• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
ঢুকছে ৪৮ সীমান্ত রুটে

বাড়ছে অবৈধ অস্ত্রের মজুদ


সোনালী বিশেষ জুলাই ২৩, ২০১৭, ০৮:৫১ পিএম
বাড়ছে অবৈধ অস্ত্রের মজুদ

ঢাকা : জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। নির্বাচনকে ঘিরে বাড়ে পেশিশক্তির প্রদর্শন। এই ‘শক্তি পরীক্ষার’ অন্যতম উপায় হচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র। নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় পাড়া-মহল্লায় ছোট-বড় ও পেশাদার অপরাধীদের হাতে হাতে থাকে অবৈধ অস্ত্র। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে প্রকাশ্যে চলে অস্ত্রের মহড়া। এ সময় প্রভাবশালীরা তাদের অনুগতদের জেল থেকে জামিনে বের করেন। হাতে তুলে দেন অবৈধ অস্ত্র। ক্ষমতায় যেতে শুরু হয় অস্ত্রের খেলা।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র এক বছর বাকি। তাই অস্ত্র ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসী গ্রুপের তৎপরতাও বাড়ছে। নির্বাচনকে ঘিরে দেশে অবৈধ অস্ত্রের চালান ঢুকছে। বাড়ছে অস্ত্রের মজুদ। শুধু সীমান্ত পথেই নয়, বৈধ অস্ত্রের আড়ালেও আনা হচ্ছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। এসবের মধ্যে ক্ষুদ্রাস্ত্রই বেশি। সীমান্ত এলাকাসহ রাজধানী ও এর আশপাশ এলাকায় ‘কঠোর’ নিরাপত্তার মধ্যে কিভাবে অস্ত্রের চালান আসছে, এর কোনো সদুত্তর নেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে।

গত এক বছরের ব্যবধানে রাজধানীর অদূরে রূপগঞ্জের পূর্বাচল সিটি ও উত্তরার দিয়াবাড়ির খালে পানির নীচ থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রের চালান উদ্ধারে পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অস্ত্র মজুদে নেপথ্যের গডফাদার ও ষড়যন্ত্রকারীদের সামান্যতম যোগসূত্রও বের করা সম্ভব হয়নি।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নিরাপত্তা ভেদ করে কিভাবে এত অস্ত্র দেশে ঢুকছে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কারণ সীমান্ত পেরিয়ে এভাবে অস্ত্রের চালান ঢুকতে থাকলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। এত অস্ত্র গোলাবারুদ কোথা থেকে, কিভাবে আসছে, এর সাথে কারা জড়িত, এসব প্রশ্নের কোনো কুলকিনারাও করতে পারছে না নিরাপত্তা সংশ্লিষ্টরা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, অবৈধ অস্ত্রের পেছনে আন্তর্জাতিক মাফিয়া ও চোরাচালানিদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক কাজ করছে। তারা বাংলাদেশকে অস্ত্র ব্যবসার রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। তবে এ সুযোগে এসব অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদের ক্ষুদ্র একটি অংশ সহজেই বাংলাদেশের জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের হাতে চলে যাচ্ছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, দিয়াবাড়ি ও পূর্বাচল থেকে যে বিপুল অস্ত্র জব্দ হলো এর পেছনে কারা জড়িত তদন্তের মাধ্যমে তা বের করা হোক। এত বড় বড় অস্ত্রের মজুদদাতারা যে দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলছে তা স্পষ্ট। সীমান্ত পথেই অস্ত্র ঢুকছে, সে বিষয়ে বিজিবিকে আরো তৎপর হতে হবে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তায় সংশ্লিষ্ট বাহিনীকে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করে আইনে আওতায় আনতে হবে।

২০১৬ সালের ১৮, ১৯ ও ২৫ জুন রাজধানীর তুরাগের মিরপুর-আশুলিয়া বেড়িবাঁধ সংলগ্ন দিয়াবাড়ি খাল থেকে তিন দফায় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও বিস্ফোরকের সন্ধান পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বস্তাভর্তি এসব অস্ত্র-গোলাবারুদ খালের পানিতে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। এ ঘটনার রহস্য উদঘাটনে ব্যর্থ সংশ্লিষ্টরা। এই বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধারের সপ্তাহ না পেরুতেই দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁর সেই জঙ্গি হামলায় দেশি-বিদেশি ২২ জন মানুষ প্রাণ হারান। কমান্ডো অভিযানে পাঁচ জঙ্গিও নিহত হয়।

