• ঢাকা
  • শনিবার, ১১ মে, ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

এই দিনে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে রংপুরে


ফরহাদুজ্জামান ফারুক, রংপুর ব্যুরো মার্চ ২৮, ২০১৮, ১২:২৫ পিএম
এই দিনে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে রংপুরে

রংপুর: আজ ২৮ মার্চ। ১৯৭১’র এই দিনে পাকিস্তানি হায়েনাদের আবাসস্থল রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করে আদিবাসীসহ কয়েক হাজার বাঙালি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই আক্রমণ নিরস্ত্র মুক্তিকামীদের জোটবদ্ধ লড়াইয়ের অনন্য উদাহরণ।

সেদিন তীর-ধনুক নিয়ে পাক হানাদারদের ওপর হামলা চালায় রংপুরের মানুষ। পাক হানাদারের গুলিতে নিরস্ত্র মুক্তিকামী হাজারো মানুষ সেদিন গুলিবিদ্ধ হয়। শহীদ হয় দেড় হাজারের বেশি বাঙালি। এমন আক্রমণের ঘটনা সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন, যা ঘটিয়েছিলেন রংপুরের বীর জনতা। তাই আজকের এই দিনটি  মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক অনন্য দিন।

১৯৭১’র ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর দেয়া ভাষণই আদিবাসীসহ, সর্বস্তরের মানুষকে করেছিল একজোট। এরও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান রংপুর সফরে এসে ১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই এক জনসভায় অংশ নিতে রংপুরের নিসবেতগঞ্জের বাঁশহাটিতে এসেছিলেন।

সেই দিন জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘‘বাঁশহাটির বাঁশের লাঠি নিয়ে তৈরি থেকো। ছয় দফা নয়, এক দফা প্রতিষ্ঠার খবর পাবে।’’ সেই খবর তাঁরা পেয়েছিলেন ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার সংগ্রামে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে নিরস্ত্র আদিবাসী সাওতাল ও সাধারণ মানুষ ২৮ মার্চ আদিবাসী সাওতালসহ সাধারণ জনগণ তীর-ধনুক, বাঁশের লাঠি, দা, কুড়াল নিয়ে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে আক্রমণ করে।
সেদিন বলদীপুকুর এলাকা থেকে আসে ওঁরাও উপজাতিদের নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা বুদু ওঁরাও এর নেতৃত্বে কয়েক হাজার ওঁরাও। সবার মুখে ছিল গগনবিদারী স্লোগান ‘‘এস ভাই অস্ত্র ধর, ক্যান্টনমেন্ট দখল কর।’’

২৮ মার্চে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেয়া একাধিক মুক্তিযোদ্ধা জানান, রংপুরে মূলত দুই দিন আগ থেকেই যুদ্ধ হয়েছিলো। ২৪ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ট্যাংক ডিভিশনের পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেনসহ তিন জওয়ানকে হত্যার মধ্য দিয়ে ২৪ মার্চই স্বাধীনতার যুদ্ধ আরম্ভ করে রংপুরের মানুষ।

তৎকালীন সময়ের সাতগাড়া ইউনিয়নের (বর্তমানে রংপুর সিটি কর্পোরেশন এর অন্তর্ভূক্ত এলাকা) দামোদরপুরের সাধারণ দিনমজুর ও অনাহারী জীর্ণশীর্ণ মানুষরা সেদিন যে সাহসিকতার পরিচয় দেখিয়েছিলেন তা এক গর্বের ইতিহাস।

এঘটনার পর পাকিস্তানী হায়েনার দল রংপুরে জ্বালাও পোড়াও শুরু করে। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ক্যান্টনমেন্টের পাশের গ্রাম নিসবেতগঞ্জ, দামোদারপুরে পাকিস্তানি বাহিনী সিরিজ হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়। একই সাথে ৩২ জনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে পরের দিন জুমার নামাজের সময় লাহিড়িরহাটের কাছে একটি মাঠে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।

