• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
সাদ্দাম সাচীর ছোট গল্প

ছেলেটি স্যাবোটেজ ছিল...


সাদ্দাম সাচী এপ্রিল ২০, ২০১৭, ০৫:৪৬ পিএম
ছেলেটি স্যাবোটেজ ছিল...

দূর থেকে ইস্টিশনের আলো দেখা যাচ্ছে, এই আলো বস্তি পর্যন্ত আসে না, বস্তিতে এখন বিদ্যুৎ নেই, কিছুক্ষন আগে চলে গিয়েছে । বস্তির কিছু ঘর অন্ধকার আর কিছু ঘরে নিভু নিভু বাতি জ্বলছে, চারিদিক থেকে বিচিত্র ধরনের আওয়াজ আসছে; বাচ্চার কান্না, উচ্চস্বরে বেসুরা গান, ছেলে মেয়েদের পড়ার শব্দ, বৃদ্ধ মহিলার অভাবকে গালি দেয়া, মাতালদের আওরানি, কুকুরের ডাক এবং বস্তির মাঝখানের ঘর থেকে উচ্চস্বরে একটি নারীর গালাগালির শব্দ শোনা যাচ্ছে। এই ঘর পিন্টুদের। ঘরের ভিতর খুব বেশি জিনিসপত্র নেই। দুইটা চৌকি, ঘরের মাঝখানে কাপড়ের পর্দা দেওয়া, পর্দার ঐ-পাশে পিন্টু থাকে আর এ-পাশে পিন্টুর মা বাবা এবং ছোট বোন থাকে। ছোট বোন ইস্কুলে যায়, বাবা রিক্সা চালায়, মা মেসে রান্না করে। ঘরের ভিতর এখন পর্দাটা একপাশে কুঁচকানো, কারণ পাশের চকিতে পিন্টু শুয়ে আছে, এ-পাশের চৌকিতে ছোট বোন বই নিয়ে বসে আছে, বাবা চৌকির এক পাশে শুয়ে সিগারেট টানছে, যেন পৃথিবীর সমস্ত সুখ ওনার কাছে, সারা ঘর ধোঁয়ায় কুয়াশার মত হয়ে গেছে, বাতির আলো সারা ঘর জুড়ে পৌছায়নি, সারা ঘর জুড়ে আবছা আলো আবছা অন্ধকার। সবাই সবার মত করে আছে, কিন্তুু পিন্টুর মা কোন ভাবেই থামছে না, বিশেষ করে পিন্টুর বাবার সাথে ঝগড়াটা লেগেছে। প্রতিদিন একই সময়ে একই বিষয়ে তাদের ঝগড়া হয়, পিন্টু প্রথম প্রথম তার মাকে ধমক দিত যেন ঝগড়াটা না করে, বাবাকে সে কিছুই বলত না, কারন ঝগড়া চলাকালীন তার বাবা খুব একটা কথা বলে না। তার বাবার কথায় যুক্তি থাকে। আর তার মায়ের ঝগড়া লাগাটা যে দিন শেষে একটা রাগ থেকে হয় সে তা বোঝে। কিন্তুু কিছুই করার নেই অভাব থেকে কোন ভাবেই উঠা যাচ্ছে না, অনেক পথের সন্ধান করছে পিন্টু যে কোন ভাবেই হোক অভাব থেকে উঠতেই হবে। কিন্তুু কোন পথ পিন্টু পাচ্ছে না যে পথে দ্রুত অভাব মোচন করা যায়। সন্ধ্যার পরে যখন সবাই ঘরে ফিরে তার আরও কিছুক্ষণ পরে পিন্টুর মা ঘরে আসে। এসেই দেখে পিন্টুর বাবা চৌকিতে শুয়ে শুয়ে সিগারেট টানে, তখনিই তার মাথা গরম হয়ে যায়। সেই ভোর বেলা গিয়ে মেসে রান্না করে, ঐখান থেকে এসে নিজের রান্না করে আবার গিয়ে দুপুরের রান্না করে, কিছু সময় পায় সংসারের কাজ করে এবং পরে আবার গিয়ে রাতের রান্না করে । গত কয়েকটা বছর ধরে সারাটাদিন যাচ্ছে এভাবে, তাও মাস শেষে ঠিক মত টাকা পাওয়া যায় না, কি আর করা এই বয়সে এই কাজ ছাড়া অন্য কাজ সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যাবে । তাই দিনশেষে যদি দেখে স্বামী এভাবে শুয়ে শুয়ে সিগারেট টানে তখন রাগ হবেই। তবে পূর্বের তুলনায় ইদানীং ঝগড়ার তাপটা কম, কারণ রাগ শুধু পিন্টুর বাবার দিকে, আগে পিন্টুর দিকেও ছিল। এখন ঝগড়ার তাপমাত্রা অর্ধেকে নেমে এসেছে, পূর্বে সম্পূর্ণ ছিল।

