• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
৭ বছরে ৪২৭ বিস্ফোরণে ২৫৪ মৃত্যু

মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার গাড়ি যেন বোমা


বিশেষ প্রতিনিধি ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৮, ০২:১৩ পিএম
মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার গাড়ি যেন বোমা

ঢাকা : যানবাহনে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস (সিএনজি) সিলিন্ডার ব্যবহার মৃত্যুঝুঁকি বাড়াচ্ছে। সারা দেশে প্রায় তিন লাখ যানবাহন ব্যবহার করছে এই সিএনজি সিলিন্ডার। এসব সিলিন্ডারের প্রায় দেড় লাখ মেয়াদোত্তীর্ণ। এ তথ্য রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানির (আরপিজিসিএল)।

মেয়াদোত্তীর্ণ এসব সিলিন্ডার বিস্ফোরণে প্রায়ই সড়কে ঘটছে হতাহতের ঘটনা। বিস্ফোরণের এসব ঘটনায় চলন্ত বোমায় পরিণত হয়েছে যানবাহন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে চলন্ত গাড়িতে বিস্ফোরণের মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটতেই থাকবে, বাড়বে মৃত্যুঝুঁকি।

বিস্ফোরক অধিদফতরের তথ্য মতে, ২০১১ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ৪২৭টি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়েছে। এতে ২৫৪ জন নিহত এবং ৮০০ জন আহত হয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে ব্যবহৃত (মেয়াদোত্তীর্ণ) গ্যাস সিলিন্ডার মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে।

গত ২ ফেব্রুয়ারি হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলায় সিলিন্ডার বিস্ফোরণে এক যাত্রীর মৃত্যু হয়, আহত হন অন্তত ২৫ জন। বিস্ফোরণে পুরো বাসটি পুড়ে যায়। এর আগে গত ২০ ডিসেম্বর রাজধানীর শাহবাগের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে মিডওয়ে পরিবহনের একটি বাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়। এতে বাসটিতে আগুন লেগে চালক দগ্ধ হলেও বেঁচে যান যাত্রীরা। একইভাবে গত ১৩ ডিসেম্বর মগবাজার ফ্লাইওভারের ওপর একটি বাস পুড়ে যায়।

এ প্রসঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামসুল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ভয়াবহ তাজা বোমার মতো কাজ করে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) থেকে গাড়ির ফিটনেস সনদ নেওয়ার সময় পুনরায় সিলিন্ডার পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা গেলে বিস্ফোরণ ঝুঁকি অনেকাংশে কমবে। সিএনজিচালিত যানবাহনের অনুমোদন বিআরটিএ দেয় জানিয়ে বুয়েটের এই অধ্যাপক বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডারের কারণে যেসব দুর্ঘটনা ঘটছে তার দায় এড়াতে পারে না বিআরটিএ। সরকারের উচিত খুব শিগগিরই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) সাবেক নির্বাহী পরিচালক ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ মনে করেন, যাত্রীবাহী বাসের মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা নতুন উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ গাড়ির আশপাশের মানুষের জন্যও বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই নিরাপত্তার স্বার্থে এসব সিলিন্ডার পুনরায় পরীক্ষা করা উচিত। প্রয়োজনে বদলে ফেলা উচিত। কিন্তু আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকায় সংশ্লিষ্ট গাড়ির মালিক অনেক সময় বিষয়টি আমলে নেন না। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীনতাও সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

বিআরটিএ’র সর্বশেষ হিসাবে, গত অক্টোবর পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত গাড়ি ৩২ লাখ ১৭ হাজার ৭৯২টি। এর মধ্যে বাস ৪৩ হাজার ১৫৪টি, কার্গো ভ্যান ৮১৯৭টি, কভার্ড ভ্যান ২৪ হাজার ২৮০টি, হিউম্যান হলার ১৬ হাজার ৭০৩টি, প্রাইভেট কার ৪৩ হাজার ১৫৫টি, মাইক্রোবাস ৯৬ হাজার ৪৫টি, মিনিবাস ২৭ হাজার ৭৬৮টি, যাত্রীবাহী কার ৩ লাখ ২৭ হাজার ৪৮৭টি, ট্যাক্সি ৪৫ হাজার ১৯৪টি এবং ট্রাক ১ লাখ ৩০ হাজার ৪২৫টি।
 
রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানির (আরপিজিসিএল) তথ্য মতে, সিএনজি দিয়ে দেশে প্রায় তিন লাখ গাড়ি চলছে। এর প্রায় দেড় লাখে রয়েছে মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার, যা পুনরায় পরীক্ষা করা হয়নি। সিএনজি নিরাপত্তার আন্তর্জাতিক মান নির্দেশনায় প্রতিটি গ্যাস সিলিন্ডার পাঁচ বছর পরপর পরীক্ষা করানোর বিধান রয়েছে। কিন্তু দেশের ৮০ শতাংশ সিলিন্ডার পুনরায় পরীক্ষা করা হয়নি। ফলে এসব গাড়ির প্রতিটিই যেন বিপজ্জনক চলন্ত বোমা হয়ে উঠেছে।

গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ন্ত্রক সংস্থা আরপিজিসিএলের সচিব হাসানুজ্জামান জানান, যানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে গাড়িতে সংযোজিত সিলিন্ডার এবং সিএনজি ফিলিং স্টেশনের ক্যাসকেড (গ্যাস সিলিন্ডার গ্রুপ) সিলিন্ডার ৫ বছর অন্তর পরীক্ষা করতে প্রায়ই গণবিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়, কিন্তু পরীক্ষা করার দায়িত্ব আরপিজিসিএলের নয়। সব ধরনের সিলিন্ডার পুনরায় পরীক্ষার অনুমোদন দেয় বিস্ফোরক অধিদফতর। আর যানবাহনের ফিটনেস সনদ দেয় বিআরটিএ। এই দুই সংস্থার দায়িত্ব বিষয়টি দেখভালের।

বিস্ফোরক অধিদফতরের প্রধান পরিদর্শক সামসুল আলম মনে করেন, মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার পুনরায় পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করে আইন করা প্রয়োজন। তিনি জানান, এ পর্যন্ত মাত্র ১৫ হাজার গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডার পরীক্ষার হালনাগাদ প্রতিবেদন তাদের কাছে আছে। গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষার সময় গ্যাস সিলিন্ডার পরীক্ষার প্রতিবেদন জমা দিতে অধিদফতরের পক্ষ থেকে দুই বছর আগে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো সাড়া মেলেনি।

সামসুল আলম বলেন, প্রাকৃতিক গ্যাস রূপান্তরকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেই সিলিন্ডার ঝুঁকিপূর্ণ কিনা- তা পরীক্ষা করা হয়। সারা দেশে রিটেস্ট সেন্টার ১৯টি, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এছাড়া যানবাহনের ফিটনেস সনদ দেয় বিআরটিএ। তাদের ফিটনেস পরীক্ষার সময় সিলিন্ডার পরীক্ষার সনদ বাধ্যতামূলক করা গেলে আর সমস্যা হয় না।

বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভার্সন ওয়ার্কশপ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ফারহান নূর বলেন, তাদের পক্ষে এগুলো যাচাই করে গ্যাস দেওয়া সম্ভব নয়। বিআরটিএ থেকে ফিটনেস সনদ নেওয়ার সময় সিলিন্ডার পুনরায় পরীক্ষার প্রতিবেদন জমা বাধ্যতামূলক করা গেলে ভালো হয়।

বিআরটিএ পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মো. মাহবুব-ই-রব্বানী জানান, পাঁচ বছর অন্তর সিএনজিচালিত যানবাহনের গ্যাস সিলিন্ডার পুনরায় পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক হলেও কেউ মানে না। আবার বিআরটিএ’র এত কম জনবল দিয়েও এর বিরুদ্ধে চিরুনি অভিযান চালানো সম্ভব নয়। সবকিছু দেখেই ফিটনেস সনদ দেওয়া হয় জানিয়ে তিনি বলেন, সিলিন্ডার মেয়াদোত্তীর্ণ হলে রিটেস্ট করতে আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষ ও প্রতিষ্ঠানের কাছে যেতে বলি।’

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!