• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মহাজোটের বিশ্লেষণ কাজে লাগাতে চায় বিএনপি


সোনালী বিশেষ ডিসেম্বর ২৪, ২০১৭, ১২:৩৮ পিএম
মহাজোটের বিশ্লেষণ কাজে লাগাতে চায় বিএনপি

ঢাকা : রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার কাছে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সরফুদ্দীন আহম্মেদ ঝন্টুর ৯৮ হাজার ভোটের ব্যবধানে হেরে যাওয়া নিয়ে দলটির সদরে-অন্দরে চলছে পরাজয়ের পোস্টমর্টেম, চুলচেরা বিশ্লেষণ।

আওয়ামী লীগের স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতাদের সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে বিব্রত হওয়ার পাশাপাশি এর প্রভাব বাকি ছয় সিটি ও জাতীয় নির্বাচনে পড়ার আশঙ্কায় ভুগছে।

আওয়ামী লীগের স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ঝন্টু যে ৬২ হাজার ৪০০ ভোট পেয়েছেন, সেটি দলের ভোটব্যাংক। বাড়তি কোনো ভোট যোগ হয়নি এই নির্বাচনে। এর মধ্যে হিন্দুদের ভোট রয়েছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার। বাকি ভোটগুলো আওয়ামী লীগের সমর্থক ও কর্মীর। তবে রংপুর সিটিতে আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক এক লাখ ২০ হাজার বলে দাবি করেছেন দলের মহানগর সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি মণ্ডল।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নৌকা রংপুর সিটি নির্বাচনে ডুবল কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে সাবেক মেয়রের আচরণ নিয়ে অভিযোগ এসেছে ভোটারদের কাছ থেকে; তবে নেতারা বলছেন অন্য কথা।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের পরাজয়ের কারণ নিয়ে বিশ্লেষণে যেতে রাজি নন। বরং সরকারের শরিক দল জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে পরোক্ষ সমর্থনের মাধ্যমে আসল প্রতিপক্ষ বিএনপির প্রতি একটি বার্তা দেওয়ার ইংগিত এসেছে তার কথায়।

গত বৃহস্পতিবার এ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক মেয়র সরফুদ্দীন আহম্মেদ ঝন্টুকে প্রায় লাখ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা।

গত নির্বাচনের সঙ্গে এবারের ভোটের পরিসংখ্যান মিলিয়ে দেখলে মনে হয়, এইচ এম এরশাদের ‘দুর্গ’ রংপুরে তার দল জাতীয় পার্টি এবার ঐক্যের ফসল তুলেছে।      

২০১২ সালের ২০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ঝন্টু মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন ১ লাখ ৬ হাজার ২৫৫ ভোট পেয়ে।

ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ছিল কোন্দলে জর্জরিত। এর জেরে দল থেকে বহিষ্কৃত মোস্তফা তখন তৃণমূল জাতীয় পার্টির জেলা আহ্বায়ক। নির্বাচনে তিনি পান ৭৭ হাজার ৮০৫ ভোট। আরেক বিদ্রোহী প্রার্থী তৃণমূল জাতীয় পার্টির মহানগর আহ্বায়ক আবদুর রউফ মানিক পান ৩৭ হাজার ২০৮ ভোট।

রংপুর জাতীয় পার্টির দুই নেতা মিলিয়ে ওই নির্বাচনে পেয়েছিলেন মোট ১ লাখ ১৫ হাজার ১৩ ভোট। বিভেদের সুযোগে শেষ হাসিটা ঝন্টুই হেসেছিলেন।
২০১৭ সালের ২১ ডিসেম্বরের ভোটে মোস্তফা লাঙ্গল প্রতীক পেয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার ৪৮৯ ভোট। আর ৬২ হাজার ৪০০ ভোট গেছে ঝন্টুর নৌকায়। তাদের ভোটের ব্যবধান এবার ৯৮ হাজারের বেশি।

সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ রংপুরেরই এমপি, দশম সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এবার আওয়ামী লীগের সরকারেও শরিক। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে গাঁটছড়া ছিঁড়ে বিদ্রোহী হয়েছিলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ।

বিএনপির মত এরশাদও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু তার স্ত্রী রওশন এরশাদ (বর্তমানে পার্টির সিনিয়র কো চেয়ারম্যান) সে সময় দলের অর্ধেক নেতাকে নিয়ে ভোট করার পক্ষে অবস্থান নেন। ভোট বর্জন করেও রাজনীতির মারপ্যাঁচে রংপুর-৩ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ। অনেক নাটকীয়তার পর তিনি শপথও নেন, সেই সঙ্গে পান প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের পদ।
   