পিন্টু সারাদিন স্টেশনে বন্ধুদের সাথে পড়ে থাকতও কোন কাজ করত না; সন্ধ্যার পর গাঁজা, ডান্ডি গাম, মাঝে সাঝে ইয়াবা এসব টেনে বাসায় যেত। আর মায়ের কাছে টাকা চাইত, না দিলে মারধর করে না হলে চুরি করে নিত। এই নিয়ে পিন্টুর মায়ের বিলাপে সারা বস্তির লোক জড়ো হয়ে যেত। কেউ তাকে কোন ভরসা দেয়নি, সবাই তার কান্নার দশর্ক ছিল। এমনকি তার স্বামীও তাকে কোন সান্ত্বনা দেয়নি, এখনও যেমন আগেও তাই ছিল। তিনদিন রিক্সা চালালে চারদিন ঘরে শুয়ে থাকতও আর পারার মোড়ের দোকানে গিয়ে কেরাম খেলতও বাজি ধরে । জুয়ায় হারার পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে বউয়ের কাছে গিয়ে টাকা চাইত, না দিলে মারধর করে নিয়ে আসতও। আবার বিলাপ শুরু করত পিন্টুর মা । তখনও সবাই দশর্ক। দিন শেষে পিন্টুর বাবার সব টাকা শেষ হয়ে গেলেও কাজে যেত না, ঘরে গিয়ে শুয়ে শুয়ে সিগারেট টানতো আর এসব দেখে পিন্টুর মা ঝগড়া শুরু করত। তখনও পিন্টু পাশের চৌকিতে শুয়ে থাকতও, কিন্তু সে ঘুমাতো, তার আশপাশে কি হচ্ছে সে কিছুই জানতো না, তার ভিতর নেশারা খেলা করত।

কিন্তুু এখন পিন্টুর অনেক পরিবর্তন হয়েছে, তবে নেশাটা রয়ে গেছে । ইদানীং দিন শেষে তার মায়ের হাতে টাকা তুলে দেয়, সারাদিন ইস্টিশনে খালি বোতল কুড়িয়ে বিক্রি করে । যদিও বোতল বিক্রি তার তেমন পোষায় না, তবে বর্তমান পরিস্থিতি তার জন্য খুব লাভজনক হয়েছে । সে এই কাজ করত না, করতে চায়নি, কিন্তুু তার মায়ের প্রতি এখন মায়া হয়, একা একা আর কত কাজ করবে, বাবার উপার্জন সে নিজেই শেষ করে ফেলে। মায়ের প্রতি তার অবিচার হচ্ছে, নিজের হীনমন্য বোধ জাগরিত হয়েছে। আর কত অভাবের ভিতর থাকা যায়! নিজের জন্য বা সংসারের জন্য এভার কিছু করা প্রয়োজন, যে কোন কাজ হোক, যে কাজে অধিক টাকা কামানো যায়, তাতে রাষ্ট্র ধ্বংশ হয়ে যাক, হলে পিন্টুর কি? পিন্টুর রাষ্ট্র চিন্তার প্রয়োজন নেই, পিন্টুর প্রয়োজন ভাত আর নেশার।

