• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুনাফা সত্ত্বেও বাড়ানো হচ্ছে গ্যাসের দাম


নিজস্ব প্রতিবেদক সেপ্টেম্বর ৫, ২০১৬, ১১:২৯ এএম
মুনাফা সত্ত্বেও বাড়ানো হচ্ছে গ্যাসের দাম

গ্যাস বিক্রেতা সরকারি সব কোম্পানিই বর্তমানে মুনাফায় রয়েছে। পেট্রোবাংলাসহ বিক্রেতা কোম্পানিগুলোর তহবিলে অলস পড়ে আছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বরেই সব পর্যায়ের গ্রাহকের ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয় ২৬ শতাংশ। এক বছর পার না হতে আবারও গ্যাসের দাম বাড়ানোর তৎপরতা চলছে। এরই মধ্যে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) শুনানি শেষ হয়েছে। অচিরেই দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে। শিল্পপতি-ব্যবসায়ীসহ সব মহল থেকে গ্যাসের দাম বাড়ানোর এ প্রস্তাবের সমালোচনা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এত লাভের পরও গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে কেন? এবার দাম বাড়ানো হলে পোশাক শিল্প থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে তারা মনে করছেন।

গত মার্চে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো ১৪০ শতাংশ পর্যন্ত গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় বিইআরসির কাছে। গত ৭ থেকে ১৮ আগস্ট পর্যন্ত এই প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি হয়। শুনানিতে কমিশনের মূল্যায়ন কমিটির পর্যবেক্ষণে বলা হয়, প্রায় প্রতিটি কোম্পানি গ্যাস বিক্রি করে লাভ করছে।

আর্থিক অসঙ্গতির কারণে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না- এমন যুক্তি দেখিয়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে গ্যাস কোম্পানিগুলো। কিন্তু পেট্রোবাংলাসহ গ্যাস কোম্পানিগুলোর বিভিন্ন তহবিলে ২৫ হাজার কোটি টাকা অলস পড়ে আছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। অবচয় তহবিল, বার্ষিক উদ্বৃত্ত অর্থ, গ্যাস উন্নয়ন তহবিল ও জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিলে এসব অর্থ জমা আছে। এর মধ্যে অবচয় ও উদ্বৃত্ত তহবিলেই ২২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা জমেছে। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে এর মধ্য থেকে বিনিয়োগ করা হয়েছে তিন হাজার কোটি টাকা। ১৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা অলস পড়ে আছে। গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে জমা আছে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি। গত অর্থবছরে এ তহবিল থেকে ১৭ প্রকল্পে ৬৫৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এ ছাড়া ব্যবহার নীতিমালা চূড়ান্ত না হওয়ায় জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিলের প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা অলস পড়ে আছে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তিতাসের মুনাফা ছিল ৩৫৯ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। একই অর্থবছরে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানির মুনাফা ছিল তিন কোটি ৫১ লাখ টাকা। বাখরাবাদের মুনাফা ৪৯ কোটি ২৪ লাখ, জালালাবাদের ৩৪ কোটি ২৩ লাখ এবং সুন্দরবন গ্যাস বিতরণ কোম্পানির মুনাফা ছিল ২৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা। সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরের হিসাব এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তবে সব কোম্পানির লাভের পরিমাণ বাড়বে বলে জানা গেছে। কোম্পানিগুলোর সরবরাহ করা তথ্য বিশ্লেষণ করে বিইআরসির মূল্যায়ন কমিটির পর্যবেক্ষণ হলো, বর্তমান মূল্যহার বিবেচনায় চলতি অর্থবছর (২০১৬-১৭) তিতাসের প্রায় ৩৬০ কোটি টাকা রাজস্ব মুনাফা থাকবে। বাখরাবাদ গ্যাস বিতরণ কোম্পানির রাজস্ব উদ্বৃত্ত থাকবে ৫০ কোটি টাকা। পশ্চিমাঞ্চল ও কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কোম্পানির পরিচালনার জন্যও প্রয়োজনীয় রাজস্ব আদায় হবে।

দাম বাড়ানোর পক্ষে কোম্পানিগুলোর যুক্তি হলো- বিদেশি কোম্পানির (আইওসি) গ্যাসের দাম পরিশোধ, করের পরিমাণ বৃদ্ধি, ভবিষ্যৎ জ্বালানি ঘাটতি মোকাবেলা, জাতীয় বেতন স্কেল বাস্তবায়ন, উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগসহ বিভিন্ন কারণে গ্যাসের দাম বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করছে পেট্রোবাংলা।