এ ঘটনায় মানুষ আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। বিক্ষুব্ধ মানুষকে সংগঠিত করেন তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সিদ্দিক হোসেন, আব্দুল গণি, তৈয়বুর রহমান (মরহুম), মজিবর রহমান, মুকুল মোস্তাফিজ, ছাত্রনেতা রফিকুল ইসলাম গোলাপ, মুখতার ইলাহী (শহীদ), মান্নান, আবুল মনসুর, ইসহাক চৌধুরী, আব্দুল আউয়াল টুকু, ন্যাপ নেতা শামসুজ্জামান, কমিউনিস্ট নেতা ছয়ের উদ্দিনসহ আরো অনেকেই।
 
এরই মধ্যে চলতে থাকে জেলার প্রথম সারির আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে ক্যান্টনমেন্ট আর ইপিআর বাহিনীর কিছুসংখ্যক বাঙালি অফিসারের সাথে গোপন যোগাযোগ। এক পর্যায়ে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করে অবাঙালি সৈন্যদের বন্দী করে ক্যান্টনমেন্ট দখল করার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়।

এই পরিকল্পনা ও অবাঙালি সৈন্যদের গোপনে সংগঠিত করার গুরু দ্বায়িত্বটি পালন করেন রংপুর ক্যান্টনমেন্টের ভেতর ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ এবং ওয়ারলেস অপারেটর নুরুজ্জামান ও ইপিআর বাহিনীসহ ট্যাংক ডিভিশনের বাঙালি সৈন্যরা। কর্নেল ডা. এম হোসেন এর সাথে যোগাযোগ করে ওয়ারলেস অপারেটর নুরুজ্জামান সব খবর মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের গোপনে পৌঁছে দিতেন । ধীরে ধীরে রংপুর উত্তপ্ত হতে থাকে।

কিন্তু ২৮ মার্চ যে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করা হবে তা আগে থেকে পরিকল্পিত ছিল না। তবে এতটুকু আলোচনা ছিল যে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করা হবে। সাধারণ মানুষের বিক্ষুব্ধতা ২৮ মার্চ ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ২৬ মার্চ ক্যান্টনমেন্টে খাবার সরবরাহকারী ঠিকাদার মোল্লা মাষ্টার সকাল বেলা শেখ আমজাদকে তার বাড়িতে এসে খবর দেন যদি বিক্ষুব্ধ বাঙালিরা ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করে তা হলে ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ট্যাংক ডিভিশন বেরিয়ে এসে অস্ত্রসহ বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসীর পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ শুরু করবে। এ খবর পেয়ে অসীম সাহসী হয়ে উঠে গ্রামবাসী।

পাকিস্তানি সেনারা কিছু আঁচ করতে পেরেছিলো, একারণে সকল বাঙালি সৈন্যদের ২৭ মার্চ রাতে আটক রেখে অস্ত্র জমা নিয়ে রাত ৮টার দিকে ইপিআর ক্যাম্পে হামলা চালায়। এ খবর বাইরে আসা মাত্রই গ্রামের হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ মানুষ তীর ধনুক-বল্লম, দা-কুড়াল আর বাঁশের লাঠি হাতে ক্যান্টনমেন্টের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে নিসবেতগঞ্জহাট ও তার আশপাশ এলাকাসহ ঘাঘট নদীর তীর ঘেষে জমায়েত হতে থাকে।

বেলা বাড়ার সাথে সাথেই মিঠাপুকুর, বলদিপুকুর, বদরগঞ্জ, রাণীপুকুর, মানজাইল, তামপাট, পালিচড়া, রামজীবন, বনগাঁও, বুড়িরহাট, হারাগাছ, গংগাচড়া, শ্যামপুর, দমদমা, লালবাগ, গনেশপুর, দামোদরপুর, দেওডোবা পাঠানপাড়া, পাগলাপীর, তারাগঞ্জসহ অন্যান্য এলাকা থেকে মানুষ ক্যান্টনমেন্ট এলাকয় জমা হতে থাকে। শুরু হয় সম্মুখ লড়াই।

