• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাষ্ট্রপতি থেকে ভিক্ষুক কার কেমন ঈদ?


এম আরমান খান জয় জুন ২৬, ২০১৭, ০১:২৯ পিএম
রাষ্ট্রপতি থেকে ভিক্ষুক কার কেমন ঈদ?

ঢাকা: বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের ঈদ উৎসবও ভিন্ন ভিন্ন। রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ- সবার ঈদ ভাবনা আর উদযাপন একেবারেই আলাদা।

রাষ্ট্রপতির ঈদ
ঈদের দিনে বঙ্গভবনের দরজা-জানালা খুলে দেয়া হয়। এলিট পাড়ার মানুষ লাইন ধরে প্রবেশ করতে থাকেন বঙ্গভবনে। সদর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপতি, সঙ্গে থাকে স্ত্রী। আগতদের সঙ্গে হাত মেলান। কারো ভাগ্য ভালো হলে কোলাকুলি করারও সুযোগ হয়।

প্রধানমন্ত্রীর ঈদ
পহেলা রমজান থেকেই ব্যস্ততা বেড়ে যায় প্রধানমন্ত্রীর। পঙ্গু বিধবা ও আলেমদের নিয়ে ইফতার করেন। বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণির মানুষের কাছে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে পৌঁছে যায় ঈদ শুভেচ্ছা বা কার্ড। বিরোধীদলীয় নেত্রীকে জানান শুভেচ্ছা। ঈদের দিনে দলীয় নেতাকর্মী, কূটনীতিক, সমমনা রাজনৈতিক দলের নেতারা শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।

মন্ত্রী-এমপিদের ঈদ
ঈদের দিন মন্ত্রী-এমপিরা চেষ্টা করেন নিজ গ্রামের বাড়ি তথা নির্বাচনী এলাকায় থাকতে। যারা ভোট দিয়ে তাকে নেতা বানিয়েছে, তাদের যে ভুলে যাননি তার প্রমাণ দেয়ার চেষ্টা করেন। কোনো এক ঈদগাঁ মাঠে গিয়ে নামাজ পড়েন। কথাবার্তা বলেন। আশ্বাস দেন। জনগণের জন্য যে তিনি গভীর মমতা রাখেন দুই ঈদে তাদের মাঝে হাজির হয়ে তার প্রমাণ দেন।

ব্যবসায়ীদের ঈদ
দেশের বড়বড় ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগই ঈদ করেন দেশের বাইরে। তবে তারা যে গরীব-দুঃখীদের জন্য কিছু করতে চান তার প্রমাণও দিয়ে যান। মাইকে ঘোষণা দিয়ে কয়েক হাজার মিসকিনকে জড়ো করেন। বিশেষ আমন্ত্রণে মিডিয়ার ক্যামেরাও থাকে হাজির। এরপর দু’তলার বেলকুনি থেকে কয়েকশ’ শাড়ি-লুঙ্গি ছুঁড়ে দেন কয়েক হাজার মানুষের দিকে। কাপড় কুড়াতে গিয়ে পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে মারা যায় কেউ কেউ। মধ্যম শ্রেণির ব্যবসায়ীদের চাঁদরাত রাত পর্যন্ত ব্যস্ত থাকতে হয় দোকানদারি নিয়ে। কেউ কেউ তো আবার ঈদের দিনেও দোকান খোলা রাখেন।

ইমাম-মুয়াজ্জিনের ঈদ
ইমাম মানে নেতা। তার নেতৃত্বে নামাজ আদায় করা হয়। ইমাম সামনে থাকেন। বাকি সকল মুসল্লি, তা তিনি রাষ্ট্রপতি হোন, মন্ত্রী-এমপি হোন অথবা সাধারণ কেউ, সবাইকে পেছনেই দাঁড়াতে হয়। অথচ আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইমাম মুয়াজ্জিনকে প্রাপ্য সম্মান দেয়া হয় না। বিশেষত কিছু মুসল্লি-সেক্রেটারি আছেন, যারা ইমাম মুয়াজ্জিনকে অনেকটা কর্মচারির মতো মনে করেন। ঈদ উপলক্ষে তাদের ছুটি নেই। প্রিয় সন্তানকে কাছে ডেকে একটু আদর করা হয় না। আবার অনেক মসজিদে ঈদের বোনাসটা পর্যন্ত দেয়া হয় না। সামান্য যে কয়টা টাকা বেতন পান, সেটাই পাঠিয়ে দেন বাড়িতে।

