• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রশ্নবিদ্ধ রাজনৈতিক আদর্শ, সরব প্রতিপক্ষ


বিশেষ প্রতিনিধি এপ্রিল ১৬, ২০১৭, ০৬:২৫ পিএম
প্রশ্নবিদ্ধ রাজনৈতিক আদর্শ, সরব প্রতিপক্ষ

ঢাকা: হেফাজতে ইসলামকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সমালোচনার মুখে আওয়ামী লীগ সরকার। গত মঙ্গলবার (১১ এপ্রিল) রাতে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে হেফাজতের প্রধানের নেতৃত্বে কওমি মাদরাসার আলেমদের এক সাক্ষাৎ অনুষ্ঠান এই সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। একই সঙ্গে উত্তপ্ত দেশের রাজনীতিও।

ওই অনুষ্ঠানে কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ সনদকে সাধারণ শিক্ষার স্নাতকোত্তর ডিগ্রির স্বীকৃতির ও আদালত প্রাঙ্গণ থেকে গ্রিক ভাস্কর্য অপসারণসহ বিভিন্ন দাবি পূরণে প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দেন। এমনকি পহেলা বৈশাখের সর্বজনীন উৎসবে নানা বিধি-নিষেধ আরোপ করে এবং দলীয় শোভাযাত্রা বাতিল করে আওয়ামী লীগ। ওই অনুষ্ঠানে মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিল হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফী। এমনকি সে অনুষ্ঠানে বেশ গুরুত্ব পান ‘তেতুল হুজুর’ খ্যাত হেফাজতের আমির।

হঠাৎ করেই সরকারের কাছে হেফাজতসহ ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর এমন দৃশ্যমান গুরুত্বে রাজনীতিতে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন ও উদ্বেগ। প্রশ্নের মুখে পড়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের চেতনাও। আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে হেফাজতের এমন সম্পর্ক কি শুধু ভোটের রাজনীতিতে সাময়িক কৌশলমাত্র, নাকি দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান- এ নিয়ে শঙ্কিত বিভিন্ন মহল।

দেশের বিশিষ্টজন ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, হেফাজতের মতো একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠনের রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পর্যায়ে এমন গুরুত্ব দেশের অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

এমনকি এ ঘটনা দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানের লক্ষণ ও এতে রাজনৈতিক শক্তির সমর্থন আছে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা। তারা এমনও অভিযোগ করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা মুখে বললেও সরকার হেফাজতসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করছে এবং সাধ্যমতো তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে।

বিশেষ করে সুপ্রিম কোর্ট চত্বরের ভাস্কর্য এবং কওমি মাদরাসা সনদের স্বীকৃতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যে গোটা দেশে চলছে তোলপাড়। প্রকাশ্যে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করছে বিভিন্ন মহল।

প্রতিবাদে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলছে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর নানা কর্মসূচি। আসছে বিবৃতি। হেফাজতের এসব দাবি মেনে নেওয়ার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ কট্টর ইসলামীদের সঙ্গে আপস করল বলেও বিভিন্ন মহল থেকে মন্তব্য আসছে। এতে জঙ্গিবাদী দর্শন আরো উৎসাহিত হবে বলেও দাবি করা হচ্ছে।

এ নিয়ে সরকারের ভেতর-বাইরেও নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে। দেখা দিয়েছে নানামুখী চাপ। পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে সরকার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী মহল। প্রকাশ্যে কেউ কিছু না বললেও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অনেকেই। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর এসব সিদ্ধান্তের প্রকাশ্য বিরোধীতা করেছে শরিক দল জাসদ।

তবে এ ক্ষেত্রে বেশ কৌশলী মনে হচ্ছে ক্ষমতার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিকে। পাছে হেফাজতের সঙ্গে মনোমালিন্য দেখা দেয়, তাই কড়া কোনো সমালোচনা বা প্রতিবাদ না করে হেফাজতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের এমন সম্পর্ককে ‘ভোটের রাজনীতি’ বলেই দায় এড়াতে চাইছে। অবশ্য বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের ইসলামি শরিক দলগুলো সরকারের এসব সিদ্ধান্তে ভেতরে ভেতরে সন্তুষ্ট। কারণ এই দলগুলোও হেফাজতের মতো পয়লা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে।

হঠাৎ করেই হেফাজতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের এমন সম্পর্কে বিস্মিত বিভিন্ন মহল। তাদের মতে, চার বছর আগে শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধিতা করেই মূলত উত্থান এই সাম্প্রদায়িক সংগঠনের। আহমদ শফী নেতৃত্বাধীন হেফাজত ২০১৩ সালে ‘নাস্তিক ব্লগারদের’ শাস্তির দাবিতে ঢাকায় মতিঝিলে সমাবেশ ডেকে ব্যাপক তা-ব চালিয়েছিল। পরে পুলিশি অভিযানে তাদের তুলে দেওয়া হয়েছিল। ওই সময় আহমদ শফীর একটি ওয়াজে নারীদের তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা করলে তাকে ‘তেঁতুল হুজুর’ নামে ডাকতে থাকেন অনেকে।

সে সময় হেফাজতের প্রতি বিএনপির সমর্থন ছিল প্রকাশ্য। আওয়ামী লীগ সরকারের শরিক জাতীয় পার্টিও সমর্থন দিয়েছিল। পরে ধীরে ধীরে সরকারের সঙ্গে হেফাজতের সে সম্পর্ক বদলাতে থাকে। সমঝোতা প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন হেফাজত আমীর আল্লামা আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানী। বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে হেফাজতের যোগাযোগ একেবারেই কমে যায়। প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের কড়া সমালোচনার মুখেও হেফাজতের একাধিক দাবি পূরণ করে সরকার। আর সম্প্রতি সে সম্পর্ক দৃশ্যমান হয়।

আওয়ামী লীগ অবশ্য হেফাজতের সঙ্গে এমন সম্পর্ককে ‘কৌশলগত’ বলে দাবি করেছে। দলের নীতিনির্ধারণী সূত্রগুলো বলছে, আগামী জাতীয় নির্বাচন লক্ষ্য করে হেফাজতে ইসলাম ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর ব্যাপারে এমন অবস্থান সাময়িক ও কৌশলগত সম্পর্ক। এ জন্যই তাদের দাবি পূরণে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তবে সরকারের এই কৌশলগত অবস্থান মেনে নিতে পারছে না আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের বেশির ভাগ শরিক দল।

দলের নেতারা মনে করেন, দাবি মেনে নিয়ে হেফাজতের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি সরকার ও আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা ও অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তাদের মতে, ধর্মীয় এই গোষ্ঠীর ভোট কখনোই আওয়ামী লীগের বাক্সে যাবে না। তবে শরিক দলের এমন মন্তব্য সঠিক নয় বলে মত আওয়ামী লীগ নেতাদের। তাদের মতে, জাতীয় নির্বাচন কিংবা যেকোনো সময় ধর্ম নিয়ে আওয়ামী লীগ বরাবরই অপপ্রচারের শিকার। তাই আদর্শ ঠিক রেখে সাময়িক কৌশলের আশ্রয় নেওয়া যেতেই পারে।

এ ব্যাপারে সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো চুক্তি কিংবা জোট হয়নি। তিনি কওমী মাদরাসার স্বীকৃতির ব্যাপারে সরকারের অবস্থান তুলে ধরেন। এমনকি গত শুক্রবার আহমদ শফীর দেওয়া এক বক্তব্যকে ‘জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়াটা লাভ নয় কি?’ বলেও মন্তব্য করেছেন।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/এইচএআর

Wordbridge School
Link copied!