এদিকে উত্তরার দিয়াবাড়ি খাল থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদ জব্দের ঠিক এক বছর পর গত ১ জুন রাতে রাজধানীর অদূরে রূপগঞ্জের পূর্বাচলে কাছাকাছি আরও দুটি খাল থেকেও অস্ত্র-গোলাবারুদের সন্ধান মেলে। দুটি ঘটনায় পাওয়া অস্ত্রের চালানের মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতে, দুটি চালান একই গোষ্ঠীর। যদিও এখন পর্যন্ত দুটি ঘটনার কোনোটিরই রহস্য ভেদ করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

যে মূর্হুতে রাজধানীসহ দেশব্যাপী জঙ্গি বিরোধী সাঁড়াশি অভিযান চলছিল, ঠিক তখন এত বড় অস্ত্র চালান উদ্ধারের ঘটনায় জঙ্গি বিরোধী অভিযানকেই চ্যালেঞ্জর মুখে ফেলে দেয়। যদিও গত এক বছরে জঙ্গিবিরোধী প্রায় ২০টি অভিযানে ৫৭ জন জঙ্গি নিহত ও অর্ধশত জঙ্গিকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সেসব অভিযান থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদও জব্দ করা হয়।

এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, অস্ত্রের বড় বড় চালান দেশে এর আগেও এসেছে। আমরা চেষ্টা করছি তা বন্ধ করতে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যাপক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। দিয়াবাড়ি ও পূর্বাচল সিটির লেক থেকে অস্ত্রের চালানটি উদ্ধার তারই প্রমাণ। সন্ত্রাসী চক্রের হাতে যাওয়ার আগেই অস্ত্রের চালানটি ধরা পড়েছে। এতেই প্রমাণ হয় র‌্যাব-পুলিশ খুবই তৎপর।

তিনি বলেন, সরকার জঙ্গি দমনে যেমন সফলতা অর্জন করেছে, তেমনি অস্ত্র উদ্ধার অভিযানেও সফল। একই বিষয়ে গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন বলেন, বিভিন্ন এলাকার সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র আসছে। প্রতিবেশি দেশ ভারত থেকেই বেশিরভাগ অস্ত্র বাংলাদেশে ঢুকে। তারপর সেগুলো পৌঁছে যায় সন্ত্রাসীদের কাছে। এসব অস্ত্র ও অস্ত্রধারী ধরতে ডিবির একাধিক টিম মাঠে কাজ করছে।

এদিকে গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ ও র‌্যাবের হাতে সম্প্রতি ধরা পড়া আগ্নেয়াস্ত্রের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের ৪৮টি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিনই অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের চালান ঢুকছে। সবচেয়ে বেশি আসছে প্রতিবেশি দেশ ভারত থেকে। ভারতে তৈরি ৭.৬৫ পিস্তল বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকায় কিনছে চোরাকারবারিরা।

সেই অস্ত্র বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকায়। আর ৯এমএম পিস্তল সীমান্তে বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকায়। সেই অস্ত্র ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে অন্য জেলায় পৌঁছানোর পর। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে এই অস্ত্র বেশি ঢুকছে। ফল ও সবজির ট্রাক এবং ট্রেনে করে এসব অস্ত্র পালাক্রমে হাতবদল হয়ে বিভিন্ন জেলায় পৌঁছে যাচ্ছে। এগুলোর বেশিরভাগই আসছে নির্বাচনের ভোটের মাঠে ব্যবহারের জন্য।

এদিকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অবৈধ অস্ত্র, বিস্ফোরক ও গুলি উদ্ধারের ঘটনাও বেড়েছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এই ছয় মাসে শুধু রাজধানীতেই উদ্ধার হয়েছে ২৩১টি আগ্নেয়াস্ত্র। একই সময়ে অস্ত্র-সংক্রান্ত মামলা হয়েছে ১৯৪টি। গ্রেফতার হয়েছে ৪১৫ জন।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, সারাদেশে অস্ত্র ঢুকছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, যশোরের বেনাপোল ও সাতক্ষীরা হয়ে। কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্ত পথেও চোরাই অস্ত্র আসছে। কিছু ধরা পড়লেও অধিকাংশই রয়ে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। গত বছরের ৩১ অক্টোবর ভারতের খায়রুল ইসলাম ম-ল ১০টি আগ্নেয়াস্ত্রসহ গ্রেফতার হন। তার বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনায় হলেও কয়েক বছর ধরে তিনি বাংলাদেশেই থাকছেন।

পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে ম-ল জানান, প্রায় ১০ বছর ধরে তিনি অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। প্রতি মাসে অন্তত ১০টি অস্ত্র ঢাকায় পাঠান। এসব অস্ত্র তিনি ঢাকায় এনে ৮০ হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। অস্ত্র চোরাচালানে তিনি মূলত বেনাপোল সীমান্ত ব্যবহার করতেন। সীমান্ত এলাকায় তার ২০-২২ জন সহযোগী রয়েছে।

সোনালীনিউজ/জেডআরসি/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!