পিন্টুর মায়ের ঝগড়া এখনও থামেনি, সে একের পর এক কথা বলেই যাচ্ছে আর ঘরের এটা সেটা গোছাচ্ছে। পিন্টুর বাবা চুপ করে আছে, তার এমন ভাব সে কিছু বলবে। পিন্টুর মা তার স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলে- তুমি গত সাতদিন ধইরা কাজে যাওনা, এভাবে রশির মত ঘরে পইরা থাহ, এই রোম করলে সংসার চলবো ক্যামনে । পিন্টুর বাবা হঠাৎ রেগে বলে- তুই দেহস না মাগী শহরের কি অবস্থা, রাস্তাত বের হইলেই দেহি দল বাইন্ধা মানুষ হাতে অস্ত্র নিয়া ঘুরাঘারি করে, মারামারি লাগে, গাড়ি ভাঙ্গে, এদিক সেদিক খালি বোমের শব্দ। পিন্টুর মা বলে; শহরের এই অবস্থা তো অনেকদিন যাবত, তাই বইল্লা কি কাজে যাওন যাইব না!  পিন্টুর বাবা বলে- যাওন যাইত অন্য কাজ করলে, আমি চালাই রিশকা আমার তো রাস্তাতই থাকোন লাগে, কখন একটা বোম পইরা যা মাথাত কওন যা?  পিন্টুর মা বলে- আর মানুষ এই কাজ করে না, সবাই তোমার মত ঘরে পইরা থাকলে ওদের পেট কে চালাইবো?  সবাই কাজে আছে শুধু তোমার কাছেই বাহানা । পিন্টুর বাবা বলে-  দেখ যাইয়া মাগী হাসপাতালে কেমন মানুষ পুড়ার গন্ধ বাইরাইতাছে, সব শালারা কাজে গেছিল এহন পুইরা ছাই হইছে, খুব পেট চলানির কাম হইছে!

পিন্টুর মা চুপ করে আছে, পিন্টুর বাবা বিরবির করে কাকে যেন গালি দিচ্ছে, পিন্টু কুচকানো পর্দা প্রসারিত করে চৌকিতে শুয়ে পরেছে । আবার পিন্টুর বাবা রেগে বলে; সব শালারা ঘুটিবাজ, দেশটারে নিজের বাপের সম্পত্তি পাইছে, যা ইচ্ছা তাই করতাছে, আমরা যেন এই দেশের গরু ছাগল কোন দাম নাই আমাগর,,,শালারা মাদারচোদ তদের ইচ্ছা মত হরতাল অবরোধ দিবি আর এদিকে আমরা না খাইয়া থাকমু,,,,,,,,। পিন্টুর বাবা গালাগালি করছে, এদিকে পিন্টু পাশ ঘুরিয়ে শুয়ে আছে, তার বাবার কথা কানে নিচ্ছে না, তার কানে আসছে অন্য কিছুর শব্দ। পিন্টু যে জায়গায় শিথান দেয় তার পিছনেই নিলাদের টয়লেট, নিলা টয়লেটে আসছে, তার পস্রাব করার শব্দ পিন্টু খুব কামুক মনে উপভোগ করছে আর শিশ্নে হাত দিয়ে খুব জোরে চেপে ধরে রেখেছে। সে খুব শান্তি পাচ্ছে, শরীর গরম হয়ে গেছে, শব্দের প্রতিধ্বনি তাকে খুব সুখ দিচ্ছে । নিলার প্রস্রাবের শব্দ শেষ, কমডে পানি ঢালার শব্দ আসছে, পিন্টুর মনে উষ্ণ ভাব, শিশ্নে ধরে রাখা হাতটা ছেড়ে দেয়, সারা শরীর বিছানায় ছেড়ে দু'হাত পা দু'দিকে দিয়ে শিনা ফুলিয়ে একটা তৃপ্তির নিশ্বাস নেয়। দু'চোখ বন্ধ করে দেয়, তার চোখে ভেসে উঠে নিলার ছবি, সে নিলাকে নিয়ে ভাবতে থাকে।

