বেশি পুলিশ নিয়োজিত থাকবে। এছাড়া সাদা পোশাকে মুসল্লিদের বেশে খিত্তায় খিত্তায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়।

বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে বিকল্প রাস্তা ও পার্কিং : রোববার ৫২তম বিশ্ব ইজতেমার ১ম পর্বের আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে বিকল্প রাস্তা ও গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। গাজীপুর জেলা অফিসার এস. এম রাহাত হাসনাত জানান, ইজতেমায় ভিভিআইপি, ভিআইপিসহ উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ দেশি-বিদেশি প্রায় ৩৫ লাখ মুসল্লির আখেরি মোনাজাতের অংশগ্রহণ করবেন। দুই পর্বের আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণের জন্য গাজীপুর চান্দনা চৌরাস্তা হতে হাজার হাজার মুসল্লি পায়ে হেটে ইজতেমা ময়দানে যাতায়াত করবে বিধায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের চান্দনা চৌরাস্তা হতে টঙ্গী ব্রীজ পর্যন্ত সকাল ৬টা হতে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। এছাড়াও কালীগঞ্জ-টঙ্গী মহাসড়কের মাজুখান ব্রীজ হতে স্টেশনরোড ওভার ব্রীজ পর্যন্ত এবং কামারপাড়া ব্রীজ হতে মুন্নু টেক্সটাইল মিল গেট পর্যন্ত সড়ক বন্ধ থাকে।

বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে গাজীপুর পুলিশ বিভাগ বিশ্বইজতেমার মুসল্লিদের সুবিধার্থে যাহবাহন চলাচলের নির্ধারিত রুট ও পার্কিংয়ের নির্দেশনা দেয়া হয়।

গাজীপুর ট্রাফিক বিভাগের সহকারি পুলিশ সুপার মো. সালেহ উদ্দিন আহমেদ জানান, দুই দফারই আখেরি মোনাজাতের আগের দিন যথাক্রমে ১৪ জানুয়ারি এবং ২১ জানুয়ারি মধ্যরাত থেকে আখেরি মোনাজত শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ভোগড়া বাইপাস হতে টঙ্গী ব্রীজ পর্যন্ত, কালীগঞ্জ-টঙ্গী সড়কের মাজূখান ব্রীজ থেকে স্টেশন রোড ওভারব্রীজ পর্যন্ত, কামারপাড়া ব্রীজ হতে মন্নু ট্রেক্সটাইল মিল পর্যন্ত সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। প্রয়োজনে টঙ্গী ব্রীজের পূর্ব পাশে এবং কামারপাড়া ব্রীজের উত্তরপাশে নৌকাসহ সকল প্রকার নৌযান নোঙ্গর করে। তবে ঢাকাগামী যানবাহনগুলে টঙ্গী হয়ে ডিএমপি এলাকায় প্রবেশের পরিবর্তে জয়দেবপুরের চান্দনা-চৌরাস্তা, কোনাবাড়ি, চন্দ্রা ত্রি-মোড়, বাইপাইল, নবীনগর ও আমিনবাজার হয়ে যানবাহন চলাচলের পরামর্শ দেয়া হয়।

পার্কিং : ইজতেমার মুসল্লিদের বহনকারী যানবাহগুলো গাজীপুরের নির্ধারিত স্থানগুলোতে পার্কিং করার জন্য বলা হয়েছে। টঙ্গীর কাদেরিয়া টেক্সটাইল মিলের খোলা জায়গা, মেঘনা টেক্সটাইল মিলের পাশের রাস্তার উভয় পাশে, সফিউদ্দিন একাডেমির মাঠ, সফিউদ্দিন একাডেমির উত্তর পাশে টিআইসি মাঠ, জয়দেবপুর থানাধীন ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ মাঠ, চান্দনা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ, চৌরাস্তা  ট্রাক স্ট্যান্ড, টঙ্গীর কে-টু  (নেভি) সিগারেট কারখানার পাশে খোলা জায়গায় গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়।

মোবাইল ও টিভির সামনে মোনাজাতে অংশগ্রহণ : টঙ্গীর আশপাশের এলাকাগুলোতে বিভিন্নস্থানে মোবাইলের মাধ্যমে মোনাজাতে অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে। এছাড়াও বিভিন্ন বাড়িতে, চায়ের দোকান ও বাজারে টিভির সামনে মোনাজাতে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এইচএআর

Wordbridge School
Link copied!