• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘ওঅল্ট হুইটম্যান অনুবাদের নেপথ্যে’


খালেদ হামিদী নভেম্বর ৭, ২০১৭, ১২:২৪ পিএম
‘ওঅল্ট হুইটম্যান অনুবাদের নেপথ্যে’

একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও প্রবন্ধরচিয়তা খালেদ হামিদী। আশির দশকের গুরুত্বপূর্ণ এই লেখকের এ পর্যন্ত নয়টি মৌলিক বই বের হয়েছে। ‘ওঅল্ট হুইটম্যানের কবিতা’ গ্রন্থটি দিয়ে সংখ্যা দাঁড়াল দশটিতে।

আমাদের দেশে হুইটম্যানের কবিতার, সম্ভবত প্রথম অনুবাদ, উপহার দেন সৈয়দ আলী আহসান।  কিন্তু গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হুইটম্যানের ওই অল্প কয়েকটি কবিতার আক্ষরিক অনুবাদে কবির প্রাণবানতা যে মোটেও ধরা পড়েনি তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। গদ্যধর্মী মুক্ত ছন্দে কৃত অনুবাদগুলোকে কিছু নুড়ি-পাথরের সমষ্টি ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না।

অথচ হুইটম্যানের কবিতাভুবন পরিভ্রমণকালে, অদ্ভুতভাবে, আমি তাঁর ফ্রি ভার্সেও টের পাই বাংলা মাত্রাবৃত্ত ছন্দের হেঁটে-হেঁটে চলা এবং স্বরবৃত্তের তালপ্রাধান্যের দোলা। কাজী নজরুল ইসলাম সং অফ মাইসেলফ্-এর প্রেরণায় মুক্তক মাত্রাবৃত্তে বিদ্রোহী কবিতা রচনা করেন বলেও হয়তো এমনটি ঘটে। এমনিতে ভিন্ন ভাষার সাহিত্য পড়ার সময়ই তো মাথায় অনুবাদ হয়ে যায়।

কিন্তু পাঠক হিসেবে, হোর্হে লুই বোর্হেসের ভাষায়, আমি নিজেই হয়ে উঠি হুইটম্যান। তাই আলোচ্য কবিকে, গেলও শতকের আশির দশকের শেষের দিকে, পাঠকালেই, এক বিস্ময়কর স্বতঃস্ফূর্ত তাগিদে, হাতে-কলমে অনুবাদ করে ফেলি, মাত্রাবৃত্ত, মন্দাক্রান্তা, স্বরবৃত্ত এবং মুক্তক অক্ষরবৃত্তেও, তাঁর দীর্ঘ, ক্ষুদ্র মিলিয়ে কয়েকটি কবিতা।

আজ এতো বছর পরে, সেই প্রায়-অপ্রকাশিত অনুবাদগুলো পরিমার্জনার সময়ও, উল্লিখিত বাংলা ছন্দের ব্যবহার মোটেও মূল কবিতার সঙ্গে বেমানান ঠেকে না। আমেরিকার আত্মা বলে খ্যাত ব্যক্তির সার্বভৌমত্বের কবি ওঅল্ট হুইটম্যানের প্রাণের ছন্দ এবং প্রাণপ্রাচুর্য এমন যে, ছন্দের আশ্রয় ছাড়া বাংলায় তাঁর কবিতা অনুবাদের প্রয়াস আবারো ব্যর্থ হতে পারে। এই পুস্তকে আমার প্রচেষ্টার পঁচিশটি নমুনা চয়ন করা গেলো। ‘নমুনা’ এ জন্যে বলা যে তৃণপত্রের সিগনেট ক্লাসিক (ইউএসএ) সংস্করণে দীর্ঘ, অতি দীর্ঘ, সিরিজ কাব্য, মাঝারি, ছোট ও অতি ক্ষুদ্র মিলিয়ে, কবিতার প্রধান ও সেই সঙ্গে একমাত্র শিরোনামের সংখ্যার ভিত্তিতে, মোট ৩৮৫টি কবিতা বিদ্যমান।