অন্যদিকে শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস পাচ্ছেন না শিল্প উদ্যোক্তারা। অনেক সময় গ্যাসের পর্যাপ্ত চাপ থাকে না। কারখানা চালু রাখাই কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু প্রতি মাসে ঠিকই গ্যাস বিল দিতে হয়। এর মাঝেই এক বছরের মধ্যে আরেক দফা গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। এবার দাম বাড়ানো হলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব হবে না। একই সঙ্গে দেশের বাজারেও এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। পরিবহন ভাড়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম, বাড়ি ভাড়া বাড়বে। সার্বিক জীবন যাপনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা এবং বর্তমানে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি তপন চৌধুরী বলেন, জ্বালানি ব্যয় কম থাকায় দেশে শিল্প হিসেবে বিশেষ করে টেক্সটাইল খাতের বিকাশ হয়েছে। গত বছর গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে বস্ত্র খাতের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায় ব্যাপকভাবে। ফলে অন্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই এক বছরের ব্যবধানে আবার গ্যাসের দাম বাড়ানো কোনোভাবেই যৌক্তিক হবে না। তপন চৌধুরী বলেন, বর্তমানে অধিকাংশ টেক্সটাইল মিল দক্ষ ব্যবস্থাপনায় ক্যাপটিভ জেনারেটর ব্যবহার করছে। তারা কো-জেনারেশন পদ্ধতিতে জেনারেটরের বাড়তি তাপ কাজে লাগাচ্ছেন। এতে গ্যাসের অপচয় হ্রাস পেয়েছে। তার পরও ক্যাপটিভের ক্ষেত্রে ১৩০ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

সিএনজি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাসুদ খান বলেন, সিএনজি মালিকরা মাত্র ৫ শতাংশ গ্যাস ব্যবহার করে সর্বোচ্চ ২২ শতাংশ কর দেন সরকারকে। তার পরও তাদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করা হচ্ছে। গত বছর সিএনজির সর্বোচ্চ দাম বাড়ানো হয়েছে। এ বছর সিএনজির দাম ৮৩ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। আবারও দাম বাড়ানো হলে সিএনজি ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।

এ ব্যাপারে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছেন, দাম বাড়ানোর বিষয়টি বিইআরসির এখতিয়ার। কমিশন যদি মনে করে দাম বাড়ানো প্রয়োজন তবে বাড়াবে। তিনি বলেন, ২০১৮ সালের দিকে দেশে আমদানি করা এলএনজি আসছে। তখন গ্যাসের দাম অনেক বেড়ে যাবে। এখন থেকেই ধাপে ধাপে গ্যাসের মূল্য বাড়িয়ে একটি সহনীয় পর্যায়ে না নিলে একবারে এলএনজির দামের সঙ্গে সমন্বয় করা কঠিন হবে। উদ্যোক্তারা এর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবেন না। তাই প্রতি বছর কিছু কিছু করে দাম বাড়ানো উচিত। রান্নার সিলিন্ডার গ্যাস জনপ্রিয় করতে বাসাবাড়ির জন্য পাইপলাইনের গ্যাসের দাম বাড়ানো উচিত বলেও মনে করেন তিনি।

কারখানা মালিকরা জানান, শিল্পকারখানায় গ্যাসের স্বল্পচাপজনিত সমস্যা নতুন নয়। চাপ না থাকলে গ্যাসের বদলে বাতাস ঢুকতে থাকে কারখানার বয়লারে। একইভাবে গ্যাসের মিটারও ঘুরতে থাকে। অর্থাৎ বিল উঠতে থাকে। এতে গ্যাসের বদলে বাতাস বিক্রি করেও কোম্পানিগুলো রাজস্ব আদায় করছে বলে অভিযোগ তাদের। এটাকে 'সিস্টেম গেইন' বলে স্বীকারও করছে গ্যাস বিক্রেতা কোম্পানিগুলো।

সিস্টেম লসের কারণে কিছু লোকসান হওয়ার কথা। কিন্তু গত কয়েক বছর দেখা যাচ্ছে সরবরাহ করা গ্যাসের চেয়ে বিল বেশি হচ্ছে। এটাকে সিস্টেম গেইন হিসেবে দেখানো হচ্ছে হিসাবের খাতায়। গত পাঁচ বছর ধারাবাহিকভাবে সিস্টেম গেইন করে আসছে তিতাস। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সিস্টেম গেইন তিন দশমিক ৮৯ শতাংশ। একই বছর জালালাবাদের সিস্টেম গেইন শূন্য দশমিক ৩৩ শতাংশ, কর্ণফুলীর চার দশমিক ২৯, বাখরাবাদের চার শতাংশ এবং পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানির তিন দশমিক ৯৪ শতাংশ। অর্থাৎ কোম্পানিগুলো গ্যাসের বদলে বাতাস বিক্রি করে ওই পরিমাণ আয় করেছে।

প্রস্তাবিত দাম: বর্তমানে দুই চুলার জন্য মাসিক বিল ৬৫০ এবং এক চুলার জন্য ৬০০ টাকা। কোম্পানিগুলো এ মূল্য বাড়িয়ে যথাক্রমে ১ হাজার ২০০ এবং ১ হাজার টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে। এ ছাড়া সিএনজির দাম প্রতি ঘনমিটার ৩৫ থেকে ৫৮ টাকা, গৃহস্থালিতে মিটারভিত্তিক গ্যাসের দাম ৭ টাকা থেকে ১৬ টাকা ৮০ পয়সা ও শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত ক্যাপটিভ বিদ্যুতের জন্য প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৮ টাকা ৩৬ পয়সা থেকে ১৯ টাকা ২৬ পয়সা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ২ টাকা ৮২ পয়সা থেকে ৪ টাকা ৬০ পয়সা এবং শিল্পের বয়লারে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ৬ টাকা ৭৪ পয়সা থেকে ১০ টাকা ৪৫ পয়সা নির্ধারণের প্রস্তাব রয়েছে।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এমএইউ

Wordbridge School
Link copied!