• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সংস্কারপন্থিদের নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা বিএনপির


বিশেষ প্রতিনিধি ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৭, ০৫:৩৫ পিএম
সংস্কারপন্থিদের নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা বিএনপির

ঢাকা: আবারও আলোচনায় ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশের রাজনৈতিক পটপরির্বতনের সময় স্রোতের বিপরীতে দাঁড়ানো বহুল আলোচিত ‘সংস্কারপন্থি’ শব্দটি। গত বৃহস্পতিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) বিএনপির চেয়ারপারসন দুই সংস্কারপন্থি নেতাকে ডেকে দলে কাজ করার নির্দেশ দিলে দীর্ঘ ১০ বছর পর আবারও রাজনৈতিক আলোচনায় ফিরে আসে বিষয়টি।

সে সময় বড় দুই দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিতে দলের ভেতর থেকে যে সংস্কারের প্রস্তাব উঠেছিল; গত কয়েক দিনে সে আলোচনা আবারও পেয়ে বসেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন ও আগ্রহ। সামনে চলে আসছে দুই দলের সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচিত নেতাদের নাম। তারা কেমন আছেন, কার কী অবস্থা, কে দলে ফিরতে পেরেছেন, কে পারেননি; এমনতর নানা আলোচনা চলছে নানা মহলে।

হঠাৎ রাজনীতিতে ফিরে আসা ১১ জানুয়ারির সেই সংস্কারপন্থিদের বিষয়টি নিয়ে চলছে বিশ্লেষণ। কথা বলছেন রাজনীতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও। প্রশ্ন উঠছে তা হলে কি আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুই দলেই ফিরছেন সংস্কারপন্থি নেতারা? কিংবা তাদের গুরুত্ব বাড়ছে?

অবশ্য সংস্কারপন্থি রাজনীতির খেলায় বিএনপির চেয়ে অনেকগুণ এগিয়ে আওয়ামী লীগ। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক উদারতাও স্মরণীয়। সেই সঙ্গে সুসংহত সাংগঠনিক ভিত্তিও। কারণ ঘটনার ১০ বছর পর বিএনপি সবেমাত্র সংস্কারপন্থিদের দলে ফেরানোর কথা চিন্তা করলেও আওয়ামী লীগ কাজটি শুরু করেছে ঘটনার মাত্র এক বছরের মাথায় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে।

পরে প্রথম দফায় ক্ষমতায় এসেই উদারতার পরিচয় দিয়ে সংস্কারপন্থিদের দলে ফেরান শুরু করেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ক্রমান্বয়ে সংসদ সদস্য করেন ও মন্ত্রিত্ব দেন। এমনকি সর্বশেষ ২০তম কাউন্সিলেও জায়গা দিয়েছেন সংস্কারপন্থি কিছু নেতাকে। অর্থাৎ গত ১০ বছরে আওয়ামী লীগ যেখানে বিষয়টি শেষ করে এনেছে, সেখানে বিএনপি কেবল শুরু করেছে।

এমনকি পরবর্তীতে যেন সংস্কারের নামে স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে দলীয় প্রধানকে ‘মাইনাস’ করে এমন অরাজনৈতিক ও অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত নিতে কেউ সাহস না করে; সে ব্যবস্থাও জিইয়ে রেখেছেন শেখ হাসিনা। কারণ সম্প্রতি গণভবনে এক বৈঠকে এক-এগারোর প্রসঙ্গ তুলে সংস্কারপন্থীদের উদ্দেশ করে শেখ হাসিনা বলেন, তাদের (১/১১-এর সময় যারা দলের সংস্কার চেয়েছিলেন) ক্ষমা করে দিয়েছি, কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ডের কথা ভুলে যাইনি। ফলে সে সব নেতাদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি কাজ করবে। বিপরীতে খালেদা জিয়া দলের সংস্কারপন্থি নেতাদের সঙ্গে ন্যূনতম যোগাযোগটুকুও রাখেননি। এমনকি তাদের ব্যাপারে নেতিবাচক মন্তব্য করায় সাংগঠনিক ভিত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

অন্যদিকে, দীর্ঘ ১০ বছরেও দল থেকে ডাক না পাওয়ায় দলের বাইরে নিজেদের বেশ সুসংহত করে তুলেছেন বিএনপির সংস্কারপন্থি নেতারা। এমনও শোনা যাচ্ছে, এসব নেতারা খুব শিগগির দলের ভেতরের উদারপন্থি নেতাদের নিয়ে স্বয়ং দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কথাও ভাবছে। অথচ একই সময়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা কেবল এসব নেতাদের দলেই ফেরাননি, দলের সঙ্গে একীভূত করে দল ও দলীয় প্রধানের প্রতি আস্থাও বাড়িয়েছেন। ফলে সংস্কারপন্থী বিষয়টি এখন আওয়ামী লীগে নেই বললেই চলে।

সংস্কারপন্থিদের দলে ফেরানোর ব্যাপারে বড় দুই দলের উদ্যোগকে জাতীয় রাজনীতির জন্য ‘ইতিবাচক’ বলে মন্তব্য করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, সংস্কারপন্থিদের দলে ফেরানোর মধ্য দিয়ে বিরাজনীতির সংস্কৃতি দূর হলো।

