• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

চীন-ভারতের স্নায়ুযুদ্ধে কী করবে বাংলাদেশ


শেখ আবু তালেব ফেব্রুয়ারি ৯, ২০১৭, ১১:৪৫ এএম
চীন-ভারতের স্নায়ুযুদ্ধে কী করবে বাংলাদেশ

ঢাকা: সমরাস্ত্রের মজুদ নিয়ে নতুন একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে চীন। সমরাস্ত্র প্রদর্শনীতে বরাবরই রক্ষণশীল দেশটি এ ধরনের ভিডিও আগে কখনো প্রকাশ করেনি। যুদ্ধে জিততে যে মানের ক্ষেপণাস্ত্রের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি, সেটি ভিডিওতে গুরুত্ব দিয়ে দেখানো হয়েছে। দেশটির কাছে এ ধরনের অস্ত্র আগে সংখ্যায় কম ছিলো। সেই অস্ত্রের মজুদ বাড়িয়েছে বেইজিং। চীনের এ অস্ত্রের মজুদ নিয়ে সবচেয়ে উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছে ভারত।

চীন-ভারতের সম্পর্ক বরাবরই সন্দেহ-অবিশ্বাসের ওপর ভর করে টিকে আছে। ট্রাম্পের নীতি বদলানোর পূর্বাভাসে সেই সম্পর্ক প্রতিনিয়ত উত্তেজনাকর পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। চীন তার কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সরব হলেও এখনো মুখ খোলেনি ভারত। 

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এশিয়ায় ফের স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তন হলে এর প্রভাবকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে চীনকে। তাই নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখা ও আঞ্চলিক রাজনীতিতে আমেরিকাকে ঠেকানোর প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে দেশটি। এই সমরাস্ত্র প্রদর্শন তারই অংশ হতে পারে।

চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) নতুন এক বাহিনী গঠন করেছে। যার নাম দেয়া হয়েছে ‘রকেট ফোর্স’। আধুনিক সকল প্রযুক্তি বিষয়ে অভিজ্ঞ ও সবচেয়ে চৌকস সেনাদের রাখা হয়েছে এ বাহিনীতে। এ বাহিনীতে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র। যে কোনও পরিস্থিতি মোকাবেলায় সক্ষম করে গড়া হয়েছে বাহিনীটিকে। রকেট ফোর্সকে সাজানো হয়েছে হাল্কা, মাঝারি ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মাঝারি আকারের ক্ষেপণাস্ত্র ডংফে-১৬। ছোট বা বড় যে কোনো যুদ্ধে বিজয়ী হতে হলে মাঝারি আকারের ক্ষেপণাস্ত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের কৌশলের ওপর নির্ভর করে যুদ্ধে জয়ের।

চীনের হাতে দীর্ঘ পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র অনেক দিন ধরেই রয়েছে। স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রও রয়েছে। কিন্তু মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল সমরাস্ত্র ভাণ্ডারে তেমন ছিল না। কৌশলগত ভাবে মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই বেশ কয়েক বছর ধরেই দেশটি মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে জোর দিচ্ছিল। এক হাজার কিলোমিটার দূরে আঘাত হানতে সক্ষম ডংফেং-১৬ সেই গোত্রেরই ক্ষেপণাস্ত্র। অনেকগুলি ডংফেং-১৬ নিয়ে মহড়া দেয়ার ভিডিও প্রকাশ করে চীন সবাইকে বুঝিয়ে দিতে চায় যুদ্ধে জড়ালে তাকে হারানো অসম্ভব। এক হাজার কিলোমিটার পাল্লার ডংফেং-১৬ মিসাইলকে চীনের যেকোনো অঞ্চল থেকে নিক্ষেপ করা সম্ভব। ভারত, জাপান, রাশিয়া এবং আমেরিকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল মিসাইলের রেঞ্জের মধ্যে রয়েছে।

চীনের এ সমরাস্ত্র প্রস্তুতি ভাবিয়ে তুলেছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতকে। কাশ্মির ও অরুণাচলের সীমান্ত নিয়ে এখনো ভারতের বিরোধ চলছে চীনের সঙ্গে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় গিয়ে বিশ্বের শীর্ষ ক্ষমতাধর অনেক রাষ্ট্রকে বাদ দিয়েই ফোন করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদীকে। দক্ষিণ চীন-সাগর দখলে নেয়ার ঘোষণা দেন। সাগর দখল ও মোদীকে ফোন দেয়ার কোনোটিকেও হেলা ফেলা হিসেবে দেখছে না চীন। ট্রাম্পের ঘোষণার পরেই চীন হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, দক্ষিণ-সাগর চীনের অংশ। এখানে কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়া হবে না। ট্রাম্প নাক গলালে আমেরিকা-জাপান বিরোধে জাপানকে সমর্থন দিবে চীন।