আজ এতো বছর পরে, সেই প্রায়-অপ্রকাশিত অনুবাদগুলো পরিমার্জনার সময়ও, উল্লিখিত বাংলা ছন্দের ব্যবহার মোটেও মূল কবিতার সঙ্গে বেমানান ঠেকে না। আমেরিকার আত্মা বলে খ্যাত ব্যক্তির সার্বভৌমত্বের কবি ওঅল্ট হুইটম্যানের প্রাণের ছন্দ এবং প্রাণপ্রাচুর্য এমন যে, ছন্দের আশ্রয় ছাড়া বাংলায় তাঁর কবিতা অনুবাদের প্রয়াস আবারো ব্যর্থ হতে পারে।

দিঘল কবিতার প্রতিটি অংশ বা প্রতিটা সিরিজও কবিতা হিসেবে প্রায় মৌলিক বিধায় সর্বমোট কবিতার সংখ্যা, প্রকৃত অর্থে, আরও বেশি। ব্যক্তিসত্তার স্মরণের কবি হুইটম্যান কিন্তু সকল প্রকার মানুষ এবং জগতের অন্য সব কিছুকেই আলিঙ্গন করেন। তাই তিনি হয়ে ওঠেন, একমাত্র তাঁর ধরনেই, ব্যষ্টিক নয়, যৌথ গণতন্ত্রের কবি।

তাছাড়া অধ্যাত্ম আর যৌনতাও তাঁর অপর দুটি মারাত্মক অঙ্গীকৃত বিষয়। তাঁর কবিতায় কল্লেলিত ‘বর্তমান’ আসলে তাঁরই জন্মভূমি উত্তর আমেরিকারই ‘ভবিষ্যৎ’। অন্য বড় কবিদের মতো ঈশ্বরে বিশ্বাসী হয়েও তিনি এমন তীব্রতম ইহজাগতিকতায় পুলকিত-শিহরিত-উচ্ছ্বাসিত-আন্দোলিত যে, একটি মহাদেশের জাগরণের, প্রাণপ্রাচুর্যের অগ্রিম অনেক প্রপঞ্চ তাঁর কবিতায় বিস্ময়কররূপে বাক্সময় হয়। ওই মহাদেশের সব দ্বন্দ্ব উৎপাদনশীলতা, উর্বরতা ও কোলাহলসমেত অনূদিত হয় তাঁর কবিতামালায়। এভাবে তিনি একটি নতুন দর্শনশক্তি সৃষ্টি করেন এবং অন্যদের পৃথিবীকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিও বদলে দেন।

১৯৯৯ সালে লিখিত ও তৃণপত্রের {Walt Whitman/Leaves of ‰rass/With a New Afterword by Peter Davison/Published by Signet Classic (USA)/First Signet Classic Printing (Davison Afterword), March 2000} সংস্করণে সংযোজিত গদ্যে পিটার ডেভিসন বলেন, হেরম্যান মেলভিলের মবি-ডিক (১৮৫১) আর হুইটম্যানের লীভস্ অফ গ্রাস ঊনবিংশ শতাব্দীর আমেরিকার সর্বোচ্চ আশাবাদী দুটি গ্রন্থ হিসেবে নিঃসংশয়ে দাঁড়িয়ে গেছে।

হুইটম্যানের প্রাণবানতা তাঁর শব্দরাশিকে এমন শাণিত ও মোক্ষম করে তোলে যে, বলা হয়, তাঁর কবিতার অভিঘাতে মৃত ব্যক্তি কফিন থেকে বেরিয়ে সটান দাঁড়ায়। সময়ের পরিশ্রুতি এবং ভাষা থেকে শ্বাস গ্রহণ নিশ্চিত করে তাঁর কবিতা। হুইটম্যানের দীর্ঘ কবিতাগুলোর পাঠ গ্রহণ দর্শক-শ্রোতাকে অভিভ‚ত-করা গায়কের গান শোনার মতো, যে গাইয়ে মঞ্চ এবং অপেরা হাউসকে স্বরের প্রচণ্ড তরঙ্গে পরিপূর্ণ করে তোলে। রবার্ট ফ্যানার এবং জেরোমি লাভিং ঊনিশ শতকের ইতালীয় অপেরার কথা উল্লেখ করেন যা হুইটম্যানের শ্রবণশক্তিকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে।

