• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
চলছে বক্তব্য, পাল্টা বক্তব্য আর বিষোদ্গারের খেলা

মাঠের রাজনীতি এখন ইফতার পার্টিতে


জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিশেষ প্রতিনিধি জুন ৩০, ২০১৬, ০১:৩৭ পিএম
মাঠের রাজনীতি এখন ইফতার পার্টিতে

চোখে পড়ার মতো কোনো কর্মসূচিও নেই রাজনৈতিক দলগুলোর। সেই হিসেবে মাঠে নেই রাজনীতি। পবিত্র রমজান মাসে ইফতার পার্টিই হয়ে উঠেছে রাজনীতির মাঠ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তো বটেই, ইফতারকে কেন্দ্র করে ‘বিশেষ রাজনৈতিক মিশনে’ নেমেছে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও।

প্রতিদিনই রাজধানীর কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো দলের ইফতার অনুষ্ঠান হচ্ছে। সেসব ইফতার পার্টিতে যোগ দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ দুই জোটের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। পুলিশি বাধার মুখে ইফতার অনুষ্ঠান যেমন পন্ড হওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। আবার দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকা অনেক নেতাও যোগ দিচ্ছেন ইফতার অনুষ্ঠানে। সব মিলিয়ে বলা যায়, মাঠের রাজনীতি এখন গড়িয়েছে ইফতার রাজনীতিতে। তাই মাঠ ছেড়ে নেতাকর্মীরাও ব্যস্ত এখন ইফতার নিয়েই।

রাজনৈতিক দলগুলোও মনে করছে, এই ইফতারকে কেন্দ্র করে রাজনীতির পাশাপাশি দলের সার্বিক কর্মকান্ডেও গতি আসবে। এসবই রাজনীতির অংশ। তবে আওয়ামী লীগ চাইছে, এই ইফতার কর্মসূচি দিয়ে দলীয় নেতাকর্মী ও মিত্রদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করতে এবং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখার পাশাপাশি বিভিন্ন মহলের সঙ্গে সংযোগ বাড়াতে। অন্যদিকে ইফতার রাজনীতির মাধ্যমে দলের নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করার উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। কারণ ঈদের পর ফের রাজপথের আন্দোলনে নামতে চাইছে দলটি। তাই নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রাণ চাঞ্চল্য ফিরে আনতেই ইফতার পার্টির একাধিক আয়োজনে অংশ নিচ্ছে দলটির সর্বস্তরের কর্মী বাহিনী। জাতীয় পার্টিসহ অন্য দলগুলোরও একই অভিলাষ।

তবে ইফতার পার্টি কেন্দ্রিক এই রাজনীতির বাস্তব প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বিভিন্ন ইফতার অনুষ্ঠান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সাংগঠনিক তৎপরতার পরিবর্তে ইফতার অনুষ্ঠানগুলো রূপ নিয়েছে একে অন্যের বিরুদ্ধে কাঁদা ছোড়াছুড়ির মঞ্চে। দলের নেতারা যত না সাংগঠনিক কথা বলছেন, তার চেয়ে বেশি তির্যক মন্তব্য ছুড়ছেন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। সে মন্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে বিতর্কেও কেউ কেউ। চলছে বক্তব্য, পাল্টা বক্তব্য, বিষোদ্গারের খেলা। এমনকি ইফতার অনুষ্ঠান ছাড়িয়ে সে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে বাইরেও।

পবিত্র এই মাসে রাজনৈতিক কোনও নেতৃবৃন্দের মাঝে সিয়াম সাধনার কোনও বালাই নেই। ইফতার অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে পরনিন্দা আর পরশ্রীকাতরতায় ব্যস্ত রাজনীতিকেরা।
এসব নিয়ে কথা বলতে গেলে সেখানেও পরস্পরের বিরুদ্ধে তির্যক মন্তব্য করেন দুই দলের দুই নেতা।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, তাদের (বিএনপি) চিন্তা-চেতনার মাঝে সংমিশ্রণ আছে। তারা ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করে, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করতে চায়, আমরা এটা চাই না। বিএনপি যদি চায় রোজার মাসটাকে তারা ব্যবহার করবে সেটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।

