ঘূর্ণিঝড় সিডরের স্মৃতি উপকূলবাসীকে আজো তাড়া করে বেড়ায়

  • বরিশাল ব্যুরো | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: নভেম্বর ১৫, ২০২২, ১০:৫৫ এএম

বরিশাল: ২০০৭ সালের এ দিনে ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে জেলার উপকুলীয় এলাকা ভয়াবহ ধ্বংস যজ্ঞের শিকার হয়। মঙ্গলবার (১৫ নভেম্বর) ভয়াল সিডর দিবস।  ঝড়টি ভূমিতে আছড়ে পড়ার সময় প্রথম এক মিনিটে বাতাসের বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল প্রতিঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার, যা একে সাফির-সিম্পসন স্কেলে ক্যাটাগরি-৫ এর সাইক্লোনে পরিণত করে। এতে মূহূর্তেই লন্ডভন্ড হয়ে যায় উপকূলীয় এলাকাগুলো। সিডরের কালো রাতের ভয়াল দূর্যোগ গোটা উপকূলবাসীকে এখনও তাড়া করে ফিরছে।

স্থানীয় মানুষের স্মৃতিচারণে উঠে এসেছে- সেদিন সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে সাতটা। তীব্র দমকা হাওয়ার সাথে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। আবহাওয়া বিভাগের ১০ নম্বর সতর্ক সংকেত শুনেও আশ্রয় কেন্দ্রে না গিয়ে বেশীর ভাগ মানুষই রয়ে গেলেন বাড়িতে। তাদের ধারণা ছিল, কত ঝড়ই এলো গেলো, এবারেও তাদের কিছু হবে না। রাত সাড়ে ১০টার দিকে সিডর আঘাত হানলো উপকূলীয় এলাকায়। প্রবল ঝড় ও মাত্র ১০ মিনিটের জলোচ্ছ্বাসে উপকূলের কয়েক হাজার মানুষকে ভাসিয়ে নিলো। সকালে সব লন্ডভন্ড। লাশের পর লাশ। চারিদিকে শুধুই ধ্বংসলীলা।

জেলা ত্রাণ কার্যালয়ের সূত্র জানায়, সরকারি তথ্য অনুযায়ী- ২০০৭ সালের এ ঘূর্ণিঝড়ে সিডরে জেলায় প্রাণ হারান ১ হাজার ৩৪৫ মানুষ। নিখোঁজ হন ১৫৬ জন। ৩০ হাজার ৪৯৯ টি গবাদি পশু ও ৬ লাখ ৫৮ হাজার ২৫৯ টি হাঁস-মুরগী মারা যায়। ২ লাখ ১৩ হাজার ৪৬১ টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।  সম্পূর্ণ গৃহহীন হয়ে পড়ে ৭৭ হাজার ৭৫৪ টি পরিবার।

ভয়াল সিডরের স্মৃতিতে এখনো শিউরে ওঠেন উপকূলের মানুষেরা। মহাবিপদ সংকেতের কথা শুনে আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। বরগুনা সদর উপজেলার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার হয় নলটোনা গ্রাম। ঘূর্ণিঝড়ের পরের দিনই সেখানে অর্ধশতাধিক মানুষের লাশ পাওয়া যায়। গ্রামটি পানির নিচে থাকায় লাশ দাফনের জন্যও কোন স্থান খুঁজে পাওয়া যায়নি। সিডর পরবর্তী সময়ে তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসে দেশ-বিদেশের সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাসমূহ।

ঘূর্ণিঝড় সিডরের  আঘাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন মাঝের চরের গর্ভবতী গৃহবধু বিলকিস বেগম। ঝড় ও বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সপ্তাহখানেক পর বিলকিস বেগমের কোল আলো করে একটি পুত্র সন্তন জন্ম নেয়। আত্মীয়-স্বজনরা শিশুটির নাম রাখেন সিডর। তার বয়স এখন ১৫ বছর চলছে। ঘূর্ণিঝড় সিডরের স্মৃতি নিয়েই শিশু সিডর বেড়ে উঠছে।

জানা গেছে, সুপার সাইক্লোন সিডর ক্ষতিগ্রস্থ হয় বেড়িবাঁধসহ অসংখ্য স্থাপনা, কৃষকের ক্ষেত ও মৎস্য সম্পদ। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সড়ক, বিদ্যুৎ সহ টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা। ঝড় ও ঝড়ের পরবর্তী সময়ে রোগ বালাইয়ে মারা গেছে বহু গবাদি পশু।

বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়- সিডর ও আইলায় বরগুনার ৪৮৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যায়। তখন সরকার ৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। যা দিয়ে ২৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া ১ হাজার ৪৪৮ মেট্রিক টন গমের মাধ্যমে ১০.৬৫৮ কিলোমিটার বাঁধ (অস্থায়ী প্রতিরক্ষা) মেরামত করা হয়েছে।

আজও থামেনি জেলে পরিবারগুলোর কান্না : সিডরে বঙ্গোপসাগরে থাকা ৫ শতাধিক মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারের ৩ হাজার জেলে নিখোঁজ হয়ে যায়। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় সিডরের ১৫ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও সন্ধান মেলেনি নিখোঁজ জেলেদের। নিখোঁজ এসব জেলেরা বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে তাও জানেনা পরিবারের সদস্যরা। তবে তাদের পরিবারের সদস্যরা আজো তাদের প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে। থামেনি স্বজনহারাদের কান্না। সিডরের কথা মনে করে এখনও আঁতকে ওঠেন তারা। স্বজন হারানোদের ব্যথায় এখনো আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলার জেলে পল্লিতে। নিখোঁজ জেলেদের ফিরে আসার প্রতিক্ষায় প্রহর গুনছেন স্বজনরা।