মারিয়েল রুকেসার মুভিং পিকচার ক্যামেরা আবিষ্কারের আগে রচিত হুইটম্যানের কবিতার সিকোয়েন্স প্রসঙ্গে বলেন, তা কেবল পরিচালক ও ক্যামেরাম্যান নয়, চলচ্চিত্র সম্পাদকের জন্যেও বিস্তারিত নির্দেশনা হয়ে উঠতে পারে। তিনি এই সিকোয়েন্সগুলোর ছন্দকে ফিল্ম রিদম এবং এগুলোর ফর্মকে মন্তাজ বলে অভিহিত করেন।

সত্যিই তাই, বিশ্বকবিতায় এমন শ্রবণ, দৃষ্টি ও প্রাণশক্তি তৃণপত্রের আগে মেলেনি। এই কাব্য ডি. এইচ. লরেন্স, ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা, হোর্হে লুই বোর্হেস এবং অক্তাভিও পাজকে স্পর্শ করে। পাবলো নেরুদা বলেন, ‘স্পেনের সার্ভেন্তিসের চেয়ে আমাকে অনেক বেশি শিখিয়েছেন ওঅল্ট হুইটম্যান।’

গেলো শতকের আশির দশকে তৃণপত্রের তৎপূর্বকালীন একটি সংকলন, আমারই অনুরোধে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার থেকে চেক আউট করেন কবি-কথা সাহিত্যিক-প্রাবন্ধিক-গবেষক মহীবুল আজিজ। তখন তিনি বাংলা বিভাগের প্রভাষক। আমি ব্যবস্থাপনা বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র। ১৯৮৮ সালের ২৬ মে থেকে ২৭ অগাস্ট এই মাস তিনেক সময়ে, বইটা চেক ইন করার সময় পার করে মহীবুল ভাইকে জরিমানা দেয়ার মতো অবস্থায় ফেলে, আমি দীর্ঘ, মাঝারি ও ছোট মিলিয়ে হুইটম্যানের পনেরোটি কবিতা অনুবাদ করে ফেলি। সেগুলোর কয়েকটি ছোট কাগজ লিরিক-এ তখন প্রকাশিত হয়।

এরপর ১৯৯১ সালের মধ্য জুলাইয়ে জীবিকা সকাশে আমার আরব যাত্রার প্রাক্কালে এই অনুবাদ ও আমারই সমস্ত মৌলিক রচনার পান্ডুলিপি আমি মহীবুল ভাইয়ের হাতে তুলে দেই। তিনিও সংরক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন হাসি মুখে। আমার প্রবাস যাপন শুরুর কিছু কাল পরেই তিনিও সস্ত্রীক প্রবাসী হন। কিন্তু তাঁর পিতৃপরিবারের অন্য সদস্যরা এই অভাজনের সমস্ত লেখা সযত্নে আগলে রাখেন আমার না ফেরা অব্দি। শিক্ষাজীবন শেষে বছর দেড়েক কর্মহীন থাকাকালে নিজ পৈতৃক নিবাসে, লিখিয়ে হিসেবে আমি, ভীষণ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ায়, মহীবুলের সঙ্গে আমি ওভাবে জড়িয়ে পড়ি।

