• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নয়ন-ফরাজীদের উত্থানের নেপথ্যে


বরিশাল ব্যুরো জুলাই ৭, ২০১৯, ০১:৪১ পিএম
নয়ন-ফরাজীদের উত্থানের নেপথ্যে

বরিশাল : বরগুনায় স্ত্রীর সামনে প্রকাশ্যে রাস্তায় দিনের বেলা রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িত নয়ন বন্ড বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়া ছাড়াও এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছে রিফাত ফরাজীসহ ১০ জন। যার মধ্যে চারজন এরই মধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তবে নয়ন বন্ড ও রিফাত-রিশান ফরাজীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতারা রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

এ নিয়ে আলোচনার ঝড় বাইছে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক মহলে। তাদের অভিযোগ, রাজনৈতিক নেতাদের মদদ ও আশ্রয়-প্রশ্রয়ে নয়ন বন্ড ও রিফাত-রিশান ফরাজীরা সৃষ্টি হয়েছে।

এমনকি তাদের মদতদাতা হিসেবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেই এমপি ধীরেন্দ্র নাথ শম্ভুর ছেলে সুনাম দেবনাথ ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের নাম উঠে আসে। তাদের মদতেই নয়ন বন্ড ও রিফাত-রিশান ফরাজীরা বরগুনায় ভীতির রাজত্ব কায়েম করেছিল।

এমনকি সুনাম দেবনাথের তথ্যে নয়ন বন্ড বন্দুকযুদ্ধে নিহত ও দেলোয়ার হোসেনের তথ্যে রিফাত ফরাজী গ্রেপ্তার হয়েছে বলে গুঞ্জন সর্বত্র। যদিও তদন্তের স্বার্থে আসামিদের গ্রেপ্তারের স্থান সম্পর্কে কিছু বলেনি পুলিশ।

উত্থান ও অপকর্ম : সহযোগী সন্ত্রাসীদের নিয়ে গঠন করা একটি সন্ত্রাসী গ্রুপের নাম ‘০০৭ বন্ড গ্রুপ’। এই গ্রুপের সেকেন্ড ইন কমান্ড রিফাত ফরাজী আর লিডার হচ্ছে নয়ন বন্ড। জেমস বন্ডের আদলে গড়া এই সন্ত্রাসী গ্রুপের শেষ শব্দ বন্ডের সঙ্গে মিলিয়েই নিজের নামের পেছনে বন্ড লাগিয়েছে নয়ন। এই গ্রুপের একটি ফেসবুক গ্রুপও আছে। রিফাত শরীফকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যার আগের রাতে এই ফেসবুক গ্রুপেই হত্যার সর্বশেষ নির্দেশনা দেয় রিফাত ফরাজী।

বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী ০০৭ বন্ড নামের সন্ত্রাসী গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাতা নয়ন বন্ড। ছোটবেলা থেকেই সন্ত্রাসী এবং মাদকসেবীর খাতায় নাম লেখানো নয়ন বহুবার জেল খেটেছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ৫ মার্চ রাত ১১টার দিকে নয়ন বন্ডের বাসায় অভিযান চালায় বরগুনা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ।

এ সময় ৩০০ ইয়াবা, ১২ বোতল ফেনসিডিল, ১০০ গ্রাম হেরোইনসহ আটক হয় নয়ন। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে বরগুনা সদর থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও অস্ত্র আইনে দুটি মামলা করে নয়ন বন্ড ও তার সহযোগী ইমামের বিরুদ্ধে। সে সময় আওয়ামী লীগের কোনো পক্ষ নয়ন সম্পর্কে মুখ খোলেনি। এমনকি ২০১৮ সালের ২৮ এপ্রিল জেলা ছাত্রলীগের নেতারা যখন মাদক ব্যবসায়ী নয়ন বন্ডকে সংসদ সদস্য পুত্রের সহযোগী হিসেবে শনাক্ত করেন, তখন একে প্রতিপক্ষের অপপ্রচার বলে চালিয়েছিলেন সংসদ সদস্য পুত্র সুমন দেবনাথ।

৮ মামলার আসামি রিফাত ফরাজী : বরগুনা পৌর শহরের ৪নং ওয়ার্ডের দুলাল ফরাজীর ছেলে রিফাত ফরাজী। অবশ্য আরো একটি পরিচয় আছে তার। সে বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা, সাবেক সংসদ সদস্য এবং বর্তমানে বরগুনা জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের আপন ভাগ্নে। বরগুনা থানা পুলিশ সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী হামলা, ভাঙচুর, চাঁদাবাজি, ছিনতাই এবং মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধে মোট ৮টি মামলা রয়েছে রিফাতের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন সময়ে এসব মামলায় বেশ কয়েকবার গ্রেফতারও হয় সে।

বর্তমানে বরগুনায় কর্মরত পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমি বরগুনায় কর্মরত থাকাবস্থায় একদিন রিফাত তার সহযোগীদের নিয়ে আমার বাসার আঙ্গিনায় হৈচৈ করছিল। আমার স্ত্রী নিষেধ করলে ক্ষেপে গিয়ে দলবল নিয়ে আমার বাসায় হামলা চালায় সে। বাসার ভেতরে ঢুকে আমার স্ত্রীকে লাঞ্ছিত এবং ভাঙচুর চালায়। এ ঘটনায় থানায় মামলা হলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। কিন্তু কিছুদিন পর জেল থেকে বের হয়ে আবার শুরু করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।