গ্রেট ভোলা সাইক্লোন : ১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশের উপকুলীয় এলাকার উপর দিয়ে বয়ে যায় প্রলয়ঙ্করী ‘গ্রেট ভোলা সাইক্লোন’। ওই ঝড়ে চট্টগ্রাম, বরগুনা, খেপুপাড়া, পটুয়াখালী, ভোলার চর বোরহানুদ্দিনের উত্তরপাশ ও চর তজুমুদ্দিন এবং নোয়াখালীর মাইজদি ও হরিণঘাটার দক্ষিণপাশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ঝড়ে প্রাণ হারায় প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ।

স্মৃতিতে সিডর : সিডরের কথা মনে হইলে আইজও কইলজাটা কাইপ্পা ওডে, রাইতে ঘুমাইতে পারি না। বড় বড় গাছ পরার ছবি এহনও চোহে ভাসে। মোর ঘরটা পালকের মতো উঠাইয়া নিয়ে গ্যালো। চাতুর দিকে চাইয়া দেহি পানি আর পানি। ব্যানে উইড্ডা দেহি মোর ছাগল-গরু আর নাই। সিডরের দিনের ভয়াল স্মৃতি এমনভাবেই প্রকাশ করছিলেন ঝালকাঠির কাঠালিয়া উপজেলার আওরাবুনিয়া গ্রামের ফিরোজ মিয়া। তার মতো এমন দুঃসহ স্মৃতি আজও বয়ে বেড়ান উপকূল অঞ্চলের অসংখ্য মানুষ।

১৯ কবরে ৩৩ লাশ : সিডরে বরগুনা সদরের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাম নলটোনা। এখানে তখন কোনো বেড়িবাঁধ ছিল না। জলোচ্ছ্বাসে এ গ্রামে প্রায় ২০ ফুটের মতো পানি আছড়ে পড়ে। পরের দিনই সেখানে প্রায় অর্ধশতাধিক মানুষের লাশ পাওয়া যায়। তখনো এলাকাটি ছিল পানির নিচে। লাশ দাফনের জন্য স্থান খুঁজে পাচ্ছিলেন না তাদের স্বজনরা। তখন লাশ নিয়ে দাফন করা হয় কিছুটা দূরে বরগুনা-নিশানবাড়িয়া সড়কের পাশে পশ্চিম গর্জনবুনিয়া গ্রামে। দাফনের কাপড় ছাড়াই ৩৩ জনকে ১৯টি কবরে মাটিচাপা দেয়া হয় বলে জানান গ্রামের বাসিন্দারা।

আজও হয়নি টেকসই বেড়িবাঁধ : সিডরের ১৫ বছর পার হলেও নির্মিত হয়নি উপকূলীয় রক্ষাবাঁধ। ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে অতিবর্ষণ কিংবা আমাবস্যা-পূর্ণিমার জোয়ারে পানি ঢুকে নষ্ট হয়ে যায় ফসল-ফলাদি। তলিয়ে যায় মাছের ঘেরসহ পুকুর। আমনচাষে সমস্যা হয়। লবণ পানি উঠে নষ্ট হয় ফসল। শক্ত বেড়িবাঁধ না হওয়ায় ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের খবরে আতঙ্কে থাকে উপকূলবাসী। ঝালকাঠির সুগন্ধা ও বিষখালী নদী তীরবর্তী এলাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ না হওয়ায় এখনো দুর্যোগ ঝুঁকিতে দিন পার করছে জেলার অনেক পরিবার। সূত্রমতে, টেকসই বেড়িবাঁধ না থাকায় ২০০৮ ঘূর্ণিঝড় নার্গিস, ২০০৯ আইলা, ২০১৩ মহাসেন, ২০১৫ কোমেন, ২০১৬ রোয়ানু, ২০১৭ মোরা, ২০১৯ ফণী ও বুলবুল, ২০২০ আমফান, ২০২১ ইয়াস, ২০২২ সিত্রাং এর প্রভাবে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে উপকূলীয় জেলাগুলোতে। তাই আজও ত্রানের পরিবর্তে টেকসই বেড়িবাঁধ চায় উপকূলবাসী।

পানি উন্নয়ন বোর্ড কলাপাড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী মো.আরিফ হোসেন বলেন- ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর ক্ষতিগ্রস্থ বেড়িবাঁধ পূর্ণনির্মাণ ও সংস্কার করা হয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চল হওয়ায় উপজেলার বিভিন্ন পোল্ডারের বেড়িবাঁধ নদী ভাঙলে শিকার হচ্ছে। এ সকল বেড়িবাঁধ ডাম্পিং পদ্ধতিতে নির্মাণের জন্য কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে অবহিত করা হয়েছে। এছাড়া নীলগঞ্জের জালালপুর কয়েকটি পয়েন্টে বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ জরুরি ভিত্তিতে মেরামতের কাজ চলছে বলে তিনি সাংবাদিকদের জানান।

ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক মো. জোহর আলী বলেন- বিষখালী তীরে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য মন্ত্রণালয় প্রস্তাব পাঠানো আছে। যাতে দ্রুত বাস্তবায়ন হয় সে ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

সোনালীনিউজ/এসএস/এসআই