• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নায়করাজ: ছেলেবেলায় বাস্তুভিটা হারান, কিন্তু স্বপ্ন হারাননি


বিনোদন প্রতিবেদক জানুয়ারি ২২, ২০১৭, ০৪:৫৫ পিএম
নায়করাজ: ছেলেবেলায় বাস্তুভিটা হারান, কিন্তু স্বপ্ন হারাননি

ঢাকা: গত দুই বছর যাবৎ শারীরিক অসুস্থতার জন্য শোনা যাচ্ছিল বাংলা চলচ্চিত্রে নিজের জৌলুসময় ক্যারিয়ারের ইতি টানছেন সত্তর দশকের বাংলা চলচ্চিত্রের এক নক্ষত্র খচিত অভিনেতা নায়করাজ রাজ্জাক। যদিও এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে এরমধ্যে হয়ে গেছে নানা কানাঘুষা। এমন কথা ওঠার পর সকলের মাঝে একটি প্রশ্নই উঁকি দিচ্ছিল, সত্যিই কি চলচ্চিত্র ছাড়ছেন নায়ক রাজ! বাংলা ছবিতে আর দেখা যাবে না ভরাট কণ্ঠের অধিকারী, পিতৃতুল্য এমনকি বাংলা চলচ্চিত্রের একচ্ছত্র অধিপতি নায়ক রাজরাজ্জাককে? কিন্তু সব প্রশ্ন ছাপিয়ে এখনও অভিনয়ের জীবনেই আছেন নায়ক!  

প্রবীন বয়সেও তিনি বাংলা চলচ্চিত্রকে আগলে রেখেছিলেন, কি অভিনয় দিয়ে, আর কি নির্মাণে! ষাটের দশক থেকে একেবারে পুরো আশির দশক বাংলা ছবির জগতকে নিজ হাতে দিয়েছেন, নায়োকচিত প্রভাব বিস্তার করেই পুরো তিনটা দশক পার করে দিয়েছেন তিনি। এরপর থেকে আজ অবধি এখনো বাংলা ছবিতে তার উপস্থিতি মানে বিশাল কিছু, হয়তো ছবির কৌশল আর ধারার জন্য নায়োকচিত ভাবটা দেখাতে পারেন না, সঙ্গত কারণেই বয়স এখানে একটা প্রধান বাধা; কিন্তু তারপরেও ছবিতে অভিনয় মানেই তিনি কেন্দ্রীয় চরিত্র! তার ভরাট কণ্ঠ আর অভিনয়ের প্রতাপ, প্রভাব বাংলা ছবিকে অন্যমাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। তাই বৃদ্ধ বয়সেও বাবার চরিত্রে স্বপ্রতিভ নায়ক রাজ! তাঁর কণ্ঠে ‘বাবা কেন চাকর’ ছবির সেইসব ইমোশনাল ডাইলগ যেমন মানুষের মনে গেথে রয়েছে, তেমনি তাঁর অভিনয় গাম্ভীর্যে দর্শক অনুরাগীরা চোখের জল ফেলেছে।      

ষাটের দশক থেকে অভিনয় জীবন শুরু করেছেন নায়ক রাজ্জাক। না, রাজসিক কোনো প্ল্যাটফর্মে শুরু হয়নি তার অভিনয় যাত্রা। নানা ঘাত প্রতিঘাত আর চড়াই উৎরাই আর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অভিনয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছিল তার। স্বপ্রতিভায় তিনি অভিনয়ের বিশাল ভুবনে জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনে আজ যে ‘নায়ক রাজরাজ্জাক’-কে আমরা এক নামে চিনি, তিনি জন্মেছিলেন দেশ ভাগেরও আগে, ১৯৪১ সালের ২৩ জানুয়ারি। আজকের এই বাংলাদেশে নয়, অখন্ড ভারত বর্ষে! বর্তমানে যাকে আমরা পশ্চিম বঙ্গ বলে থাকি। 

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্বের ভিত্তিতে ভারত বর্ষ ভেঙ্গে টুকরো হলে ভারতের প্রচুর মুসলমান তৎকালনি পূর্ব পাকিস্তানে আর পূর্ব পাকিস্তানের অসংখ্য হিন্দু পরিবার ভারতে আশ্রয় নেয়। কিন্তু নায়ক রাজ্জাকের পরিবার মুসলমান হলেও নিজের বাস্তুভিটা ছেড়ে শুধু ধর্মীয় বিভেদের কারণে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসেনি। তারা সেখানেই বাস করতে থাকে। ওটাই তাদের জন্মস্থান। এইসব দাঙ্গা, জাতি বিদ্বেষের মধ্যে লালন পালন হতে থাকেন আব্দুর রাজ্জাক নামের বিস্ময়াভূত কিশোর। ধীরে ধীরে বয়স হতে থাকে তার। সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম, দর্শন সবই বুঝতে শুরু করেন। একদিন সপ্তম শ্রেনিতে অধ্যয়নকালে অভিনয়ের সুযোগ তৈরি হয় তার। 

