• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষে খুন এমপি লিটন


গাইবান্ধা প্রতিনিধি  ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৭, ১০:৩৯ এএম
রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষে খুন এমপি লিটন

গাইবান্ধা : রাজনৈতিক পথ পরিষ্কার করতেই গাইবান্ধার সরকারদলীয় এমপি মনজুরুল ইসলাম লিটনকে খুনের পরিকল্পনা করেন জাতীয় পার্টির (জাপা) কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল কাদের খান। শুধু প্রতিপক্ষ লিটনকেই নয়- রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে গাইবান্ধা-২ আসনে নিজ দলের মনোনয়ন পাওয়া শামীম হায়দার পাটোয়ারীকেও হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। তার ইচ্ছে ছিল সব রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে খুন করে তিনি সংসদ সদস্য হবেন- জানিয়েছে পুলিশ। লিটন হত্যাকাণ্ডের পর টেলিফোনে আড়ি পেতে আরো একজনকে হত্যার পরিকল্পনার কথা জানতে পারে পুলিশ। সেই সূত্র ধরে শুরু হয় অনুসন্ধান। আর এতেই আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য লিটন হত্যায় জাতীয় পার্টির (জাপা) কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল কাদের খানের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। 

অন্যদিকে কাদের খানের কিলিং মিশনের কথা জানতে পেরে রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করেছেন খোদ শামীম হায়দার পাটোয়ারী। 

এদিকে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে খুলে গেছে প্যান্ডোরার বাক্স। একে একে বেরিয়ে আসছে এমপি লিটন হত্যার যাবতীয় তথ্যপ্রমাণ। গ্রেফতার হয়েছে কিলিং মিশনে অংশ নেয়া সব আসামি, কাদের খানের বাড়ির মাটি খুঁড়ে উদ্ধার করা হয়েছে এমপি লিটন হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র। কিলিং মিশনে অংশ নেয়া চার আসামির তিনজন গ্রেফতার হয়েছে গত মঙ্গলবার। আদালতে তারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। আর গতকাল বৃহস্পতিবার ( ২৩ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে ঢাকার শ্যামলী থেকে গ্রেফতার হয়েছে আনোয়ারুল ইসলাম রানা। 

এর আগে গতকাল দুপুর দেড়টার দিকে গাইবান্ধা জেলা পুলিশের আয়োজনে এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম জানান, লিটন হত্যাকাণ্ডে হান্নান, মেহেদী, শাহীন ও রানা অংশ নেয়। তাদের মধ্যে মঙ্গলবার ভোরে গাইবান্ধা শহরের ব্রিজ রোড এলাকা থেকে হান্নান, মেহদী ও শাহীনকে গ্রেফতার করা হয়। তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এরপর তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী পলাতক রানাকে ঢাকার একটি বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়।

এদিকে ১০ দিনের রিমান্ডের প্রথম দিনেই পুলিশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন লিটন হত্যার ‘পরিকল্পনাকারী’ আব্দুল কাদের খান। তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী গ্রামের বাড়ির উঠান খুঁড়ে একটি পিস্তল উদ্ধার করেছে পুলিশ। সুন্দরগঞ্জ থানার ওসি আতিয়ার রহমান জানান, বুধবার রাত ১টার দিকে কাদেরের পশ্চিম ছাপরহাটি গ্রামের বাড়ির উঠান খুঁড়ে ছয় রাউন্ড গুলিভর্তি ম্যাগাজিনসহ একটি পিস্তল ও একটি ফাঁকা ম্যাগাজিন উদ্ধার করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘বুধবার সারা দিন কাদেরের বাড়ি খুঁজে ও পুকুর সেচে তল্লাশি করে কোনো অস্ত্রের সন্ধান মেলেনি। পরে ১০ দিনের পুলিশ হেফাজতে থাকা কাদেরের দেয়া তথ্যানুযায়ী গভীর রাতে তার বাড়ির উঠান খুঁড়ে লুকিয়ে রাখা এই পিস্তলটি উদ্ধার করা হয়। পুলিশের ধারণা, এই পিস্তলটি লিটন হত্যায় ব্যবহৃত হয়েছে।  এটা এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হবে।’ 

এর আগে কাদের লাইসেন্সকৃত একটি পিস্তল সুন্দরগঞ্জ থানায় জমা দেন বলে জানান ওসি আতিয়ার। এ ছাড়া কাদের এখনো ৩০ রাউন্ড গুলির হিসাব দিতে পারেননি। ওসি আতিয়ার বলেন, ‘পুলিশ কাদেরকে লাইসেন্সকৃত পিস্তল ও গুলি থানায় জমা দিতে বলেছিল। তিনি মোট ৪০ রাউন্ড গুলির মধ্যে মাত্র ১০ রাউন্ডসহ একটি পিস্তল থানায় জমা দেন। বাকি ৩০টি গুলি তিনি কী করলেন তার কোনো সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি।’