পিন্টু আর নিলা এই বস্তিতেই বেড়ে উঠেছে । ইস্টিশনের প্রতিটি জায়গা আর বস্তির আশপাশের প্রতিটা এলাকায় তারা দু'জন চষে বেড়াত। নিলার উষ্ক চুল, শরীরে ছেরা জামা, তেলহীন ত্বক, হেসে দিলে লালচে দাঁত ঝিলিক দিয়ে উঠতো । পিন্টুর শরীরিয় অবস্থা আরও খারাপ ছিল, সে পনের থেকে বিশদিন পর পর গোসল দিত, এক জামা পরেই সবসমই থাকতো। শরীর থেকে গন্ধ বের হত। চুল, শরীরের ত্বক খসখসে থাকতো । তারা দু'জন এই অবস্থায় ঘুরে বেড়াত, রেললাইনের দুই পাশে হাত ধরে হাঁটত, বৃ্ষ্টিতে ভিজত দুজন, ময়লা পানির ডোবায় সাঁতার কাটতো, রেললাইনের পাশে বসে হাগু করত, ট্রেইনের ভিতর লোকজনের কাছে টাকা চাইত, ফলের দোকানের সামনে থেকে নষ্ট ফল কুরিয়ে খেত, ইস্টিশনের যাত্রীদের অর্ধেক খাবারের অপেক্ষায় থাকতো দূরে দাড়িঁয়ে, দুজনে মিলে সেটা খেত, ইস্টিশনের এ-পাশ থেকে ঐ-পাশ পর্যন্ত তারা দৌড়াদৌড়ি করত, আর ইস্টিশনের পুলিশ তাদেরকে লাঠি দিয়ে দৌড়ানি দিত। সন্ধ্যায় এক সাথে ঘরে ফিরতো।

যখন থেকে নিলা বড় হতে থাকে তাকে আর বস্তির কারও সাথে তেমন ভাবে মিশতে দেয় না তার মামা।  সবসময় একটা পাহারার মাঝে থাকে । পিন্টু দূর থেকে নিলাকে দেখে, তার কাছে যেতে পারে না, যদিও একই বস্তিতে থাকে,  তবে পিন্টুর কাছে অন্য ব্যাপার মনে হয়, শুধু বস্তিতে এত পর্দা বাহিরে যখন বের হয় তখন নিলা আর নিলা থাকে না, নিলা হয়ে যায় ফুলপরী । তখন তার সাথে অচেনা লোক থাকে, একেকদিন একেকজন। নিলাকে নিয়ে পিন্টু অনেকের কাছে অনেক কিছুই শুনেছে তাতে পিন্টু বিশ্বাস করেনা, কারণ তার এসব কথা শোনতে খারাপ লাগে। কেন খারাপ লাগে তা পিন্টু জানেনা,  তবে পূর্বের নিলার সাথে বর্তমান নিলার আকাশ পাতাল ব্যাবধান তা সে বোঝতে পেরেছে । সেটা শরীরের দিক দিয়ে এবং পোশাকে । নিলা এখন জিন্স পেন্টের সাথে চকচকে শার্ট পরে। দামি মেকাপ ব্যাবহার করে, তবে গায়ের রঙ অনেক সুন্দর হয়েছে, হাসি দিলে আর দাঁতের লালচে দেখা যায় না, এখন চকচক করে, শরীরে মাংস হয়েছে, হাঁটলে চর্বি নড়ে, এই দৈহিক গঠনের সাথে চকচকে দামি কাপড় তাকে খুব মানিয়েছে।

নিলার এত পরিবর্তন, কিন্তুু পিন্টুর কোন পরিবর্তন নেই। সেই আগের খসখসে শরীর আর ময়লা পোশাকই রয়ে গেছে। নিলার সামনে পিন্টু যায় না, কারণ নিলার সামনে তাকে মানায় না, কথা বলা আরও দূরের ব্যাপার। তবে পিন্টু একদিন নিলার কাছে যাবে, তার সাথে কথা বলবে, তার ভিতর জমানো সমস্ত কথা একদিন বলতেই হবে।

সকাল বেলায় পিন্টুর ঘুম ভাঙ্গে । দশটা বাজে এখনো পিন্টুর চোখে ঘুমে টানে, বিছানায় আরও শুয়ে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে । ঘরে কেউ নেই সবাই সবার কাজে চলে গিয়েছে। পিন্টু চিৎ হয়ে শুয়ে আছে, কাল ঘুমে আবার চোখে নিদ্রা এসে গেছে। কিছুক্ষন পর বাহির থেকে পিন্টুকে একজন ডাকছে,  সে শুনে না। আবার সে লোক ডাকছে, শোনে না। দরজায় হাত দিয়ে জোরে চাপরাচ্ছে সে লোক। হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে পিন্টু। ঘরের চারদিকে এপাশ ওপাশ দেখে আর চোখ হাত দিয়ে কচলাতে কচলাতে বলে, কে ? দরজার ঐপাশ থেকে বলে- এখহনও হুইত্তা আছচ পিন্টু, ভাই সকালতে ফোন দিতাছে, তাতারি আয়।