সেদিন বলদিপুকুর এলাকা থেকে আসে ওঁরাও উপজাতিদের নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা বুদু ওঁরাও এর নেতৃত্বে কয়েক হাজার ওঁরাও। সবার মুখে ছিল গগনবিদারী স্লোগান ‘‘এস ভাই অস্ত্র ধর, ক্যান্টনমেন্ট দখল কর।’’ সাঁওতাল তীরন্দাজ বাহিনীরা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে ক্যান্টনমেন্টে ঢোকার চেষ্টা করেছিলো। এমন সময় বৃষ্টির মত ক্যান্টনমেন্ট থেকে আসতে থাকে আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি। অসম সেই লড়াইয়ে সেদিন পাক বাহিনীর ছোঁড়া মেশিন গানের গুলিবিদ্ধ হয়ে কয়েক শতাধিক লাশে সেখানে পড়েছিলো। এর মধ্যে কিছু মানুষের লাশ পাওয়া যায়। অন্যদের পাওয়া যায়নি। কিছু লাশ ক্যাম্পে পুড়িয়ে ফেলে হায়েনারা।

সেই ঐতিহাসিক ২৮ মার্চের স্মরণে এবং সেই সব বীর শহীদদের সম্মান জানিয়ে রংপুর শহরের প্রবেশদ্বার হিসেবে খ্যাত মডার্ন মোড়ে শুধুমাত্র একটি স্মৃতিস্তম্ভ ‘‘অর্জন’’ নির্মাণ করা হয়েছে। অথচ, এই দিনে ঠিক কত জন শহীদ হয়েছেন সে সম্পর্কে কোন অনুসন্ধানই আজও শুরু হয়নি।

রংপুর শহরের প্রবেশদ্বার মডার্ন মোড় দিয়ে শহরে প্রবেশের পথে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে একটি উঁচু স্থাপনা, যা একটি স্মারক ভাস্কর্য। নীল আকাশের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে একটি লাল ও একটি ধূসর স্তম্ভ, বেশ উঁচু। সবুজ ঘাসের গালিচা, তার উপরে লাল ভিত্তি, তার উপরে ধবধবে সাদা আর নিকষ কালো বেদিমূলের উপরে খাড়া লাল ও ধূসর স্তম্ভ দু'টি। যেন রংপুর শহরে আগমনকে স্বাগত জানাচ্ছে এই স্থাপনা।
একটু ভালো করে লক্ষ্য করলে চোখে পড়বে কমলা রঙের বাঁকানো ধনুকাকৃতি কাঠামো। একটু গভীর ভাবে লক্ষ্য করলে স্পষ্ট হবে পুরো ব্যাপারটা। আসলে লাল কালো স্তম্ভ দু'টি তীর, আর কমলা রঙের বাঁকানো কাঠামোটি হচ্ছে ধনুক। এই ভাস্কর্যের নাম ‘‘অর্জন’’!

রংপুরেরই কৃতি সন্তান ও দেশ বরেণ্য ভাস্কর অনিক রেজার অসাধারণ সৃষ্টিকর্ম এই ভাস্কর্য। এটাকে বলা হয়েছে ‘‘স্বাধীনতা স্মারক ভাস্কর্য’’। ১৯৯৯ সালের ২৪ জুলাই ভাস্কর্যটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

অর্জন নামের এই ভাস্কর্যটি ধারণ করে আছে রংপুরবাসীর সব চাইতে গৌরবের ঘটনাটি। আজও রংপুর শহর ও শহরতলীর কোন প্রবীণ ব্যক্তিকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে, দেখা যাবে একথা সে কথা বলার সাথে সাথে অবধারিতভাবে আসবে রংপুরে বীর জনতার ঐতিহাসিক ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও প্রসঙ্গ - ‘‘ও বাহে, কি কান্ডটায় না ঘটছিল বাহে, বাউংকা-লাঠি, বল্লম-কোঁচা আর তীর ধনুক ধরি হামরা ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও কইবার গেছিনু, মিলিটারীরঘরের মাইরবার, জয় বাংলা স্বাধীন কইরবার।’’

মহান মুক্তিযুদ্ধে রংপুরের মানুষের বীরত্বগাঁথা আজকের এই দিনটি ঘিরে রংপুর জেলা প্রসাশনসহ আওয়ামী লীগ, জাসদ, বাসদ ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছেন।


সোনালীনিউজ/ঢাকা/আকন

Wordbridge School
Link copied!