• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যাংকে লাভ নেই, জমানো টাকায় কৃষকের ধান মজুদ


শেখ আবু তালেব, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জুলাই ২৫, ২০১৭, ০৫:২৫ পিএম
ব্যাংকে লাভ নেই, জমানো টাকায় কৃষকের ধান মজুদ

ঢাকা: ভরা ধানের মৌসুমেও চাল তৈরি করার জন্য মিলাররা চাল পাচ্ছেন না। বাড়তি দামে ধান কিনতে হাটে হাটে লোক পাঠালেও ফিরছেন খালি হাতে। সূত্র জানিয়েছে, খরচ তুলে নিতে ও ধার দেনা পরিশোধ করতে আগে কৃষকরা ফসল কাটার পরেই ধান বিক্রি করে দিতেন। সেই টাকা রাখতেন ব্যাংকে। এখন ব্যাংকে আমানতের উপর মুনাফা কম দেয়ায় সেই টাকা বিনিয়োগ করছেন ধানে। এজন্য প্রান্তিক কৃষকের বাড়িগুলো হয়ে উঠেছে ধানের গুদাম।

হাওরে বন্যায় ফসল নষ্ট হওয়ার অজুহাতে চাল ব্যবসায়ীরা হঠাৎ করেই দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই সময়েও বাজারে নতুন চাল আসছিল। নতুন চাল উঠার পরেও কমেনি। হাওরে বন্যা হয়েছে এমন অজুহাতে গত দেড় মাসে কেজি প্রতি চালের দাম ১৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। দাম বৃদ্ধির পরেও সবচেয়ে বেশি সংকট দেখা গিয়েছে মোটা চালের।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে ৩ কোটি ৪৯ লাখ ৬৮ হাজার টন চাল উৎপাদিত হয়েছে। যা আগের বছরের চেয়ে ২ লাখ ৫৮ হাজার টন বেশি। চলতি অর্থবছরে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ কোটি ৫০ লাখ টন। সরকারি হিসাবে, দেশে মোট ধানের মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ হাওর অঞ্চলে উৎপাদিত হয়। এ হিসাবে মাত্র ৯ লাখ টন চাল কম উৎপাদন হওয়ার কথা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই তিন শতাংশ কম উৎপাদনের প্রভাব পুরো বাজারে এভাবে পড়তে পারে না। নিশ্চয় কোনো কারণ আছে। অনুসন্ধানে দেখা গিয়েছে, আড়তেও চাল নেই। মিলাররা বলছেন, ধান না পেলে চাল উৎপাদন করবো কিভাবে। আমরা সীমিত মার্জিনে চাল বাজারে ছেড়ে দেই। স্টক করার কোনো সুযোগ নেই।

কৃষকের গোলায় ধানের মজুদ : অপরদিকে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের হিসাবে ২০১৬ সালে বিশ্বে মোট চাল উৎপাদন হয়েছে ৪৮ কোটি ৩১ লাখ টন। চলতি বছরে তা নেমে ৪৮ কোটি ১০ লাখ টন হতে পারে বিরূপ আবহাওয়ার কারণে। শতাংশ হিসেবে যা ০.৪৩ শতাংশ কম। দেশটির গবেষণা বিভাগ এ বিষয়ে আগেই পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছে। অথচ বিশ্বে কম উৎপাদন হওয়ার সময়েও বাংলাদেশে চাল উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ন হওয়ায় গত বছর ৫০ হাজার টন সেদ্ধ চাল রপ্তানি করেছে শ্রীলঙ্কায়।

পাশাপাশি সদ্য শেষ হওয়া অর্থবছরে সরকারিভাবে বিভিন্ন ধরন ও মানের ৩.৯৩ লাখ মেট্রক টন ও বেসরকারিভাবে ৫০.০৫ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য আমদানি করেছে সরকার। চলতি অর্থবছরে সরকার মে মাস পর্যন্ত ১.১৫ লাখ টন চাল আমদানি করেছে। এ হিসাবে সরকারের কাছে যথেষ্ট থাকলেও তাহলে প্রশ্ন উঠে এতো ধান গেল কোথায়।