চিকিৎসকদের ঈদ
ঈদ উপলক্ষে বড়বড় চিকিৎসকরা সবাই ছুটিতে চলে যান। এই সময় অসুস্থ রোগীরা হাসপাতালে বড়বেশি অসহায় অবস্থায় কাটায়। ইমার্জেন্সি রোগীরা যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে কিন্তু বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের নাগাল পায় না। অবশ্য করারও কিছু নেই। চিকিৎসকরাও তো সামাজিক মানুষ। তাদেরও তো একটা ব্যক্তিগত লাইফ আছে। সব মিলিয়ে চিকিৎসদের ঈদ কাটে ভালোই।

রোগীদের ঈদ
রোগী অসুস্থ হয়ে বাসায় পড়ে থাকলে ঘরের মানুষ একটু খেয়াল রাখে। তবে খেয়ালের পরিমাণটা নির্ভর করে রোগীর প্রভাবের ওপর। তবে যারা হাসপাতালের বেডে বা মেঝেতে পড়ে থাকে, তাদের অবস্থা বড় করুণ! যদিও ঈদ উপলক্ষে একটু ভালোমন্দ খাবারের ব্যবস্থা করা হয়, কিন্তু শরীরে শান্তি না থাকলে খাবার দিয়ে কী হবে? আত্মীয়-স্বজন থাকলে হাসপাতালে টিফিন যায়। যাদের কেউ নেই, তাদের জন্যে কেউ যায় না। তারা তখন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে শুধু। শারীরিক কষ্টের সাথে তখন যোগ হয় মানসিক কষ্ট।

পুলিশের ঈদ
কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে ঈদ উপলক্ষে পুলিশ বাহিনীতে ছুটি নেই। ঈদের দিনেও তাদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। আমরা যে ঈদের দিনে মারামারি করবো না, তার নিশ্চয়তা দিতে পারি না বলেই হয়তো তাদের সতর্ক থাকতে হয়। ঈদগাহের দখল নিয়ে রক্তপাতের ‘ঐতিহ্য’ আছে! সে কারণেই বেতন আর বোনাসের টাকাগুলো বাড়িতে পাঠিয়ে একা একা ঈদ করতে হয় পুলিশ বাহিনীদের সদস্যদের।

সাংবাদিকের ঈদ
সাংবাদিকরা যে খুব একটা রিলাক্সড হয়ে ঈদ করতে পারেন, সেটা বলার সুযোগ নেই। ঈদের দিনের নানা ঘটনাবলি তাদের পর্যবেক্ষণ করতে হয়। বিশেষত ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কর্মরতদের আরো বেশি তটস্থ থাকতে হয়। রাষ্ট্রপতি কোন ঈদগাহে নামাজ আদায় করলেন, সেটার ছবি যেমন দরকার, তেমনি মন্ত্রী-এমপিরা কে কোথায় ঈদ করলেন, সেটাও জাতিকে জানাতেই হয়।

প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকদেরও ঈদে বেড়ানোর পাশাপাশি চোখ-কান খোলা রাখতে হয়। সংবাদ স্টক করে রাখতে হয়। মারাত্মক কোনো নিউজ কাভার করতে না পারলে এবং সেটা অন্য পত্রিকায় ছাপা হলে অনেক ক্ষেত্রে সম্পাদকের ধমকও হজম করতে হয়।