উঁচু, লম্বা এবং দেখতে খুব সুন্দর ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক নামের সেই সরল বালক। যাকে দেখেই স্কুলের পক্ষ থেকে মঞ্চ নাটকে অভিনয় করার প্রস্তাব দেন তারই খুব প্রিয় একজন স্যার। মনের ভেতর ভয় নিয়েই নাটকটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করতে রাজি হয়ে যান তিনি। আজকের নায়ক রাজরাজ্জাকের এই দীর্ঘ ক্যারিয়ার জীবনে ওই স্কুলের ছোট্ট নাটকটিতে অভিনয় করার প্রভাবকেও অস্বীকার করা যায় না। এরপর থেকে অভিনয় জগত সম্পর্কে নেশা জাগে তার। কলকাতার থিয়েটারে থিয়েটারে ঘুরেন, নাটকে অভিনয়ও করেন। কিন্তু ততদিনে তার মাথায় ঢুকে গেছে ‘সিনেমার ভূত’! সেসময় ‘রতন লাল বাঙ্গালি’ নামের একটি ছবিতেও প্রথমবার অভিনয় করেন আব্দুর রাজ্জাক। কিন্তু তার চোখে আরো বড় স্বপ্ন খেলা করে। 

ফিল্মস্টার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে কলেজের গন্ডি পাড় হয়ে ষাটের শুরুতে কলকাতা থেকে মুম্বাই যান শুধুই ফিল্মের উপর পড়াশুনা করতে। মুম্বাই থেকে ফিরে কলকাতায় আসেন তিনি, কিন্তু স্বপ্ন যেন অধরায় থেকে যায়। সেসময় অবশ্য আরো দুটি ছবিতে অভিনয় করেন রাজ্জাক। এরমধ্যে একটির নাম ‘শিলালিপি’।  ১৯৬৪ সালে ফের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়। ১৯৪৭ সালে নিজের ভিটে মাটি আঁকড়ে ধরে থাকলেও পিতৃমাতৃহীন আব্দুর রাজ্জাককে এবার চলে আসতে হয় পূর্ব-বঙ্গে। রাজনৈতিক আর ধর্মীয় দাঙ্গায় পড়ে হয়তো নিজের জন্মস্থান ছেড়ে আসেন, কিন্তু নিজের ভেতর লালিত স্বপ্নটাকে ছেড়ে আসেননি নায়ক রাজ। 

ফলে দেখা যায় ঢাকায় এসে তিনি ঠিকই খুঁজে বের করেন চলচ্চিত্র মনা মানুষদের, থিয়েটারের মানুষদের। কিন্তু দেশান্তরিত একজন মানুষের জন্য এমন সুযোগ কে তৈরি করে দিবে, ফলে তিনি বুঝতে পারেন ‘ফিল্মস্টার’ হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবিক পক্ষে খুবই কষ্টসাধ্য। তবে মানুষিকভাবে ‘ফিল্মস্টার’ হওয়ার স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দেন না তিনি। ধৈর্য ধরে থাকেন, নিজের একাগ্রতা আর বাসনাকে ধরে পড়ে থাকেন। এরইমধ্যে পাকিস্তান টেলিভিশনে একটি ধারাবাহিকে কাজ পান রাজ্জাক। 

‘ঘোরাও’ নামের এই সিরিজে অভিনয় করে নিজের সামর্থটা দেখাতে পারেন একজন দেশান্তরিত মানুষ। যদিও এসবে তার মোটেও তৃপ্তি নেই। তার চোখ শুধু ‘ফিল্মস্টার’ হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। একদিন পরিচয় হয় সেসময়ের নির্মাতা আব্দুল জব্বার খানের সাথে। এমন প্রতিভাবান এক তরুণকে ‘ফিল্ম’-এ কাজ করতে দেখে তিনিও হয়তো কিছুটা স্বস্তি পান। অতঃপর অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে পশ্চিম বাংলা থেকে আসা আব্দুর রাজ্জাকের একটা ঠিকুঁজি হয়। আব্দুল জব্বার খানের রেফারেন্সে কামাল আহমেদের ছবি ‘উজালা’-তে অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে ছবির জগতে ঠাঁই করে নেন বর্তমান সময়ের বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম পুরুষ নায়ক রাজরাজ্জাক। 

এরপর ধীরে ধীরে বাংলা ছবির জগতে নিজস্ব মেধা আর স্বনির্ভরতায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন অভিনেতা হিসেবে। দেশ স্বাধীনের আগে মহান নির্মাতা জহির রায়হানের সাথে হৃদ্যতা হয়। তার ‘বেহুলা’ নামের ছবিতে প্রথমবার নায়ক হিসেবে মানুষ দেখতে পায় এক সুদর্শন চেহারার রাজ্জাককে। এরপর জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতেও নিজের অভিনয় করেন নায়ক রাজ্জাক। ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে রাজ্জাকের পথ চলা শুরু হলেও  তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে দেশ স্বাধীনের পর, পুরো সত্তুর দশকজুড়ে রাজ্জাক তার অভিনয় দিয়ে বাংলা ছবির জগতকে আপন মনে ঋদ্ধ করতে থাকেন। 

নীল আকাশের নীচে, স্বরলিপি, মনের মত বউ, অশ্রু দিয়ে লেখা, অবুঝ বউয়ের মত কিংবদন্তিতুল্য ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। নিজ দক্ষতা আর অভিনয় ক্ষমতায় তিনি বাংলা চলচ্চিত্রকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিয়ে নেন। সত্তুর ও আশির দশকে শাবানা, ববিতা আর কবরির সাথে তার যে ক্যামিস্ট্রি বাংলা চলচ্চিত্র দেখেছে, তা আজ অবধি অক্ষুণ্ণ। রাজ্জাক-শাবানা, রাজ্জাক-ববিতা, রাজ্জাক-কবরি জুটিবদ্ধ সিনেমাগুলো আজো বাঙালি হৃদয়ে অম্লান। খ্যাতিমান এই অভিনেতার জন্মদিনে তাকে অকৃত্রিম শ্রদ্ধা। 

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এমটিএল  

Wordbridge School
Link copied!