আর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আ স ম. হান্নান শাহ বলেন, যখনই আমরা একটা ইফতার পার্টি করি, তখন ওই এলাকার সব নেতাকর্মী একত্রিত হয়। ওই ইফতার পার্টিটি আয়োজন করতে গেলেও সংগঠনের প্রয়োজন হয়। এতেও আমরা উপকৃত হচ্ছি এবং দল এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য সংগঠনকে গোছানো ও নেতাকর্মীদের উদ্দীপ্ত করে তোলা, কারো বিরুদ্ধে কুৎসা করা নয়।

এখন পর্যন্ত গোটা দশেক ইফতার অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও অবস্থাও তাই। তারা দুজনই ইতোমধ্যেই রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক ও সাংবাদিক পেশাজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সম্মানে আয়োজিতক ইফতারে অংশ নিয়েছেন। মুখে ইফতারের মধ্য দিয়ে সাংগঠনিক শক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করার কথা বললেও শেষ পর্যন্ত পরস্পরের বিরুদ্ধে কুৎসা ও সমালেচনায় প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সম্প্রতি রাজধানীর সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনে দলসমর্থিত সাংবাদিকদের এক ইফতার অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেন, আওয়ামী লীগের ভেতরেই জঙ্গি রয়েছে। এমনকি সাম্প্রতিক ‘ক্রসফায়ারের’ জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীকে দায়ী করেন। এই মন্তব্যের তিন দিন আগেও অপর এক ইফতার অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরেকটি তির্যক মন্তব্য করেন।

অন্যদিকে খালেদা জিয়ার সমালোচনা থেকে পিছিয়ে নেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাংবাদিকদের এক ইফতার অনুষ্ঠানে তিনি বিএনপি-জামায়াতের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, দেশে সাম্প্রতিক গুপ্তহত্যায় কারা জড়িত তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। তারেক রহমানের দিকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, লন্ডনে এক কুলাঙ্গার বসে আছে। ব্রিটিশ সরকার তাকে কেন সেখানে জায়গা দিয়েছেন জানি না। একই দিন খালেদা জিয়া এক ইফতার অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে বলেন, আজ দেশের মানুষ মনে করে, তিনি (শেখ হাসিনা) প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি নামে প্রধানমন্ত্রী। তিনি অন্যের নির্দেশ পালন করেন। এর আগে আরেক ইফতার অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়া ‘হাসিনা জেনেও জঙ্গিদের ধরছে না’ বলেও মন্তব্য করেন।

খালেদা জিয়ার এমন তির্যক মন্তব্যের শিকার হয়েছে জাসদও। এক ইফতার অনুষ্ঠানে তিনি জাসদকে আক্রমণ করে বলেন, এই দলের লোকজন তখন আওয়ামী লীগের লোকজনকে খুন করত, গুম করত। তাদের নেতার (বঙ্গবন্ধু) সম্পর্কে কী খারাপ ভাষায় বক্তব্য দিত, অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করত! সেগুলোকে এখন তিনি (হাসিনা) ভুলে গিয়ে নিজের দলের লোকজনকে মূল্যায়ন না করে এই খুনি-অত্যাচারীদের মূল্যায়ন করছে। তার ফলেই দেশের এই অবস্থা হচ্ছে। তাদের (সরকার) মধ্যে আসল সব খুনিরা রয়েছে।

এদিকে বিএনপির আয়োজিত এক ইফতার পার্টিতে রাশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশার অংশ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন ডালপালা মেলেছে। জানা গেছে, বিদিশাকে দিয়ে ‘জনদল’ নামে নতুন একটি প্ল্যাটফর্ম গঠনের চিন্তাও চলছে। নবগঠিত দলটি বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে থাকবে এমনটাও শোনা যাচ্ছে। অন্যদিকে ইফতার পার্টির মাধ্যমে শক্তি সঞ্চয় করতে চায় জাতীয় পার্টি। দলটির মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, সদ্য অনুষ্ঠিত দলের জাতীয় কাউন্সিল যেভাবে সফল হয়েছে তার চেয়েও ইফতার পার্টির মাধ্যমে সংগঠনের কার্যক্রমকে আরও বেগবান করা হবে।

তবে ইফতার পার্টি কেন্দ্রিক রাজনীতি নিয়ে অনেকে দ্বিমত থাকলেও এর মাধ্যমে নেতাকর্মীদের মধ্যে যে সৌহার্দ্য সৃষ্টি হচ্ছে তা মানছে সব রাজনৈতিক দলগুলোই।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি

Wordbridge School
Link copied!