বরগুনা থানার ওসি আবীর হোসেন মাহমুদ জানান, ‘নয়ন বন্ডের বিরুদ্ধে মাদক, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী এবং ছিনতাইয়ের ১০টি মামলা রয়েছে। বহুবার আমরা তাকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়েছি। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে জামিন নিয়ে সে আবার বের হয়ে আসে।’

জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জুবায়ের আদনান অনিক বলেন, নয়ন বন্ডের পৃষ্ঠপোষক বা তাদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা সেটা এখন আর কারোর বুঝতে বাকি নেই। আমি শুনেছি নয়ন বন্ড এমপির ছেলের লোক। তাছাড়া ফেসবুকেও দেখেছি তাদের সাথে ০০৭ গ্রুপের সদস্যদের ছবি। তিনি বলেন, রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ছাড়া নয়ন বন্ডরা তৈরি হয়নি। মূলত মাদক ব্যবসার স্বার্থেই তাদের তৈরি করা হয়। এমনটি না হলে ২০১৬ সাল থেকে জেলা ছাত্রলীগ মাদকবিরোধী যে আন্দোলন শুরু করেছিল তাতেই নয়ন বন্ড ও তার গ্রুপ দমে যেত। এটা করতে ২০১৮ সালে আমরা সংবাদ সম্মেলনও করেছি। কিন্তু রাজনৈতিক, প্রশাসন বা মিডিয়ার সহযোগিতা না পেয়ে একসময় আমাদের আন্দোলন থেমে যায়। এখন যে আলোচনা চলছে সেটাও হয়তো একসময় থেমে যাবে।

জেলা যুবলীগের সভাপতি কামরুল আহসান মহারাজ বলেন, খুনি কে সেটা স্পষ্ট। আমরা চাই ওইসব খুনির বিচার। তাই রিফাত হত্যার বিষয়টি রাজনৈতিক বিষয়ে জড়াতে চাই না। তবে এতটুকু বলতে পারি আমার যুবলীগের কোনো নেতা-কর্মী এই নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়নি। বরং তারা অন্য কারোর ছত্রছায়ায় থাকতে পারে।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির বলেন, নয়ন-রিফাতদের কোনো রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন হয়নি। তারা কোনো রাজনৈতিক দলেরও নয়। যে কোনো রাজনৈতিক নেতা ব্যক্তিস্বার্থে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজীকে তৈরি করেছে। তিনি বলেন, নয়ন বন্ড ও রিফাতদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা কে বা কারা সেটা বুঝতে কারোর বাকি নেই। আমরাও জানি তারা কারা। তিনি বলেন, আমরা চাই আর কোনো নয়ন বন্ড বা রিফাত ফরাজী যেন তৈরি না হয়।

জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য দেলোয়ার হোসেন বলেন, নয়ন-রিফাতের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা হলেন বরগুনার এমপি ধীরেন্দ্রনাথ শম্ভুর ছেলে জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক সুনাম দেবনাথ।

তিনি বলেন, রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা তো রয়েছেই। তবে সেটা দলের স্বার্থে নয়, বরং ব্যক্তি স্বার্থে। মূলত মাদক ব্যবসার জন্যই নয়ন বন্ড সৃষ্টি হয়। আমি নয়নকে কখনোই চিনতাম না। সে এমপিপুত্র সুনামের লোক সেটা বহুবার শুনেছি। তবে রিফাত ফরাজী এমন ছিল না। পাশাপাশি বসবাসের সুবাধে নয়ন বন্ড ওকে মাদক এবং অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে।

ভায়রার ছেলে হিসেবে রিফাত-রিশানকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে দেলোয়ার হোসেন বলেন, রিফাত ওর পরিবারের অবাধ্য সন্তান। ওর বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত চারটি মামলা রয়েছে। ওর বাবা বহুবার ওকে বোঝাবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কাজ হয়নি। তাই আমি নিজে রিফাতকে পুলিশের কাছে ধরে দিয়েছি। কিন্তু জামিনে বের হয়ে আবার সেই একই পথে চলে যায়। তাই ওকে পরিচয় দেওয়াই বন্ধ করে দিয়েছি। মূলত রাজনৈতিকভাবে আমার সুনাম ক্ষুণ্ন করতেই আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।

এ বিষয়ে বরগুনার এমপি ধীরেন্দ্রনাথ শম্ভু ও তার ছেলে সুমন দেবনাথের বক্তব্য জানতে একাধিকবার ফোন করা হলেও তারা ফোন রিসিভ করেননি। যদিও রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আলোচনায় উঠে আসার শুরু থেকেই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন সুনাম দেবনাথ। তার অভিযোগ বাবার সুনাম ক্ষুণ্ন করতেই কতিপয় নেতা মিথ্যাচার করছে।

এদিকে গত বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের বরিশাল বিভাগীয় প্রতিনিধি সভায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যার ঘটনা। এই ঘটনা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন কেন্দ্রীয় নেতারা।

প্রধান বক্তার বক্তব্য দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ নয়ন-রিফাতদের প্রশ্রয়দাতাদের ইঙ্গিত করে বলেন, ‘নয়ন বন্ড একদিনে তৈরি হয়নি। রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় ছাড়া নয়ন বন্ড তৈরি হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী বরগুনার ঘটনাটি অবগত। তিনি দেশে ফিরে নয়ন বন্ডদের সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেলে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক তার বক্তব্যে বলেন, বরগুনার ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না। এ ঘটনার সঙ্গে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে দলীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাছাড়া বরগুনার ঘটনায় দলের ভাবমূর্তি যারা ক্ষুণ্ন করেছে তাদের বিরুদ্ধে দলীয় ওয়ার্কিং কমিটি সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানিয়েছেন অপর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!