১৯৯৭-এর ফেব্রুয়ারিতে ছুটিতে এসে আমি আরবে আর না ফিরলে আমার সমস্ত পান্ডুলিপি আমি অক্ষত অবস্থায় ফিরে পাই। মহীবুল আজিজ এবং তাঁর পরিবারের সবার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার তাই অন্ত নেই। সম্প্রতি আমাকে এ-বিষয়ে কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করেন আরও একজন। তিনি কবি ও প্রকাশক, তরুণ শব্দযোদ্ধা মনিরুল মনির। তাঁর প্রেরণায় হুইটম্যনের আরও দশটি, ২০ ও ২১ জানুয়ারি ’ ১৬ দু’দিনে ছুটি, ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখে তিনটি এবং ১৪ তারিখে একটি কবিতা অনুবাদের প্রয়াস পাই। নতুন বিলম্বিত পর্যায়ের এই অনুবাদেও ছন্দ হারাই না। ৮টি কবিতা মুক্তক অক্ষরবৃত্তে হলেও দুটি অনূদিত হয় যথাক্রমে মাত্রাবৃত্ত ও মন্দাক্রান্তায়।

বুঝতে পারি, হুইটম্যানের আশ্চর্য প্রাণশক্তি এই বয়সেও আমার তারুণ্য জিইয়ে রাখে, অংশত হলেও। এই যৌবন অটুট রাখতেই প্রথম দফার সেই অনুবাদে কোনো পরিবর্তন ঘটাইনি, বদলাতেও হয়নি। শুধু পড়ার শুরুতে আর স্বপ্নে দেখেছি স্বপ্ন কবিতা দুটির অন্তিম চরণ বাদ দেই। ওই লাইনগুলো ছিলো আমারই কবিত্বের সংযোগ, কবি যা বলেননি কিন্তু বলতে পারতেন ধরনের কথা, কিছুটা দূরান্বয়ী হলেও মূল থেকে একেবারে সরে যাওয়া নয়। তবুও মূলানুগ থাকার দায় তো এড়ানো যায় না।

তবে টিপ টিপ, রিনিঝিনি, ঝিরিঝিরি এমন ক্রিয়াবাচক বিশেষণ ধরনের কিছু শব্দসংযোগ পরিহার করা হয়নি মূলের অর্থান্তর না ঘটিয়ে বাংলা ভাষা ও বাংলার আবহে ন্যূনতম কাব্যিক ব্যঞ্জনা অটুট রাখার উদ্দেশ্যে। শুধু তোমাকে কবিতাটির ভাবানুবাদ বদলানো হয়নি তা মূলের বিরোধী হয়ে ওঠেনি ব’লে, এবং, এটাই এই বইয়ের একমাত্র ভাবানূদিত কবিতা। আর, অ্যা উইম্যান ওয়েইটস্ ফর মি কবিতার শিরোনামের প্রত্যক্ষ ভাষান্তরের পরিবর্তে ঈষৎ পরোক্ষ অথচ মূলানুগ অনুবাদ অক্ষুন্ন রাখা হয়।

উল্লেখ্য, ১৪ ফেব্রুয়ারি রাতে সং অফ মাইসেলফ্ শিরোনামের ৫২টি কবিতার শেষটি অনুবাদ না করলে এই ছোট্ট বইটিও অপূর্ণ থেকে যেতো। এই কবিতাটি আগে পড়া সত্ত্বেও শেষ পাঠেও আমি চমকে উঠি কেবল নয়, উঠে দাঁড়াই। অনেক বড় কবি না হলে নিজেকে কাদার কাছে উইল করে দেয়ার কথা বলতে পারেন না কেউ। আরেকটা কথা, আমার এই অনুবাদের অধিকাংশ ২০০৭, ২০১৫ এবং চলতি সালে যথাক্রমে দৈনিক ডেসটিনি, কীর্তিকলাপ আর নতুনধারায় প্রকাশিত হয়।     

খালেদ হামিদী

 

খালেদ হামিদীর প্রকাশিত বই
কবিতা: আমি অন্তঃসত্ত্বা হবো, হে সোনার এশীয়, মুখপরম্পরা, ধান থেকে শিশু হয়, স্লামডগ, মিলিয়নার নই।
গল্প : আকব্জিআঙুল নদীকূল।
উপন্যাস : সব্যসাচী।
প্রবন্ধ : কবির সন্ধানে কবিতার খোঁজে, না কবিতা, হাঁ কবিতা।
অনুবাদ : ওঅল্ট হুইটম্যানের কবিতা।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!