• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন বন্ধ হতে যাচ্ছে তানোরে


ইলিয়াস আরাফাত, রাজশাহী ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৭, ০৫:২৯ পিএম
ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন বন্ধ হতে যাচ্ছে তানোরে

ফাইল ছবি

রাজশাহী: জেলার তানোর উপজেলার বাঁধাইড় ইউনিয়নকে ওয়াটার স্টেজ এরিয়া (পানি সংকটপূর্ণ ইউনিয়ন) ঘোষণা করতে যাচ্ছে। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর তলানিতে নামায় বরেন্দ্র অঞ্চল নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা গবেষণা সংস্থা ‘ডাসকো ফাউন্ডেশন’ পরিচালিত সমন্বিত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্প (আইডাব্লুউআরএম) জরিপে বাধাইড় ইউনিয়ন এলাকাকে নিরাপদ পানির অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

সংস্থাটি ওই ইউনিয়ন এলাকায় সব গভীর নলকুপে থেকে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন বন্ধ করতে সরকারের কাছে প্রস্তবনা পাঠানোর প্রস্ততি নিচ্ছে। প্রস্তাবনা পাঠালে যে কোন সময় বাধাইড় ইউনিয়ন থেকে ভূ-গর্ভস্থ থেকে পানির উত্তোলন পুরোপুরি বন্ধ করার ঘোষণা আসতে পারে সরকারের পক্ষে থেকে।

ভূ-গর্ভস্থ পানি স্তর দ্রুত নিচে নামায় এ ইউনিয়কে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ও সংকটপূর্ণ ইউনিয়নের হিসাবে বরেন্দ্র বহুমুখি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) এর তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে।

সম্প্রতি এক সেমিনারে বিএমডিএর চেয়ারম্যান ড.আকরাম হোসেন চৌধুরী জানান, ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমে নিচে নেমে যাওয়ায় কৃষি মন্ত্রালয়ের নির্দেশ আছে যে বরেন্দ্র অঞ্চলে নতুন করে আর গভীর নলকূপ স্থাপন করা যাবেনা। রাজশাহী জেলার ইউনিয়নগুলোর মধ্যে তানোর উপজেলার বাধাইড় ইউনিয়ন বেশি উচু। সেখানে পানির স্তর ব্যাপক হারে নিচে নেমে যাচ্ছে।

এর আগে ২০১৫ সালে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগতভাবে নিচে নামায় বরেন্দ্র অঞ্চলের ৩টি পৌরসভা ও ১৫ ইউনিয়ানকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ডাসকো ফাউন্ডেশন পরিচালিত সমন্বিত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্প (আইডাব্লুউআরএম) নামে একটি প্রকল্প জরিপ চালিয়ে এসব এলাকা চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে বাঁধাইড় ইউনিয়ন তার এক নম্বরে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় এক নাম্বারে ছিল।

ইউনিয়নে বিএমডিএ’র ৭০টি গভীর নলকূপ রয়েছে। যা দীর্ঘ ২০ বছর দুই হাজার হেক্টর বেশি জমিতে সেচ সুবিধা দিয়ে আসছিল। এর মধ্যে ২০১৫ সালে থেকে বৌদ্দপুর মৌজার একটি গভীর নলকুপ পানির অভাবে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। আর কম পানি উঠে বা নাজুক অবস্থায় রয়েছে আরো ২৫টির বেশি গভীর নলকূপ।

বৌদ্দপুর গ্রামের গভীর নলকূপ অপরেটর আব্দুল আজিজ জানান, ২০১০ সাল থেকে তার গভীর নলকূপটি পানি কমতে থাকে। ২০১৫ সালে তা একেবারে শূন্যের কোঠায় এসে পানির অভাবে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। তার এলাকায় ২০০ বিঘার বেশি জমি পতিত পড়ে আছে।

বহরলই মৌজার গভীর নলকুপ অপরেটার নুরুজ্জামান জানান, তার গভীর নলকূপটি প্রথম অবস্থায় ২০০ বিঘার বেশি জমিতে চাষাবাদ করা হতো। বর্তমানে পানি কম উঠায় মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ বিঘা জমি চাষাবাদ হয়েছে।

তিনি আরো জানান, পানি কম উঠায় এক বিঘা জমি ভেজাতে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা সেচ দিতে হচ্ছে। এই কারণে কৃষকেরা গভীর নলকূপের আওতায় জমিতে চাষাবাদ করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এ গভীর নলকূপে এক বিঘা জমি চাষ করতে চার গুণ বেশি খরচ হচ্ছে।