রাজনৈতিক নেতা, বিশ্লেষক আর ভোটাররা বলছেন, রংপুর বরাবরই জাতীয় পার্টির ঘাঁটি ছিল, এখনও রয়েছে। ঝন্টুর হারের পেছনে মোটামুটি চারটি কারণের কথা এসেছে তাদের কথায়।

১. আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ‘নেতিবাচক’ ভাবমূর্তি ভোটারদের দূরে ঠেলেছে।

২. আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে কেন্দ্রীয় নেতাদের দৌঁড়াঝাপে ছিল সমন্বয়হীনতা; বরং জাতীয় পার্টির প্রার্থীর প্রতি পরোক্ষভাবে আনুকূল্য ছিল বলেও কারও কারও মনে হয়েছে।

৩. ঝন্টুর প্রতীক নৌকা হলেও ভোটাররা মূল্যায়ন করেছেন ব্যক্তি ঝন্টুর কাজ।

৪. জাতীয় পার্টির ঘাঁটিতে এবার বড় বিভাজন না থাকায় লাঙ্গল বিপুল বিজয় পেয়েছে।

২০০৯ সালে রংপুর সদর উপজেলার চেয়ারম্যান ছিলেন মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। পাঁচ বছর আগে জাতীয় পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হয়ে তৃণমূল জাপা গঠনের উদ্যোগ নিলেও এখন তিনি মহানগর জাতীয় পার্টির সভাপতি।

সাবেক মেয়র সরফুদ্দীন আহম্মেদ ঝন্টুর রাজনীতির সূচনা ছাত্রলীগে হলেও স্বাধীনতার পর যোগ দিয়েছিলেন জাসদে। ১৯৮৭ সালে রংপুর সদর উপজেলার চেয়ারম্যান, ১৯৯২ সালে রংপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান এবং ১৯৯৬ সালে রংপুর-১ আসন থেকে জাতীয় পার্টির টিকেটে তিনি সাংসদ নির্বাচিত হন। জাপা হয়ে ২০০১ সালে ফেরেন আওয়ামী লীগে। বর্তমানে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীতে আছেন।

রংপুরের মানুষ যা বলছে: ভোটের ফলের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সচেতন নাগরিক কমিটি রংপুর জেলা শাখার সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মলয় কিশোর ভট্টাচার্য বলেন, জনগণ চায় জনপ্রতিনিধি হবেন জনবান্ধব। তাদের কাছ থেকে ভালো আচরণ, সম্মান আশা করে সবাই। ঝন্টু সাহেব সেটা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। সাবেক মেয়রের আচরণ নিয়ে আপত্তি আছে বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি রংপুর জেলা শাখার সভাপতি অধ্যক্ষ আবদুল ওয়াহেদ মিঞারও।

হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সাহেব দীর্ঘদিন রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন। ২৬ বছর ধরে রংপুর সদর আসনের এমপি থেকেও এলাকার কোনো উন্নয়ন তিনি করেননি। মেয়র ঝন্টু কিন্তু উন্নয়ন করেছেন। এরপরও মানুষ নৌকা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল কেন? কারণ মানুষ তার কাছ থেকে ভালো আচরণ পায়নি। আর আওয়ামী লীগও এবার প্রার্থী দিয়ে তার পক্ষে খুব বেশি কাজ করেনি বলে ওয়াহেদ মিঞার মনে হয়েছে।

ভোটের মাঠে স্থানীয় আওয়ামী লীগকে ঝন্টু সাহেবের পক্ষে কোমর বেঁধে কাজ করতে দেখা যায়নি। দলীয় প্রার্থীকে জয়ী করে আনার জন্য ভোটের যতরকম কৌশল রয়েছে তা প্রয়োগ করা হয়নি। স্থানীয় নেতারা দায় সারাভাবে কাজ করেছেন। ফলে ভোটাররা লাঙ্গলের দিকেই ঝুঁকেছেন। জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোতাহার হোসেন সমন্বয়ের অভাবের কথা স্বীকার করলেও তাদের প্রার্থীর আচরণ নিয়ে অন্যদের সুরেই কথা বলেছেন।