লেখকের ঈদ
লেখকরা মোটামুটি ১০ রমজানের পর থেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বিভিন্ন পত্রিকার ঈদ সংখ্যার জন্য লেখার ফরমায়েশ থাকে। আবার প্রতিটি পত্রিকার জন্য লিখতে হয় আলাদা আলাদা ফিচার। লিখে খান- এমন লেখকের সংখ্যা সারা দেশে খুব বেশি হবে না। পয়সার বিনিময়ে লেখেন, এমন লেখকরা স্বাভাবিক কারণেই এক লেখা একাধিক পত্রিকাতে দেন না। দেয়া উচিতও না। কিন্তু ফ্রি লিখেন যারা, তারাতো চাইতেই পারেন অনেক কষ্ট করে লেখা তাদের ফিচারটি যত বেশি সম্ভব পাঠকের সামনে যাক।

সন্ত্রাসীদের ঈদ
সারা বছর মাস্তানি করলেও ঈদের দিনে দামি পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে হাজির হন ঈদগাহে। নামাজের পরে গণ-কোলাকুলির মাহফিলে তাকে বেশি ব্যস্ত দেখা যায়। সবাই এক ধরণের তোয়াজমাখা মনোভাব নিয়ে তাদের সঙ্গে মেশেন। সবচেয়ে বেশি সালাম তারাই পান। ঈদের পরপর যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি তারা কাজে নেমে পড়েন।

কয়েদীদের ঈদ
কারাগার হচ্ছে জীবন্তদের কবর! ঈদের দিনে তাদের জন্য বিশেষ খাবারের আয়োজন করা হয়। তবে ঈদের আনন্দ তাদের স্পর্শ করে কি না, তা বলা যায় না। মা-বাবা, ভাইবোন, বউবাচ্চা ছাড়া একাকি চার দেয়ালের ভেতরে ভালো লাগার কারণ নেই। বিশেষত বিনাদোষে জেল খাটছে যারা।

ফেরারীদের ঈদ
মামলা কিংবা হামলা যার কারণেই ফেরারী হোক না কেন, জীবন তাদের যাযাবরের মতো। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় তাদের ঘুরে বেড়াতে হয়। মনেপ্রাণে শান্তি থাকে না। অপরিচিত কেউ তাকাচ্ছে দেখলেই চমকে উঠে। এমন জীবনে ঈদ কি আর আনন্দ আনতে পারে। ঈদের আনন্দ থেকে তারা পুরোপুরি বঞ্চিত।

নারীদের ঈদ
রমজানের দুপুর থেকেই শুরু হয় ইফতারি তৈরির কাজ। রোজা রেখে সারাটা দিন কাটাতে হয় জ্বলন্ত চুলোর কাছে। ইফতার করে পুরুষরা ‘পেটটাইট’ করে বেরিয়ে যান। বাসন কোসন পরিষ্কার করে নারীদের অনেকেই তারাবির নামাজে দাঁড়ান। এরপর আবার হালকা থেকে মাঝারি নাশতার আয়োজন। এভাবে চলে যায় অর্ধেক রাত। তারপর সেহেরি ঝক্কি। পুরো মাস এভাবে কাটার পর আসে ঈদ। ভোর থেকে চলে প্রস্তুতি। ‘ঘণ্টায় একশ মাইল’ গতিতে কাজ চালাতে হয়। সারাদিন রান্নাবান্না, বাকি সময় মেহমানদের আপ্যায়ন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঈদের নতুন শাড়িটি পর্যন্ত গায়ে তোলার সুযোগ হয়ে ওঠে না।

শিশুদের ঈদ
ঈদ কাকে বলে, কতো প্রকার, কী কী, তা তো শিশুদের চেয়ে কেউ ভালো জানে না। ঈদের প্রকৃত আনন্দ শিশুরাই উপভোগ করে থাকে। ঈদের নতুন জামা-কাপড় কেনার পর সেগুলো সযত্নে লুকিয়ে রাখে। ঈদের দিন থাকে মহাব্যস্ত। তবে গরীবের ছেলেমেয়ের কাছে ঈদ অন্য দশটা পাঁচটা দিনের মতোই আরো একটা দিন।

বুড়বুড়ির ঈদ
বয়স একটু বেশি হয়ে গেছে। এই যেমন ৭০/৮০। দু’একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে সংসারে তাদের বোঝা মনে করা হয়। সারাজীবন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে সংসারের স্বচ্ছলতা আনতে চেষ্টা করে যাওয়া এই মানুষগুলোকে জীবনের শেষ সময়টুকু কাটাতে হয় বড় অযত্ন-অবহেলায়। ঈদের দিন বড় হয়ে যাওয়া সন্তান তাকে ঠিকমতো একবার এসে জিজ্ঞেসও করে না। একসময় এই ছেলে-মেয়ের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য তারা কত কীই না করেছেন!