পিন্টু ঘর থেকে বের হয়ে যায়। বাহিরে গিয়ে নিলাদের ঘরের দিকে তাকায়, কোন শব্দ নেই, একটু এগিয়ে গিয়ে দেখে ঘরে তালা দেওয়া। পিন্টু প্রায়ই এভাবে উকি দিয়ে দেখে না, আজ তার ইচ্ছে হয়েছে একটু নিলাকে দেখার জন্য। কিন্তুু দেখতে পারেনি, তার মন খারাপ হয়েছে। পাশের লোকটা তাকে জলদি যাওয়ার জন্য তাগিদ দিচ্ছে। পিন্টু রেগে ওকে গালি দিচ্ছে,  মুখ দিয়ে যা আসছে তাই বলছে, লোকটা বোকার মত তাকিয়ে আছে। লোকটাও হঠাৎ রেগে বলছে, আমারে গালি দেস ক্যান, তর আরও সকালেই কাজে বের হয়ে যাওয়ার কথা ছিল, না আসাতে আমারে পাঠাইছে, যা বলার ওদেরকে বল। পিন্টু বলে- তদের কাজ আর করলাম না, যা ভাইয়েরে যাইয়্যা বল, আমি যামু না ।

সেই লোক বলে- দেখ পিন্টু মাথা গরম করিস না, ভাইয়ের কাছে তর একটা সুনাম আছে, তর সাহসে ভাই খুব প্রশংসা করে আর ইদানীং যে টাকা পাইছচ সারা বছর খালি বোতল বেইচ্চা তা কামাইতে পারবি? 

পিন্টুর রাগ একটু থেমে গেছে। যে কারনে রাগ হয়েছিল সে কারণের জন্যই টাকার প্রয়োজন। পিন্টুর প্রচুর টাকার প্রয়োজন, সে ভাবে অনেক টাকা হলেই একদিন তার অভাব মোচন হবে আর নিলার কাছে সিনা টান করে তার না বলা কথাগুলি বলতে পারবে, তখন নিলা তার কথা রাখবে, কারণ নিলা টাকা ওয়ালা লোকদের পছন্দ করে। তাই খুব বেশি রাগ করা যাবে না, তাহলে ভাইয়েরা রাগ করবে। পিন্টু এখন ভাইয়ের কথায় চলে। ভাই ভাল টাকা দেয় পিন্টুকে, কারন পিন্টু সামনের সারিতে গিয়ে বোম মারতে পারে, খুব সাহস নিয়ে অজস্র মানুষের ভীড়ে পেট্রোল বোমা মারতে পারে, কাছে গিয়ে চলন্ত গাড়িতে বোমা মারতে পারে, পুলিশ তাকে দৌড়িয়ে ধরতে পারে না। শহরের সব অলি গলি সে চিনে। তাই পিন্টুর কদর ভাল, সে টাকা পায় বেশি, কিন্তুু খুব একটা আয় হয় না, নেশাই অনেক চলে যায়।

পিন্টু আর সে লোক রাস্তার মোড়ের দোকানে এসে বসেছে, পিন্টু নাস্তা করবে। সে লোকের মুখে বিরক্তি দেরী হয়ে যাচ্ছে বলে। পিন্টু দুধ চা'য়ে ব্রেড ভিজিয়ে খাচ্ছে আর ইস্টিশনের দিকে তাকিয়ে আছে। ইস্টিশন ফাঁকা। খুব একটা লোকজন নেই, দু'একটা হকার ছাড়া। পিন্টু বিষন্ন মনে গভীর ভাবে তাকিয়ে আছে, আজ তার ভিতরটাও ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।

পিন্টু সিগারেট জ্বালিয়ে বড় রাস্তার দিকে হাঁটতে শুরু করল, হঠাৎ থেমে যায়। মুখ থেকে সিগারেট নামিয়ে ত্নীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একটু দূরে নিলাকে দেখছে। নিলা একটি দামি গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে সাথে ভদ্র ধরনের ফর্সা মাথায় চুল নেই চশমাওয়ালা একটি লোক। তারা হাসি তামাসায় মগ্ন। টাকলা লোকটা নিলার খুব কাছাকাছি এসে কথা বলছে নিলাও তাতে খুব আনন্দ পাচ্ছে। পিন্টু সিগারেটে লম্বা টান দিচ্ছে আর সিগারেটের আগুন হুঙ্কার দিয়ে লাল হয়ে যাচ্ছে । পিন্টু এসব দেখে বড় রাস্তা দিয়ে খুব জোরে হাঁটছে, তার পিছনের লোকটা তার সাথে হেঁটে পারছে না, দৌড়াচ্ছে। সে লোক বলে- পিন্টু আস্তে যা, ব্যাগ নিয়ে দৌড়ানো যাচ্ছে না। 