ঝন্টু ভাইয়ের পক্ষে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় জনসংযোগ করেছি। আমি দেখেছি মানুষ নৌকাকে ভোট দিতে চায়, কিন্তু ঝন্টু সাহেবের আচরণে তারা তার প্রতি ভীষণ ক্ষুব্ধ। এছাড়া নির্বাচনের সময় প্রার্থীর সঙ্গে দলের একটা সমন্বয়ের অভাবও ছিল।

৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের রঘু বাজারের ওষুধ ব্যবসায়ী মতিয়ার রহমানের কথায় রংপুর নগরীর প্রত্যাশিত উন্নয়ন না হওয়ার কথা এসেছে।
 
আমরা কাগজে-কলমেই শুধু সিটির বাসিন্দা। গত পাঁচ বছরে কোনো রাস্তা পাকা হয়নি। সড়কে বাতি জ্বলে না। পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেই। নতুন আশায় এলাকার মানুষ এবার লাঙ্গলে ভোট দিয়েছে।

যা বলছে দুই শরিক : আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে প্রার্থীর একটা বিষয় আছে। আমরাও ভালো প্রার্থী দিয়েছিলাম। এটা নিয়ে বিশ্লেষণ করা, এ নিয়ে আলাপ আলোচনা করার জন্য দলীয় ফোরাম আছে। সেখানে আলাপ আলোচনার আগে আমি এ ব্যাপারে কথা বলতে পারি না। তবে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির যে সখ্যতা, তা স্পষ্ট করতে রংপুরের ভোটকে কাজে লাগানো হয়েছে- এমন একটি ইংগিতও কাদেরের কথায় পাওয়া যায়। বিএনপি আত্মতুষ্টিতে ভুগছে। তারা কাউকে ২৫সিট দিচ্ছে, আমাদেরকে কখনো ৩০ সিট, কখনো ৪০ সিট মনে হয় তা এখন ভাঙবে। জাতীয় নির্বাচনে এটা তাদের জন্য একটা বার্তা।

জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গাও শরিকদের তুষ্ট রেখে কথা বলেছেন।

রংপুর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনার পরাজয় হয়নি, বরং আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীর পরাজয় হয়েছে। জনগণের সঙ্গে সমন্বয়হীনতা ও দুর্ব্যাবহার করার কারণে সরফুদ্দীন আহমেদ ঝন্টুর পরাজয় হয়েছে।

বিএনপি চায় অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে : রংপুর সিটিতে বিএনপির অবস্থান ভালো ছিল না কখনোই। ২০১২ সালের নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত কাওছার জামান বাবলা ২১ হাজার ২৩৫ ভোট পান; পাঁচ বছর পর বৃহস্পতিবারের নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে তিনি পেয়েছেন ভোট ৩৫ হাজার ১৩৬ ভোট।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেন, এখানে তো এরশাদ সাহেবের একটা অন্যরকম জনপ্রিয়তা রয়েছে। বরাবরই এখানে লাঙ্গলের ভোট বেশি। আর সরকারের কৌশল তো লাঙ্গলের ফেভারে ছিল; বোঝেনই তো, আওয়ামী লীগ আর জাপা তো এক। তারা সেটাই বোঝাতে চেয়েছে।

রংপুরে বিএনপি প্রার্থীর ভোটের সংখ্যা নিয়ে মাহবুব সন্তুষ্ট নন। তবে এ নির্বাচনের অভিজ্ঞতা আগামী সিটি ভোটগুলোতে লাগানোর ওপর জোর দিচ্ছেন তিনি।

স্বস্তির ভোট : নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর মোর্চা ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্র“পের (ইডব্লিউজি) পরিচালক আব্দুল আলীমের মতে, রংপুরের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হল সংঘাত ও অনিয়মহীন শান্তিপূর্ণ ভোট।

এটা এরশাদের ঘাঁটি, এখানে লাঙ্গল প্রীতি রয়েছে ভোটারদের। জাতীয় নির্বাচনের হিসাব-নিকাশ স্থানীয় এ নির্বাচনে খাটবে না।  ভোটে তেমন প্রভাব পড়েনি। তবে দল বা কে জিতল- এর চেয়ে বড় বিষয় রংপুরে নির্বাচনের জয় হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদের কথাতেও সন্তুষ্টির সুর। নির্বাচন কমিশন যেমন চেয়েছে, রংপুরে সেভাবে ভোট হয়েছে। একটি ভালো নির্বাচন আমরা উপহার দিতে পেরেছি। এটা স্থানীয় সরকারের ভোটে একটা মানদ­ হয়ে থাকবে। এটাকে মডেল ধরে আমরা আগামীতেও কাজ চালিয়ে যাব।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!