টোকাইদের ঈদ
টোকাইদের নিয়ে কেউ ভাবে না বললে ভুল হবে। সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ টোকাইদের জন্য করেছিলেন পথকলি। এদেশে শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদ আছে, জিয়া শিশু-কিশোর সংঘও আছে, আবার আছে এরশাদের পথকলিও। আবার ছিন্নমূল বস্ত্রহীন টোকাইও আছে। ঈদ তাদের কাছে আলাদা কিছু নয়। কাধে বস্তা ঝুলিয়ে এদিনও তাদের বেরুতে হয়। কারণ, তা না করলে পেটে খাবার জুটবে না। ‘ঘরনাইদের’ জন্য আবার ঈদ!

রিকশাওয়ালার ঈদ
কিছু কিছু রিকশাওয়ালা ঈদের দিনেও রিকশা নিয়ে বের হন। ঈদের দিন ভাড়া বেশি পাওয়া যায় তাই। অবশ্য কিছু আছে তারা বাস্তবিকই অসহায়। শরীর মানে না, তবুও তাদের বেরুতে হয়। রিকশা টানতে হয় ঈদের সারাটা দিন। সমাজের এই অসহায় অংশটি দু’দিনের খাবার কখনো একত্র করতে পারে নি। তাই ঈদ তাদের জন্যে আলাদা কিছু নয়। অন্য দশটি-পাঁচটি দিনের মতোই একটি দিন।

চাকরিজীবির ঈদ
হালকা থেকে মাঝারি ধরনের চাকরিজীবি যারা, অনেক টানাটুনি করে তাদের ঈদের খরচ অ্যাডজাস্ট করতে হয়। বেতন-বোনাস মিলিয়ে কোনো রকমে চালিয়ে নিতে চেষ্টা করেন। অবশ্য হাই লেভেলের চাকরিজীবি যারা, আমলা শ্রেণি, তাদের কথা ভিন্ন। তাদের অনেকেই বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে ঈদ করতে যান দেশের বাইরে।

ধনীদের ঈদ
যারা প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা খরচ করেন বিলাসিতায়, সুইজারল্যান্ড ছাড়া যাদের হলিডে উদযাপন করা হয় না, সিঙ্গাপুর ছাড়া যাদের বউয়ের শাড়ি পাওয়া যায় না, ইউরোপ-আমেরিকা ছাড়া সন্তানকে ভর্তি করার উপযোগী কলেজ পাওয়া যায় না তাদের আবার ঈদ! টাকার পাহাড়ের চড়ে সুখের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেও যারা এতটুকু শান্তির জন্যে ছটপট করছেন তাদের ঈদ তো বিশাল ব্যাপার-স্যাপার।

ফকিরের ঈদ
সত্যিকারের যারা ফকির,যাদের ঘরে খাবার নেই, পরনে কাপড় নেই যে কারণে ঈদের দিনেও তাদের বেরুতে হয় ভিক্ষের থালা নিয়ে। এতটুকু খাবারের আশায় হাজিরা দিতে হয় মানুষের দরজায়। ভিক্ষে করে জীবিকা নির্বাহ করে যারা, ঈদ তাদের সামনে আলাদা কোনো বৈশিষ্ট নিয়ে হাজির হয়ে না। তবে এদিন বেশি ভিক্ষা পাওয়া যাবে এটাই ঈদের আনন্দ তাদের।

সোনালীনিউজ/এন

Wordbridge School
Link copied!