গত পহেলা ডিসেম্বর রাতে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ধোপাডাঙ্গার নয়াবাজার এলাকায় এক ব্যক্তির মোবাইল ফোন ছিনতাই হয়। পরে সেখান থেকে ছয়টি গুলিসহ একটি ম্যাগাজিন স্থানীয়রা উদ্ধার করে থানায় জমা দেয়। পুলিশ বলছে, এটি কাদের খানের লাইসেন্সকৃত পিস্তলের ম্যাগাজিন। এই সূত্র ধরে বের হয় আলোচিত এমপি লিটন হত্যার পেছনের খবর।

জবানবন্দিতে তিনজন যা বলেছেন : গাইবান্ধার অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম মইনুল হাসান ইউসুবের আদালতে মঙ্গলবার মেহেদী, শাহিন মিয়া ও হান্নান স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। হান্নানের বাড়ি বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার কামারপাড়া গ্রামে। রাশেদুল ইসলাম ওরফে মেহেদী হাসান (২২) ও শাহিনের (২৩) বাড়ি সুন্দরগঞ্জের শ্রীপুর ইউনিয়নের উত্তর সমস কবিরাজটারি গ্রামে।

আদালত ও পুলিশ সূত্র বলেছে, জবানবন্দিতে ওই তিনজন বলেন, মনজুরুল হত্যার ছয়-সাত মাস আগে থেকে, অর্থাৎ মে মাসের দিকে কাদের খান তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তিনি সংসদ সদস্য হওয়ার ইচ্ছা উল্লেখ করে তাদের বলেন, পথের কাঁটা লিটনকে (মনজুরুল) সরিয়ে দিতে হবে। পরিকল্পনামতো তারা মনজুরুলকে হত্যার জন্য একাধিকবার চেষ্টা করেন। এর মধ্যে গত বছরের ২৭ অক্টোবর ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কে তারা মনজুরুলকে হত্যার জন্য ওত পেতে ছিলেন। কিন্তু তিনি সেদিন ওই পথে যাননি।

মেহেদী জবানবন্দিতে বলেন, হত্যাকাণ্ডের ১৫ দিন আগে তারা মনজুরুলের গ্রামের বাড়ি সুন্দরগঞ্জের ছাপারহাটির একটি ধানের চাতালে অবস্থান নেন। সেখানে তিনি, শাহিন ও রানা থাকতেন। কাদের খানের গাড়িচালক হান্নান তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। ওই চাতালে থাকার সময় তারা নিয়মিত অস্ত্র চালানোর চর্চা করতেন। চাতালের আশপাশের গ্রামের অনেক লোক তাদের দেখে সন্দেহ করেন। মনজুরুলকে হত্যার পরিকল্পনা হিসেবে তারা কয়েক দিন ওই এলাকায় রেকি করেন। একদিন কাদের খানও তাদের সঙ্গে ছিলেন।

শাহিন জবানবন্দিতে বলেন, ঘটনার দিন তিনি ও মেহেদী গাইবান্ধা শহরে ছিলেন। কাদের খান তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে গাড়িতে করে শহর থেকে তুলে নেন, আর রানাকে নেন কদমতলা থেকে। বিকেল ৪টার দিকে তারা কাদেরের সুন্দরগঞ্জের বাড়িতে যান। তাদের বাড়িতে বসিয়ে রেখে কাদের স্থানীয় সাংবাদিক চন্দনের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। চন্দন তাকে মনজুরুলের বাড়িতে অবস্থান নিশ্চিত করেন। এরপর কাদেরের দেয়া একটি মোটরসাইকেলে করে তারা মনজুরুলের গ্রামের বাড়িতে যান। তিনজনের হাতে তিনটি অস্ত্র ছিল। প্রথমে রানা ও তিনি মনজুরুলের বাড়িতে ঢোকেন। এরপর মেহেদী ঢুকেই গুলি শুরু করেন। তখন তারাও দুটি করে গুলি করেন। খুন করে পালানোর সময় তার মাথায় থাকা ক্যাপ পড়ে যায়। ক্যাপটি ছিল মেহেদীর। মেহেদীর মাথায় হেলমেট থাকায় তিনি ক্যাপটি পরেছিলেন। খুনের পর তারা কাদেরের বাড়িতে যান। এরপর হান্নান তাদের নিয়ে বগুড়ায় চলে আসেন। সেখান থেকে রাত দেড়টার আগমনী পরিবহনে তাদের তুলে দেয়া হয়। হান্নান বাসের টিকিট নেন কাদেরের নামে। পুলিশ সেই টিকিট জব্দ করে।

শাহিন জবানবন্দিতে আরো বলেন, খুনের জন্য তাদের সাত লাখ টাকা দেয়া হয়। তিনি ও রানা দুই লাখ করে ও মেহেদী তিন লাখ টাকা নেন। কথা ছিল, কাদের সংসদ সদস্য হলে তাদের একটি পেট্রলপাম্প করে দেবেন।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!