পিন্টুর কলিজায় সিগারেটের আগুনের ফুলকিটা পরে গেছে, পৃথিবীতে আর কিছুই ভাবতে পারছে না। তার চোখের সামনে সে দৃশ্য আর টাকলো লোকটার ছবি ভাসছে। নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে।  পিন্টু নিলাকে সারাজীবনের জন্য চায়। আজ কেন নিলা পিন্টুর কাছ থেকে দূরে ? সেই ছোট বেলার নিলার মাঝে আজ কেন এত পরিবর্তন হল ? পিন্টু এসব প্রশ্ন নিজেকে করছে আর রাগ হচ্ছে ঐসব টাকলো লোকদের উপর। এরা আজ টাকার গরম নিলাদের উপর ঢালছে, একদিন এই টাকার জোরেই রাজনীতিতে আসবে, তখন এই পিন্টুদের ভাই হবে ।

পিন্টু কিছুক্ষণ হাঁটার পর দৌড়াতে থাকে, তার মাথায় রক্ত উঠে গেছে, যা সহজে নিচে নামছে না। সাথের লোকটা তার পিছন পিছন দৌড়াচ্ছে আর তাকে ডাকছে। পিন্টু পিছন তাকাচ্ছে না, সে দেখছে দামি চাকচকে গাড়ি গুলি কোন দিক দিয়ে যাচ্ছে। মহাখালী রেল ক্রসিং এর এখানে এসে দাড়িঁয়েছে। ঘন ঘন নিশ্বাস নিচ্ছে, চারিদিকে দেখছে । সাথের লোকটা চারপাশ দেখে পিন্টুকে বলে- চল পিন্টু অন্যদিকে যাই, এখানের পরিবেশ বালা না, চারিদিকে অনেক পুলিশ, একেবারে তাক করে আছে। 

পিন্টু ওর কাছে বোম চায়, সে লোক ইতস্তত করে আর জোড়াজুরি করে এখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তুু পিন্টু কিছুতেই এসব শুনছে না। বাধ্য হয়ে সে লোক তার কাঁধ ব্যাগ থেকে দু'টা পেট্রোল বোমা দেয় আর সে এখান থেকে চলে যায় একটু দূরে। পিন্টু তার প্যান্টের পকেটে একটা বোমা রেখে দেয়। এক হাতে বোমা আরেক হাতে গ্যাসের টিপ-মেচ নিয়ে সে প্রস্তুুত হয়ে থাকে। চারদিক দেখছে, কোথায় দামি চকচকে গাড়ি আছে । হঠাৎ মোড়ের দিকে দৌড়ায় একটি প্রাডো গাড়ি দেখে, চলন্ত গাড়ির কাছে গিয়ে বোমটা ছুরে মারে, গাড়ির উপর বোমটা পরার সাথে সাথেই পিন্টুর মগজে একটি গরম অনুভুতি হয়। মনে হয় একটা আগুনের হল্কা যেন মাথায় ঢুকলো। এটুকুই। সে উল্টে পড়ে। পিলিশগুলো গুলি ছুড়তে ছুড়তে পিন্টুর কাটা মুরগির মত তড়পানো দেহের দিকে ছুটে আসে। চারিদিকে হই হুল্লোর, মানুষের ছুটাছুটি, আতঙ্কিত মানুষেরা যে যেখানে পাড়ছে আশ্রয় নিচ্ছে, বেশ কিছু গাড়ির জটা লেগে গিয়েছে।

দূর থেকে পিন্টুর সাথে থাকা লোকটা এসব দেখছে। পিন্টু চিৎ হয়ে রাস্তায় পরে আছে, তার সারা শরীরে রক্ত, সে রক্ত রাস্তা জুরে লেপ্টে গেছে, তার চারপাশে পুলিশ গোল হয়ে দাড়িঁয়ে আছে।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এমটিএল

Wordbridge School
Link copied!