বাঁধাইড় ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আতাউর রহমান জানান, একযুগ আগেও ইউনিয়নে কুপ, টিউবওয়েল দিয়ে মানুষ তাদের প্রয়োজনিয় খাওয়ার পানি ব্যবহার করেছে সহজেই। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নামাই বর্তমানে ইউনিয়ন এলাকায় কুপ ও টিউবওয়েল পানি শূণ্য হয়ে পড়ে আছে। এখানকার মানুষের একমাত্র খাওয়ার পানি ভরসা গভীর নলকুপ ও সাব-মার্সেবল পাম্প। তাও বেশি পানি উঠেনা।

বিএমডিএ তানোর জোনের প্রকৌশলী শরিফুল ইসলাম বলেন, রাজশাহী জেলার অন্যসব ইউনিয়নের চেয়ে বাঁধাইড় ইউনিয়ন সবচেয়ে উচু অঞ্চল হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পানির স্তর দ্রুত নিচে নামাই এ ইউনিয়নকে নিয়ে চিন্তিত বিএমডিএ। ধানের বদলে অন্য কোন ফসল করার জন্য কৃষকদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।

এ প্রকৌশলী আরো জানান, বাঁধাইড় ইউনিয়নকে নিয়ে নতুন প্রকল্পে চিন্তা করছে বিএমডিএ। এ প্রকল্পের মাধ্যমে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহান্দা থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে ইউনিয়নে খাল-খনণ করে ও পুকুরে পানি সংরক্ষণ করা হবে। সেখান থেকে কৃষকদের সেচ সুবিধা দেয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

আইডাব্লউআরএম’র মাঠ পর্যায়ের তানোর উপজেলার বাঁধাইড় ও মুন্ডুমালা পৌরসভায় দায়িত্বে প্রাপ্ত কমিউনিটি মবিলাইর আগস্টিনা হাঁসদা জানান, ২০১৫ সাল থেকে বরেন্দ্র অঞ্চলের ৩৫টি ইউনিয়ন ও ৪টি পৌরসভা নিয়ে কাজ করছে সংস্থাটি। এসব পৌর ও ইউনিয়নে পানির স্তর পরিমাপ কুপ বসানো হয়েছে। যা প্রতি মাসে দুই বার করে মাপ করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দ্রুত ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর বাধাইড় ইউনিয়ন এলাকায় নেমে যাচ্ছে।

বাঁধাইড় ইউনিয়নের ঝিনাইখোর এলাকায় ২০১৫ সালে পানির স্তর পরিমাপ কুপ বসানো হয়েছিল। তখন পানির স্তর ছিল ৯৯ ফিট। মাত্র দুই বছরে ২০১৭ সালে এসে ১১১ ফুট ৯ ইঞ্চি নিচে পানির স্তর পাওয়া পাচ্ছে। দুই বছরে ১২ ফিট নিচে পানি স্তর চলে গেছে। নতুন করে এখানে গভীর নলকূপ স্থাপন করলে ১৮০ থেকে ২০০ ফিট গভীর থেকে পানি উত্তোলন করতে হবে। তাতে এ এলাকার মিঠা পানির সংকট ভয়াভহ আকার ধারণ করবে।

সংস্থাটির রাজশাহী অঞ্চলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম খান জানান, এক যুগ আগেও উল্লেখিত ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে ৬০ থেকে ৯০ ফুট গভীরে পানি পাওয়া যেতো। বর্তমানে তা ১৬০ ফুট বা তারও নিচে না গেলে পানি মিলছে না। ঝুঁকিপূর্ণ এসব এলাকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬৫ সেন্টিমিটার উঁচুতে অবস্থান করছে। ঝুঁকিপূর্ণ ইউনিয়ন ও পৌর এলাকাগুলোতে দ্রুত গভীর নলকূপের পানি দিয়ে বোরো আবাদ বন্ধ করতে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে পানির রিচার্জ করতে বিদ্যমান বড় পুকুর ও খাড়ি খনন করে ভূ-উপরস্থ পানির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে বলা হয়েছে।

এ কর্মকর্তা আরো জানান, ইউনিয়নকে সরকার পানি সংকটপূর্ণ এলাকা হিসাবে ঘোষনা করলে এ ইউনিয়নে আর কোন গভীর নলকুপ দিয়ে পানি তুলতে পারবেনা। এর আগে বাধাইড় ইউনিয়নে সংস্থার পক্ষে চলতি বছরেই আরো ১০০টির মতো পানির স্তর পরিমাপ পরীক্ষা করা হবে।

এ ইউনিয়নের পর দ্বিতীয় তালিকায় রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়ন। এ ইউনিয়নও ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নামছে।


সোনালীনিউজ/ঢাকা/আকন

Wordbridge School
Link copied!