এ ব্যাপারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. তারেক সামসুর রেহমান বলেন, এক-এগারোর ঘটনায় কুশীলবদের প্ররোচণায় বড় দুটি দল আওয়ামী লীগ-বিএনপির প্রভাবশালী কিছু নেতা তাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছিলেন। দল ভাঙার ষড়যন্ত্রে রাতারাতি হয়ে উঠেছিলেন সংস্কারপন্থি। যারা দীর্ঘদিন সুবিধা পেয়ে এসেছেন তারাই নিজ দলে সংস্কারের দাবি তোলেন, যা ছিল দল দুটির জন্য অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য চ্যালেঞ্জ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নেপথ্যের কুশীলবরা তাদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে পারেননি এবং দুই বছরের মাথায় নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়।

এই বিশ্লেষক আরও বলেন, এদিক থেকে সব সময় পিছিয়ে বিএনপি। তারা সব কিছুতে ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করেন। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারদর্শী নন। তবে এত দিন পরে হলেও দলের প্রয়োজনে এবং আওয়ামী লীগ থেকে শিক্ষা নিয়ে সংস্কারপন্থিদের যে দলে ভেড়াতে চাইছেন, এটা ইতিবাচক। কারণ আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ক্ষমতায় যেতে হলে এই দলটিকে পূর্ণাঙ্গ শক্তি নিয়ে লড়তে হবে, তাহলেই ইতিবাচক ফল দলের অনুকূলে আসতে পারে। এসব নানাবিধ চিন্তা, রাজনৈতিক হিসেব-নিকেষ থেকেই হয়তবা বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দেরিতে হলেও এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

অপর রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কাজী সিরাজ বলেন, ক্ষমতার রাজনীতিতে দলে বিভাজন বা ভাগাভাগি পৃথিবীতে নতুন কিছু নয়। শেখ হাসিনা দলের হাল ধরার আগে চার খন্ড হয়েছিল আওয়ামী লীগ। আর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কিছু সংস্কারপন্থি দল ভাঙার জন্য সংস্কার চাননি। তারা চেয়েছিলেন দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চর্চা নেই তা শোধরানোর জন্য। এটা অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। তবে শেখ হাসিনা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলেই সংস্কারপন্থি’রা সহজেই দলে ভিড়তে পেরেছিলেন। অপরদিকে, বিএনপি সংস্কারপন্থিদের বিষয়ে সব সময় পশ্চাৎপদ ছিলেন। তবে রাজনীতিতে যে বিরাজনীতি শুরু হয়েছিল তা থেকে বেরিয়ে আসার যে মানসিকতা পরিলক্ষিত হচ্ছে তা অবশ্যই ভালো দিক। জাতীয় রাজনীতিতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আমি মনে করি।

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি (ওয়ান ইলেভেন বা এক এগারো-নামে পরিচিত) সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলই ভাঙনের মুখে পড়ে। দলের একাংশ সংস্কার প্রস্তাব তুলে শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগ থেকে এবং খালেদা জিয়াকে বিএনপি থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করে। দুই নেত্রী সে সময় কারাবন্দি ছিলেন। রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর দুই নেত্রীই সংস্কারপন্থি নেতাদের অনেককেই আর দলে জায়গা দেননি। সে থেকেই দলের ভেতর ও বাইরে এসব নেতারা ‘সংস্কারপন্থি’ হিসেবে পরিচিতি পান। ব্যাপক সমালোচিত হয়ে পড়েন জাতীয় রাজনীতিতে। এমনকি শেষ পর্যন্ত অনেক নেতাকে অন্য দলে আশ্রয় নিতে হয়েছে। দলে ফেরার সুযোগ পাওয়ার আগেই প্রয়াত হয়েছেন অনেকে। রাজনৈতিক পাঠ চুকিয়ে অনেকে অরাজনৈতিক জীবনযাপন করছেন।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, আমরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন সংগ্রাম করছি। এ সংগ্রামে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছে আমাদের দলীয় প্রধান বেগম খালেদা জিয়া। অনেক মত-পথের সংগঠন ও লোক এই ছাতাতলে আসবেন-এটা আমরা আশা করি। দলের কিছু নেতাকর্মী যারা সংস্কারপন্থি হয়েছিলেন তারা ঘরে ফিরতে চায়। তারা চেয়ারপারসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন। তাদের অতীতের ভুলের জন্য ক্ষমা চাইছেন। তাই তাদের দলে সক্রিয় হওয়া এবং রাজনীতি করার সুযোগ দিচ্ছেন বেগম খালেদা জিয়া।

২০০৭ সালের ২৬ জুন ১৫ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিয়ে তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ও তাকে সমর্থনকারী নেতারা সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচিতি পান। ওই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর মান্নান ভূঁইয়াকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তখন থেকেই দলে সংস্কার ও অসংস্কারপন্থি দুটি ধারা সৃষ্টি হয়। খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন মহাসচিব হওয়ার পর বিভেদ আরও বেড়ে যায়।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/এইচএআর

Wordbridge School
Link copied!