এ বিষয়ে দেশের উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে বড় চাল সরবরাহকারী জেলা নওগাঁ রাইস মিল মালিকদের সংগঠনের সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, ধানের দাম বেড়েছে। প্রতি হাটে লোক পাঠাচ্ছি বেশি দাম দিলেও ধানের যোগান কম। ৮০০ টাকা মনের ধান এখন ১১৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। আমরা কেজি প্রতি ৫০ পয়সা থেকে ১ টাকা লাভ করেই চাল ছেড়ে দেই। এখন ধানের দাম বাড়ায় বেশি দামে চাল দিতে হচ্ছে। ধানের দাম কেন বাড়ছে, এর উত্তরে তিনি বলেন, সেটা খাদ্য মন্ত্রণালয় ও সরকার বলতে পারবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কৃষকরা নিজেদের প্রয়োজন ছাড়া বাকি ধান বিক্রি করে দেয় বাজারে। এজন্য মৌসুমে ধানের দাম কম থাকে। ধান বিক্রির টাকা দিয়ে ঋণ ও খরচ মিটিয়ে থাকেন। বাকি টাকা ব্যাংকে জমা রাখেন। কিন্তু এখন আমানতের ওপর ব্যাংকগুলো মুনাফা কমিয়ে দেয়ায়, সেই টাকা দিয়ে আরো ধান কিনে নিজেদের গোলায় ভরে রেখেছেন। বাড়তি দামের আশায় ধীরে ধীরে বিক্রি করবেন। প্রান্তিক পর্যায়ে যারাই ৫০ থেকে ২০০ শত মণ ধান পেয়েছেন তারা কেউ, বিক্রি করেননি। আগে তারাও বাজারে ধান বিক্রি করে দিতেন।

আগাম টাকা দিয়েছে সিন্ডিকেট : কৃষকদের মুনাফা দিতে ও বিভিন্ন প্রয়োজনে ধান, চাল ও গম কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে থাকে। আপদকালীন সময়ে সেই চাল ভর্তুকে দিয়ে বা বিনে পয়সায় জনগণের মাঝে বিলিয়ে দেয়। এজন্য সরাসরি মিল মালিক ও কৃষকদের কাছ থেকে ধান, চাল ও গম সংগ্রহ করে থাকে। নিয়ম অনুযায়ী কৃষক ও মিল মালিকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান, চাল সংগ্রহ করার কথা সরকারের। কিন্তু সিন্ডিকেটের নির্ধারিত স্লিপ ছাড়া একটি চালও গুদামে যায় না।

গত বছর সিন্ডিকেটগুলো বেশ কিছু কৃষকদের কাছ থেকে বেশি দামে আগেই ধান কিনে নিয়েছিলো। কিন্তু শর্ত হিসেবে কৃষকের বাড়িতেই ধান রেখেছিল। বাজারে সরবরাহ কম বলে সরকারের কাছে বিক্রির সময়ে ধান কেজি প্রতি ২ টাকা ও চালের দাম কেজি প্রতি ৩ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছিল। এবারও সরকারি পর্যায়ে এবার খাদ্যশস্য সংগ্রহ অভিযানে ধানের দর নির্ধারণ করেছে ২৪ টাকা, যা গত বার ছিল ২২ টাকা। কেজি প্রতি চালের দর নির্ধারণ করেছে ৩৪ টাকা, যা গতবার ছিল ৩১ ও ৩২ টাকা।

কিন্তু মিল মালিক ও সরবরাহকারীরা ইতিমধ্যে দাবি তুলতে শুরু করেছেন, চালের দাম অন্তত ৩৬ টাকা কেজি প্রতি করার। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, বাজারের দর চেয়ে বেশি। তাই ৩৪ টাকায় চাল দিলে লস হবে। এজন্য এবারের চাল সংগ্রহ মওসুমেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি সরকার। এজন্য গতবারের মতো কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সরকারি পর্যায়ে দাম বাড়ানোর পরিকল্পনায় রয়েছেন তারা। এজন্যই বাজারে চালের সংকট দেখা গিয়েছিল।

যুক্তি হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারিভাবে চাল আমদানি হলেও তা এখনো বাজারে যায়নি। আরো সপ্তাহ খানেক সময় লাগবে। কিন্তু সরকারি নজরদারির জন্য সিন্ডিকেটগুলো বাজারে চালের যোগান দেয়ায় দাম কিছুটা কমতে শুরু করেছে।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/তালেব

Wordbridge School
Link copied!