চীনের এ পূর্বাভাসকে চাপে পড়ার কারণ হিসেবে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ইতিহাস বলছে অস্ত্র ভাণ্ডারের তথ্য প্রকাশ নিয়ে অত্যন্ত রক্ষণশীল চীন। নিজেদের অস্ত্রাগারে ঠিক কী কী অস্ত্র রয়েছে, কোন অস্ত্রের সক্ষমতা কী রকম, তার বিস্তারিত তথ্য গোপন রেখেই আসছিল। এমনকি চীন তার সেনাদের মহড়ার স্থান পর্যন্ত প্রকাশ করে না। এখন সমরাস্ত্র বাহিনী রকেট ফোর্সের সদস্যদের প্রশিক্ষণ পদ্ধতি, জায়গা, কীভাবে সব ধরণের ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ছে তার ভিডিও প্রকাশ করে রীতিমত ভড়কে দিয়েছে কয়েকটি দেশকে। সকল সমরাস্ত্র ব্যবহার ও ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ ছাড়াও রয়েছে এ বাহিনীর বিশেষ যোগ্যতা।

চীনের সরকারি সংবাদপত্র, চায়না ডেইলি রকেট ফোর্স নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন লিখেছে। তাতে লেখা হয়েছে রকেট ফোর্স শুধু ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ার মহড়াই দেয়নি, আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কৌশল প্রয়োগ করে দেখিয়েছে। ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ার পর রাসায়নিক এবং জৈবিক দূষণ হয়। খুব দ্রুত তার প্রভাব কমিয়ে আনতে নিজেদের দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে তারা। স্যাটেলাইট ও রাডারের চোখ ফাঁকি দেয়া, প্রতিপক্ষের ইলেকট্রনিক জ্যামিংকে অকেজো করে দেয়ার পরীক্ষাতেও রকেট ফোর্সের বিভিন্ন বিভাগ সফল হয়েছে।

এই মহড়া ও প্রদর্শনী চীন-ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কে ভিন্ন মাত্রা আনার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। কূটনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি করবে স্নায়ুচাপ। এর প্রভাব গিয়ে পড়বে দুই দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে। এ উত্তেজনার প্রভাব থেকে রেহাই পাবে না এশিয়ার অন্য দেশগুলো। আঞ্চলিক জোটগুলোর মধ্যে দ্বি-পাক্ষিক ও বহু-পাক্ষিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। নতুন কোনো চুক্তি বা জোট গঠনে এদিকটি সামনে রাখতে হবে।

অপরদিকে, রাশিয়া সীমান্তেও ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছে চীন। অবশ্য রাশিয়া বলেছে, সে ক্ষেপণাস্ত্র আমেরিকার দিকে তাক করা রয়েছে। ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে পরাশক্তিগুলোর প্রভাব কেমন পড়বে বাংলাদেশকে তা ভাবতে হবে। ভারত মহাসাগরের কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। কৌশলী অবস্থানের কারণে ঢাকার গুরুত্ব রয়েছে ওয়াশিংটন, দিল্লি ও বেইজিংয়ের কাছে। ভারত ও চীনের অনেক বড় বাজার হচ্ছে বাংলাদেশ। ইলেকট্রনিক পণ্যের অধিকংশই চীননির্ভর। দেশে চীনের বিনিয়োগও রয়েছে। দেশটিতে শ্রম মূল্য বেড়ে যাওয়ায় চীনের পোশাক শিল্পের বড় বড় বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে ব্যবসা করার কথা ভাবছেন।

চীনের অর্থনীতি মূলত সমুদ্র নির্ভর। দেশটির নীতি হলো অর্থনৈতিক শক্তি দিয়ে শত্রুকে পরাস্ত করা। ইতোমধ্যে মিয়ানমারসহ বেশ কয়েকটি দেশে তাদের এ কৌশল বেশ কাজে দিয়েছে। অর্থনীতি, সমরাস্ত্র, কূটনীতি ও রাজনৈতিক নেতৃত্বে ভারতের চেয়ে অধিক শক্তিশালী দেশ হচ্ছে চীন। সেক্ষেত্রে চীন-ভারতের স্নায়ু যুদ্ধে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে কোন পথে হাঁটবে বাংলাদেশ তা ভাবার সময় হয়েছে। কৌশল নির্ধারণে ঠিক কোন বিষয়টি সামনে আনতে হবে তা ভাবতে হবে এদেশের রাজনীতিবিদদেরও।

সোনালীনিউজ/তালেব/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!